কিছু কিছু শিল্পপ্রতিষ্ঠান আছে যারা কর্মক্ষেত্রে অত্যন্ত প্রতিযোগিতামূলক ইঁদুর দৌড়ে ব্যস্ত। এমন প্রতিষ্ঠানে কাজ করা সাধারণ কর্মীদের জন্য খুবই ক্লান্তিকর। এক্ষেত্রে উদাহরণ হিসেবে ব্যাংকিং এবং ফিন্যান্স প্রতিষ্ঠানগুলো সবার আগে বিবেচ্য। এই ক্ষেত্রগুলোতে কর্মীরা সবসময়ই যে যার স্বার্থ নিয়ে ব্যস্ত থাকে। যেকোনো সময় যেকেউ তার সহকর্মীকে হটিয়ে দিয়ে তার জায়গা দখল করে। কর্পোরেট জগতে সাফল্যের সিঁড়ি বেয়ে এগিয়ে যেতে এমন প্রতিযোগিতায় সবাই মত্ত থাকে।
![](https://youthcarnival.org/wp-content/uploads/2018/05/Shoe-Health-8c413b4c.jpeg)
এই কারণে এমন প্রতিষ্ঠানগুলোতে বেশিরভাগ কর্মীরা শুধুমাত্র কর্ম এবং আত্মকেন্দ্রিক হয়ে থাকে। এই ইঁদুর দৌড়ে মানুষগুলো রোবটের মত হয়ে যায়। তারা কিভাবে পরবর্তী প্রোমোশন পাবে, আরো বেশি কমিশন ও বোনাস পেতে কি কি করা যেতে পারে, অথবা শুধু নিজের অবস্থান হারানো ঠেকাতে বা অন্য কারো দ্বারা লাথি খেয়ে চাকরীচ্যুত হওয়া ঠেকাতে কি করা যেতে পারে এগুলো নিয়েই ব্যস্ত থাকে।
কিন্তু এটাই কি জীবন? কর্মক্ষেত্রে মানুষগুলো এমন হয়ে যাচ্ছে কেন? আমরা মানুষ থেকে ক্রমশ রোবটের রুপান্তরিত হচ্ছি কেন?
আমি আমি এবং আমি
প্রতিষ্ঠানগুলোর এমন ইঁদুর দৌড়ের সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে কর্মীরাও ক্রমশ তাদের স্বভাব চরিত্র পরিবর্তন করে ফেলে আর কর্মক্ষেত্রের এই ব্যক্তিত্ববাদী বা আত্মকেন্দ্রিক মনোভাব তাদের ব্যক্তিগত সম্পর্কগুলোকে দারুণভাবে প্রভাবিত করে। এমন প্রচণ্ড চাপের প্রতিযোগিতামূলক চাকরিতে কর্মীদের মধ্যে মুখে মুখে ভাসা ভাসা সম্পর্ক দেখা যায়। সাথে সাথে তাদের মধ্যে পরস্পরকে বিশ্বাসের অভাব ও অসম্মানজনক নির্মম পরিবেশও স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
![](https://youthcarnival.org/wp-content/uploads/2018/05/i-was-assaulted-on-the-street-but-i-still-walk-home-alone-at-night-408-body-image-1428519885.jpg)
বেশিরভাগ কর্মী কর্মক্ষেত্রে নিজের হাত চালানোর মতো নিত্য দিনের এমন পরিবেশের সাথেও অভ্যস্ত হয়ে যায় সত্যি, কিন্তু এই অভ্যস্ততা কর্মক্ষেত্রের বাইরে ব্যক্তিগত জীবন ও সম্পর্কে নানান প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে। আপনিও নিশ্চয়ই এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছেন যে, কর্মীরা শুধু নিজেদের নিয়েই ব্যস্ত এবং অন্যের জন্য তাদের সামান্য সহানুভূতি দেখানোর সময় নেই! সম্পর্কগুলো শুধুমাত্র কাজের ভিত্তিতে পরিচালিত হয়!
দুর্ভাগ্যবশত, বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠান এমন পরিবেশ সৃষ্টি করে ফেলেছে এবং এমন পরিবেশই সেখানকার সাধারণ ঘটনা।
কর্মঘণ্টার বাইরে কী ঘটে?
এমন আত্মকেন্দ্রিক সম্পর্ক উন্নয়নের অনেক নেতিবাচক প্রভাব আছে। আমরা কর্মক্ষেত্রে যা চর্চা করি তার প্রভাবে প্রভাবিত হয় আমাদের ব্যক্তিজীবন। অনেকে দৈনিক ৮ থেকে ১২ ঘণ্টা কর্মক্ষেত্রে কাটায় আর সেসময় তারা যেসব আচরণগত বৈশিষ্ট্য চর্চা করে তা তাদের জীবনের অংশ হয়ে যায়। এই বৈশিষ্টগুলো ব্যক্তিজীবনে আমাদের ঘিরে থাকা মানুষগুলোকে নানান ভাবে প্রভাবিত করে।
এমন অভ্যস্ততা আমাদের খুব দ্রুতই জনবিচ্ছিন্ন এবং অনুভূতিহীন করে তোলে। বন্ধুদের খোঁজা এবং তাদের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নে আমরা ক্রমশ অনিচ্ছুক হয়ে উঠি। কেননা আমরা কর্মক্ষেত্রে রোজ এমন বিচ্ছিন্নতার চর্চা করি। আমরা পরস্পরকে বিশ্বাস করতে ভুলে যাই। কর্মক্ষেত্রের বাইরেও মনে হয় সবাই আমাকে টেনেহিঁচড়ে পেছনে নিয়ে যাবে!
![](https://youthcarnival.org/wp-content/uploads/2018/05/Work-Life-Balance.jpg)
শুধু কাজের প্রয়োজনে সম্পর্ক উন্নয়নের প্রবণতার কারণে আমাদের ব্যক্তি জীবনের বন্ধুত্বও কাঠখোট্টা লেনদেন সম্পর্কে রূপ নেয়। যার ফলে আমাদের সামাজিক মিথস্ক্রিয়া, বন্ধুত্ব এবং পারিবারিক সম্পর্ক ক্রমশ দুর্বল হতে শুরু করে। এমন আত্মকেন্দ্রিক আচরণের কারণে আমরা আপনজনদের সাথে কম বা সতর্কতা যোগাযোগ করি এবং নিজেদের ব্যক্তিগত তথ্য খুশিমনে কারো সাথে শেয়ার করতে চাই না। সবসময় মনে হয় আমাদের এই ব্যক্তিগত তথ্য হয়তো কখনো আমাদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হবে, যেমনটা আমাদের কর্ম ক্ষেত্রে হয়ে থাকে!
সব মিলিয়ে কর্মক্ষেত্রের বাইরেও আমাদের ব্যক্তিগত সম্পর্কগুলো ক্রমশ রুক্ষ হয়ে উঠছে। কারণ এই সম্পর্কগুলোর মধ্যে কোনো গভীরত্ব নেই।
আমি থেকে কীভাবে আমরায় রূপান্তরিত হওয়া যায়
এক্ষেত্রে সবচেয়ে আদর্শ ব্যবস্থা হলো কর্মক্ষেত্র এবং ব্যক্তিজীবন সম্পূর্ণ আলাদা রাখা। সবদিক থেকেই দুটোকে সম্পূর্ণ ভিন্ন অবস্থানে রাখা। সবসময় লক্ষ্য রাখতে হবে যে, কর্মক্ষেত্রের কোনো আচরণ যেন ব্যক্তিজীবনে কোনোভাবে প্রবেশ না করে। কর্মক্ষেত্রের বাইরে পরিবার, আত্মীয়স্বজন এবং বন্ধু-বান্ধব একটি আত্মতুষ্টির জায়গা, যেখানে আমরা নিরাপদ ও শান্তি অনুভব করতে পারি। একই সাথে মনে রাখা দরকার, কর্মক্ষেত্রের মতোই এই ব্যক্তিজীবনের সম্পর্কগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কর্মক্ষেত্রের বাইরে এই মানুষগুলোর সাথে আমাদের ভালো সময় কাটানো উচিত এবং মন খুলে সবকিছু শেয়ার করা উচিত। কেননা তারা কোনোভাবেই আমাদের ক্ষতি করার মতো কেউ না।
![](https://youthcarnival.org/wp-content/uploads/2018/05/m2w-blue.png)
কর্মক্ষেত্রের মতো ব্যক্তিজীবনেও আমাদের সবসময় বর্তমান থাকতে হবে, যেন আমদের ব্যক্তিগত সময় কর্মক্ষেত্রের জটিল সময় দ্বারা আছন্ন না হয়। এই প্রচেষ্টা আমাদের প্রতিযোগিতামূলক প্রবণতা থেকে সামান্য হলেও রেহাই দিবে। মনে রাখতে হবে, সহানুভূতি এবং আন্তরিকতা কোনোভাবেই দুর্বলতা নয়। এটা আমাদের মন প্রফুল্ল রাখতে ও সম্পর্ক উন্নয়ন করতে খুবই প্রয়োজনীয়।
সর্বোপরি, সামাজিক সমর্থন ও সহযোগিতা সুখী হতে, অস্বস্তি দূর করতে ও ভালো শারীরিক ও মানসিক অবস্থা বজায় রাখতে সবচেয়ে বেশি কার্যকরী। যেহেতু ইতিমধ্যে আমরা একটি প্রতিযোগিতামূলক ও প্রচণ্ড চাপের কর্ম পরিবেশের মধ্যে বসবাস করছি, তাই আপনজনদের পরস্পরকে খুব বেশি ভালোবাসা এবং বিশ্বাস করা প্রয়োজন এই দুঃসহ পরিস্থিতি থেকে ব্যক্তি জীবনকে রক্ষা করতে।
সুতরাং পারিবারিক আয়োজনে নিজেদের যথাযথ প্রকাশ এবং অংশগ্রহণই পরিবার ও বন্ধুদের আমাদের কর্মক্ষেত্রের কঠিন পরিস্থিতি সম্বন্ধে আরো বুঝতে ও আমাদের আরও ভালবাসতে সহযোগিতা করবে।
যুদ্ধ নয়, শান্তি চাই
হ্যাঁ, কর্মক্ষেত্রে আমাদের সতর্ক থাকার প্রয়োজন আছে। কারণ সবাই আমার আপন নয়। কেউ কেউ হয়তো সত্যি আমার ক্ষতি করার জন্য প্রস্তুত হয়ে আছে, আর সবার দিকে সতর্ক চোখ রাখাও সম্ভব না। তাই নিজের পরিবেশে নিজেকে সতর্ক রাখাই শ্রেয়। বাস্তবতা হলো বাধ্য হয়েই সবাই এমনটা করে। কিন্তু তাই বলে কি এই একই প্রবণতা সবখানেই প্রযোজ্য? আমরা যেহেতু কর্মক্ষেত্রে অধিক সতর্ক থাকি, তাই পরিবার এবং বন্ধুমহলে আমাদের ততটাই খোলা মনে থাকা উচিত। কেননা সুরক্ষার জায়গাতে আমরা তো একটুও কমতি করিনি, তাহলে সুখী থাকার জায়গাতে কেন সুরক্ষা টেনে আনবো?
![](https://youthcarnival.org/wp-content/uploads/2018/05/ideal-family.jpg)
বন্ধু এবং আত্মীয়-স্বজনের কাছে নিজেকে জাহির করার প্রয়োজন নেই, কাজের ক্ষেত্রে হয়তো যেমনটা প্রয়োজন হয়। আমরা চাইলেই ব্যক্তিজীবনে আমাদের ঘিরে থাকা মানুষগুলোর সাথে যতটা সম্ভব সাধারন, আন্তরিক, সহমর্মী এবং আপন হয়ে থাকতে পারি।
সুতরাং শেষ কথা হলো, আমাদের ব্যক্তি এবং কর্মজীবনের মধ্যে চমৎকার ভারসাম্য বজায় রাখার দক্ষতা অর্জন করতে হবে। কর্মজীবনে আমরা যতটা সতর্ক হবো ব্যক্তিজীবনে আমরা ততই সুখী হবো। তাহলে এই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে পরিবার, বন্ধুবান্ধব এবং আত্মীয়-স্বজনের সাথে সুখী জীবনযাপন করতে পারবো।