ব্রেইন ড্রেইন থেকে ব্রেইন গেইনের গল্প: যেভাবে আমরাও পারি দেশকে মেধাশূন্য হওয়া থেকে বাঁচাতে

গ্রিস, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ভুক্ত দেশগুলোর মাঝে অন্যতম একটি দেশ। ২০১০ সালে সমগ্র গ্রিস জুড়ে নেমে আসে ব্যাংক দেউলিয়ার দুর্ভাগ্য। সাথে সাথে দেশ জুড়ে নেমে আসে চরম বেকারত্ব, দারিদ্রতা আর হাজার হাজার ব্রেইন ড্রেইনের ছবি। হঠাত করেই দেশ জুড়ে নেমে আসে সমস্যা আর তাণ্ডব। এককালের টুরিস্ট স্পটভ্রমণ পিপাসুদের তীর্থস্থান সরে যেতে থাকে পছন্দের তালিকা থেকে। অ্যান্টনিও চাল্কোপুলিয়াসের মতো হাজার হাজার মানুষ দেশ ছাড়তে থাকে ভাগ্যের সন্ধানেপাড়ি দিতে থাকে জার্মান সহ অন্যান্য দেশে। তবে গল্প এখন বদলাতে শুরু করেছে ধীরে ধীরে। দক্ষ মানুষগুলো ফিরে আসছে নিজের ঘরে, ফেরাতে দেশের ভাগ্য আর নিজের ভাগ্য। আজ এই বদলে যাবার গল্প নিয়েই আমাদের আয়োজন।

{ "slotId": "2452885053", "unitType": "in-article" }

এবার না হয় করি নিজের ঘরের জন্য

Image Source: dali.org

অ্যান্টনিও চাল্কোপুলিয়াস একজন পেশাদার সফটওয়ার প্রকৌশলী। ২০০২ সালে লন্ডন ফেরত এই মানুষটি কাজ শুরু করেছিলেন দেশের জন্য। ২০১০ সালের দেশ ব্যাপী ধ্বসের পর আবার ভাগ্যের সন্ধানে পাড়ি জমান লন্ডনে। এরপর আবার শুরু করেন লন্ডন থেকেই দেশের জন্য কাজ করা। লন্ডনে তার নিজস্ব সফটওয়ার ফার্ম খোলেন ল্যান্ডুপ। এই তো গত বছর তিনি তার কোম্পানি পায় ১ মিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ। এত বিনিয়োগ কিসের জন্য?

শর্ত একটাই সমগ্র বিনিয়োগের অর্ধেক ব্যয় করবেন গ্রিসে নতুন করে সফটওয়ার ব্যবসা শুরু করার জন্য। এর মাধ্যমে তৈরি করেছেন ভেঞ্চার ক্যাপিটাল ফার্ম। এখানে বলে রাখা ভালো ভেঞ্চার ক্যাপিটাল ফার্ম হচ্ছে বেশ কিছু কোম্পানি বা ব্যক্তির বিনিয়োগ নিয়ে তৈরি একটি ফার্ম বা কোম্পানি। এইসব ফার্মের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে বিনিয়োগের মাধ্যমে শূন্য থেকে কোনো ব্যবসা শুরু করা এবং লাভের কিয়দংশ ফার্ম ভোগ করবে। ভদ্রলোকের চেষ্টায় এখন শুরু হয়েছে গ্রিসে প্রচুর সফটওয়ার কোম্পানি। তিনি বলেন,

দেশীয় সাধারণ উদ্যোক্তারা শুধুমাত্র কাজ করে দেশীয় বাজারকে সামনে এগিয়ে নেয়। কিন্তু আমাদের লক্ষ্য সুদূর প্রসারী। আমরা শুধুমাত্র দেশীয় উদ্যোক্তাদের নিচ্ছি না। আমাদের মূল লক্ষ্য হচ্ছে দেশীয় উদ্যোক্তাদের ব্যবহার করে বাইরের বাজার ধরা এবং সেই সব উদ্যোক্তাদের নিয়ে কাজ করা যারা দেশের বাইরেও তাদের পণ্য বা সুবিধা প্রদান করতে চান। আমরা মূলত চাচ্ছি দেশে বসেই দেশের জনবল দিয়েই বৈশ্বিক বাজার ধরার।”

ধীরে ধীরে তাদের ফার্ম এখন গ্রিস সরকারইউরোপিয়ান বিনিয়োগ ফার্ম সহ বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান থেকেই বিনিয়োগ পাচ্ছে। তারা বর্তমানে গ্রিসের উদ্যোক্তাদের ৫০৯০ শতাংশ হারে বিনিয়োগ দিচ্ছে এবং ১৫২০ শতাংশ হারে ল্যাভাংশ নিচ্ছে। এরই মাঝে তার কোম্পানিতে সরকারি বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সর্বমোট ৩২০ মিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ হয়েছে ৯টি ভেঞ্চার ফার্মের মাধ্যমে ১৫টি নতুন স্টার্ট আপ দাঁড় করাতে। 

{ "slotId": "", "unitType": "in-article", "pubId": "pub-6767816662210766" }

এ তো আমার দেশআমার নিজের ঘর

Image Source: Calvaria.cloud

অনেকেই দেশের বাইরে থাকেন, দেশের জন্য করতে চান কিন্তু দেশের সামগ্রিক অবস্থা চিন্তা করে এবং ক্ষেত্র বিশেষে পরিস্থিতির শিকার হয়ে ক্ষান্ত দিয়ে তল্পিতল্পা গুটিয়ে দেশ ছাড়েন। কিন্তু গ্রিসের মতো ভঙ্গুর প্রায় দেশের কিভাবে পরিবর্তন আসছে? যেখানে দেশের সামগ্রিক অর্থে কোনো আয় নেই, ব্যবসা নেই, টাকা নেই সেখানে কিভাবে উদ্যোক্তা হওয়া সম্ভব?

ম্যারাথন ইনভেস্টমেন্ট কোম্পানির মাধ্যমে বিনিয়োগ পাওয়া প্রথম কোম্পানির সিইও টেক ফার্ম ‘নরব্লক’ এর সহপ্রতিষ্ঠাতা আসিটিনাক্স কানাকাছিছ এক সাক্ষাৎকারে বলেন, 

আমার এথেন্সে ফিরে আসাটা খুব কঠিন ছিল, একদিকে দেশীয় ভঙ্গুর অবস্থা অন্যদিকে মানসিক তুষ্টি। আমি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বাস করলেও দিন শেষে এথেন্স আমার নিজের ঘর, আমার মতো যারা ফিরে এসেছে তাদের দেশের জন্য ভালোবাসা এবং নস্টালজিয়া থেকেই আসা। দেশের জন্য শূন্য থেকে করার চেষ্টা। ”

ভেঞ্চার ক্যাপিটাল কোম্পানির কর্ণধার বলেন,

“সত্যি বলতে কি, সবাই বস্তুবাদী নাকারো মাঝে দেশের জন্য সেই আবেগটা রয়েই যায়। আমরা চেয়েছি সেটাকেই ব্যবহার করতে। যারা ফিরে আসছেন তাদের মাঝে কাজ করছে আবেগ আর বিশ্বাস, নিজের উপর এবং নিজের দেশের জন্য আবেগ। ব্যক্তি যদি নিজেদের হয় সেইক্ষেত্রে বিশ্বাস অর্জন সম্ভব সহজে। আমি মনে করি আমাদের দক্ষতা দিয়ে নিজেরদের ভাগ্য বদলানোর পাশাপাশি আরো দেশীয় মানুষের ভাগ্য বদলাতে পারবো।”

কানাকাছিছকে যখন এই বিনিয়োগের কথা বলা হয় তখন কানাকাছিছ তার ফার্ম ইতিমধ্যে অন্য দেশ থেকে চালাচ্ছেন এবং অন্য দেশে এগিয়ে নেবার চেষ্টা করছিল। কানাকাছিছ কিছুটা জেদ আর আবেগকে সাথে নিয়ে দেশে চলে আসেন। ঘরের মানুষদের নিয়ে শুরু করেন তার টেক ফার্ম। ইতোমধ্যে কানাকাছিছের কোম্পানিতে কাজ করতে ৭ জন দেশে ফেরত এসেছেন। কানাকাছিছ এর মতে, সামনের বছরের মধ্যেই আরো ২৫ জন দক্ষ কর্মী ফেরত আসবেন দেশে কাজ করার জন্য।

তবে কানাকাছিছ এর মতে, “গ্রীসে একটি ব্যবসা দাঁড় করানো খুবই ঝামেলার। আমি যদি নতুন উদ্যোক্তা হতাম তাহলে হয়তো এই প্রজেক্ট উঠে দাঁড়াতো কিনা জানি না।” তাই দেশের জন্য আবেগ আর জেদ নিয়েই কাউকে না কাউকে শুরু করতেই হয় ।

না হারালে অনুভব করবেন না

Image Source:15minutes

একই গল্প ইসরায়েলের ছিল। ১৯৭০ থেকে ‘৮০ এর দশকে ইসরাইল জুড়ে যখন মন্দা দেখা দেয় তখন ইসরাইলও একই ভাবে ভেঞ্চার ক্যাপিটাল মডেল নিয়ে যাত্রা শুরু করে উঠে দাঁড়াতে। ব্যক্তি মূলধন থেকে শুরু করে সরকারি ভাবে সহায়তা নিয়ে গড়ে উঠেছিল এই ভেঞ্চার ক্যাপিটাল ইকোসিস্টেম। এর মাধ্যমে বেশ কিছু ফার্ম গড়ে ওঠে যাদের মূল লক্ষ্যই ছিল ইসরাইল থেকে দক্ষ জনবল নিয়ে টেক শহর সিলিকন ভ্যালিতে পাঠানো। শুধু মাত্র সিলিকন ভ্যালিতেই ৬০,০০০ থেকে ১০,০০০ দক্ষ ইসরায়েলি ইঞ্জিনিয়ার রয়েছে এবং ১০০ এর বেশি ইসরায়েল ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান কাজ করছে।

টেকআভিভের প্রতিষ্ঠাতা ইয়ারুন সামিদ বলেন,

আমাদের দেশে টেক পণ্য বিক্রি এবং সুবিধা প্রদানের সুযোগ কম। তাই আমরা কিছুটা দাঁড়িয়ে গেলেই যুক্তরাষ্ট্রে আমাদের অফিস খুলি এবং ইসরায়েলে  আমাদের ইঞ্জিনিয়ার টিম কাজ করে। এইভাবে আমরা আর্থিকভাবে লাভবান যেমন হই তেমনি দেশে নতুন ইঞ্জিনিয়াররা সরাসরি সিলিকন ভ্যালি থেকে শেখে। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, যারা সফল উদ্যোক্তা এবং ব্যবসায়ী হন তারা নিজেদের স্টার্ট আপ বিক্রি করে দেশে চলে আসেন এক সময় এবং দেশে নতুন ভাবে শুরু করেন প্রতিষ্ঠান। আসলে আমাদের মাঝে দেশের প্রতি ভালোবাসা খুব বেশি এবং দেশের জীবন যাপন আমাদের কাছে পছন্দের।”

Image Source: Forbes-India

আমদের দেশেও ব্রেইন ড্রেইন অনেক বড় সমস্যা। দেশের হাজার হাজার মেধাবী সন্তানেরা ভাগ্যের অন্বেষণে পাড়ি জমায় বাইরে। এখন প্রশ্ন জাগে মনে গ্রিস বা ইসরায়েলের নেওয়া এই ভেঞ্চার ক্যাপিটাল পদ্ধতি কি আসলেই কাজে আসবে অন্য দেশ বা পরিস্থিতির সাপেক্ষে? ইউনিভার্সিটি অব পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ডেভেশ কাপুর এই নিয়ে বেশ কিছু সমীক্ষা করেছেন।

প্রফেসর কাপুরের মতে, সিলিকন ভ্যালির ভারতীয় কর্মীরাই গড়ে তুলেছে ভারতের সফটওয়ার বাজারযে বাজার এখন আমেরিকাকেও ছাড়িয়ে যাচ্ছে এবং সাথে সাথে নিজেদের ভেঞ্চার ক্যাপিটাল ফার্ম গড়ে তুলেছে। তার মতে, এইসব দক্ষ জনগোষ্ঠি শুধু যে ভারতকে আইটি সেক্টরে এগিয়ে নিয়েছে তাই নয় ভারতের সামাজিক অবকাঠামো নির্মাণে ও ভূমিকা রাখছে। এজন্য দরকার শুধু সদিচ্ছা আর দেশের জন্য আবেগ। তাই দক্ষ মানুষদের উচিৎ দেশের জন্য এগিয়ে আসার।

{ "slotId": "2452885053", "unitType": "in-article" }

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *