কর্মক্ষেত্রে শুধু কাজ করা আর মাস শেষে বেতন নিয়ে ফিরে আসাটা মূল উদ্দেশ্য নয়। বরং কর্ম ক্ষেত্রে নিজের সৃজনশীলতা সেই সাথে একটি আস্থাশীল অবস্থান গড়ে তোলার জন্য আপনার সহকর্মীর সাথে সুসম্পর্ক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। স্বাভাবিকভাবে যে জায়গাটায় আমরা প্রতিদিন কাজ করছি সেখানে যারা সহকর্মী আমাদের সহকর্মী, আমরা যদি তাদের সাথে একটি বন্ধুত্বসুলভ এবং সহায়তামূলক সম্পর্ক গড়ে না তুলি তাহলে কর্মক্ষেত্রটি আমাদের জন্য খুব দ্রুতই হতাশার একটি জায়গায় পরিণত হবে।
কেননা মানসিকভাবে আমরা সবসময়ই কারো না কারো শরণাপন্ন একই সাথে সহায়তা পেতে পছন্দ করি। আপনি একটি কাজে যতই দক্ষ হোন না কেন অপরের সাহায্য কোন না কোন ক্ষেত্রে আপনার প্রয়োজন পড়বে। শুধু তাই নয় আপনার সাহায্য প্রয়োজন হোক বা না হোক আপনি যদি কারও কাছ থেকে সাহায্য না পেয়ে থাকেন তাহলে অপরকে সাহায্য করার মানসিকতাও আপনার মাঝে গড়ে উঠবে না। আর তাই কর্মক্ষেত্রে শুধু কাজ নয় বরং কর্মীদের সাথে সুসম্পর্ক একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
সমাজে আমরা চলতে গেলে বিভিন্ন ধরনের মানুষের সাথে পরিচয় হই, সম্পর্ক স্থাপন করি। এদের মধ্যে কেউ আমাদের বন্ধু কেউ আমাদের আত্মীয় স্বজন অথবা কারো সাথে স্রেফ কাজের জন্য আমাদের পরিচয় হয় অথবা আমরা সম্পর্ক স্থাপন করি। বিভিন্ন শ্রেণীর সাথে আমাদের পরিচয়, এদের মাঝে মধ্যে যাদের সাথে কাজের জন্য এবং বিভিন্ন কারণে আমরা নেটওয়ার্ক স্থাপন করার জন্য আমাদের পরিচিত হয় তাদের সাথে সম্পর্ক তৈরী করা একই সাথে সম্পর্ককে চলমান রাখা কঠিন একটি বিষয়। কর্মক্ষেত্রে কাজের সুবাদে সহকর্মীর সাথে আমাদের বন্ধুত্বসুলভ সম্পর্ক স্থাপন হয়। মনোবিজ্ঞানের ভাষায় বিষয়টিকে মাল্টিপ্লেক্সিটি বলা হয়।
মাল্টিপ্লেক্সিটি হচ্ছে দুই ধরনের সামাজিক সম্পর্ক যখন দুটি মানুষের মাঝে স্থাপিত হয় তখন তাকে মাল্টিপ্লেক্সিটি বলে। অর্থাৎ একই সাথে আপনার সহকর্মীটি যখন আপনার বন্ধু আবার সেই সহকর্মীটি কিন্তু আপনার কর্মক্ষেত্রের একজন কলিগ। এই যে দুই ধরনের সামাজিক সম্পর্ক দুটি মানুষের মধ্যে স্থাপিত হয় তখন তাদের মাঝে কাজ এবং সম্পর্কের মাঝে সামঞ্জস্যতা বজায় রেখে চলতে হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কর্মক্ষেত্রে সহকর্মীদের সাথে আমাদের এই মাল্টিপ্লেক্সিটি সম্পর্ক গড়ে ওঠে।
বলা হয়ে থাকে, মাল্টিপ্লেক্সিটি সম্পর্ককে আরো বেশি গভীর করে তোলে এবং একই সাথে মানসিক ভরসার জায়গা গড়ে তোলে। আর তাই কর্মক্ষেত্রে আপনাকে শুধু কাজ করলে চলবে না একই সাথে সহকর্মীদের সাথে বন্ধুত্বসুলভ সম্পর্ক গড়ে তোলে মাল্টিপ্লেক্সিটি অর্জন করতে হবে। যখন আপনার সহকর্মী আপনার বন্ধু হবে তখন কর্মক্ষেত্রে আপনার জন্য অনেক বেশি আরামদায়ক এবং স্বস্তিকর পরিবেশ তৈরি হবে।
গবেষকরা জানিয়েছেন, মাল্টিপ্লেক্সিটি খুব দ্রুত দুটি মানুষের মাঝে বিশ্বাসের জায়গা তৈরি করে আর কাজেই সহকর্মীর সাথে ভাল সম্পর্ক তৈরি করার বিষয়টি কতটুকু গুরুত্বপূর্ণ তা আমরা সহজেই অনুধাবন করতে পারছি। কেননা গবেষকরা দীর্ঘদিন মাল্টিপ্লেক্সিটির পেছনে গবেষণা করে সময় কাটিয়েছেন আর তারা জানিয়েছেন, কর্মক্ষেত্রের যদি কর্মীদের সাথে মাল্টিপ্লেক্সিটির সম্পর্ক থাকে তাহলে একসাথে দক্ষতা এবং বিশ্বাস দুটি জায়গারই উন্নয়ন সাধিত হয়।
গবেষণায় জানা গেছে কর্ম ক্ষেত্রে তৈরি হওয়া বন্ধুত্ব আবেগের জায়গা থেকে বেশি কর্মক্ষেত্রের উপকারে আসে। কেননা কর্মক্ষেত্রের বন্ধু আপনাকে আরো বেশি কাজ করতে উদ্বুদ্ধ করবে, একই সাথে আপনার কাজের ভুলত্রুটিগুলো সম্পর্কে আপনাকে অবগত করবে। সেই সাথে আপনার কাজের দক্ষতা এবং উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পাবে।
নেদারল্যান্ডের গবেষকরা জানিয়েছেন, আপনি যে সংস্থায় কাজ করছেন সেখানে মাল্টিপ্লেক্সিটি নিঃসন্দেহে আপনার সংস্থা এবং একই সাথে আপনার ব্যক্তিগত মানসিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
আপনি যদি ভেবে থাকেন, কর্মক্ষেত্রের কারো সাথে সুসম্পর্ক বা বন্ধুসুলভ সম্পর্ক আপনার কাজের ক্ষেত্রে সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে বাআপনার মনোযোগ শুধুমাত্র কাজের দিকে রাখতে পারবেন না তাহলে আপনার ধারণাটি পুরোপুরি ভুল। কারণ গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে, সুসম্পর্ক শুধুমাত্র ভালোভাবে কাজ করার মানসিক শক্তি দিচ্ছে তা নয় মানসিক স্বস্তির জায়গা করে দিচ্ছে এবং একই সাথে আপনার কাজ করার উদ্যমতাও বৃদ্ধি করছে। কেননা আপনি যখন একটি বন্ধুসুলভ বা একটি স্বস্তিকর পরিবেশে থাকবেন তখন যেকোনো কাজের প্রতি আপনার মনোযোগ দ্বিগুণ বেড়ে যাবে।
যে জায়গাটিতে আপনি কারো সাথে মিশতে পারছেন না বা কারো সাথে আপনার বন্ধুসুলভ কোনো সম্পর্ক নেই সেখানে আপনি কোনোভাবেই মনোযোগ সহকারে কাজ করে যেতে পারবেন না। এছাড়াও আপনার চাকরিতে প্রমোশন বা কোন হুট করে ছুটির প্রয়োজন এরকম যেকোনো সময় আপনি আপনার কর্মক্ষেত্রের বন্ধুটির সাহায্য নিতে পারবেন। এছাড়া কর্মক্ষেত্রে নানান ধরনের সমস্যা এড়িয়ে যাওয়া বা কাজের সাহায্যর জন্য আপনার বন্ধুটি হতে পারে আপনার বিশ্বস্ত সহায়তাকারী।
ভবিষ্যতে কোথাও বা কোনো প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতে গেলে অবশ্যই মাথায় রাখবেন যে, কর্মক্ষেত্রে সকলের সাথে বন্ধুত্ব সুলভ আচরণ এবং সম্পর্ক নিঃসন্দেহে আপনাকে সফলতা এনে দেবে। এছাড়া আপনি যেখানে বর্তমানে কর্মরত আছেন সেখানে যদি আপনার সহকর্মীদের সাথে সুসম্পর্ক তৈরি না হয়ে থাকে তবে নতুন করে সহকর্মীদের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য কাজে লেগে পড়ুন। জেনে নিতে পারেন কিভাবে সহকর্মীদের সাথে সম্পর্ক উন্নয়ন করতে পারবেন।
১.তালিকা তৈরি করুন করুন
আপনার কর্মক্ষেত্রের একই সাথে কর্মরত এরকম দুই বা তিনজন সহকর্মীর তালিকা তৈরি করুন। যারা আপনার ব্যাপারে কিছুটা হলেও জানে আর আপনি যাদের সাথে কথা বলতে বা চলতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন তাদের নামের তালিকা তৈরি করুন।
আপনি ভাবতে পারেন তালিকা তৈরি করার কি প্রয়োজন আছে, আপনি তো তাদের সম্পর্কে অবগত। কিন্তু আপনার এই তালিকা তৈরি করার বিষয়টি আপনাকে তাদের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের ব্যাপারে আরও বেশি উদ্বুদ্ধ করবে। আর তাই আপনার কর্মক্ষেত্রের স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন এমন দুই বা তিন জন সহকর্মীর তালিকা তৈরি করুন।
২. সহকর্মীদের সাথে দেখা করুন
অফিস টাইমের বাইরে তাদের সাথে কোথাও খেতে বের হোন অথবা কোথাও ঘুরতে বের হোন। মাসের চার সপ্তাহের প্রতি সপ্তাহের যে কোন একদিন করে তাদের সাথে কোথাও ঘুরতে বা খেতে বের হোন। তাদের সাথে সময় কাটানোর উদ্দেশ্যই হবে আপনি তাদের কাছ থেকে নিত্যনতুন কিছু শিখতে চাচ্ছেন বা তাদের কাছে জানতে চান তাদের কাজ কেমন যাচ্ছে, তারা নতুন কী কাজ করছে। যেন তারা বুঝতে পারে আপনার তাদের সম্পর্কে জানার জন্য যথেষ্ট আগ্রহ রয়েছে।
আমরা সকলেই মানসিকভাবে তাদের সাথে কথা বলতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি যাদের কাছে কথা মতো আমাদের জায়গা তৈরি হয়। কাজেই আপনার কলিগ দেরকে কথা বলার জন্য জায়গা তৈরি করে দিন, তারা যেন স্বাচ্ছন্দে আপনার সাথে কথা বলতে পারে। নিত্য নতুন কিছু যেন আপনার সাথে শেয়ার করতে পারে সেদিকে খেয়াল রাখুন।
৩. প্রয়োজনীয় প্রশ্ন করুন
অফিসের বাইরে তাদের সাথে কাটানো সময় যখন আপনি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোচনা করবেন বা তারা আপনার কাছে কিছু শেয়ার করবে তখন খেয়াল রাখবেন প্রয়োজনীয় কিছু প্রশ্ন যেন তাদের কাছে করতে পারেন।
প্রয়োজনীয় প্রশ্ন ছুড়ে দেওয়ার মানে হচ্ছে আপনি তার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনেছেন এবং আপনি তার ব্যাপারে জানতে ইচ্ছুক। এই বিষয়টি আপনার সহকর্মীদের সাথে আপনার একটি মানসিক আরামদায়ক জায়গা তৈরি করে দেবে।
৪. মনে রাখবেন আপনার সহকর্মীই আপনার বন্ধু
যখনই সহকর্মীদের সাথে সুসম্পর্ক স্থাপন করবেন তখন খেয়াল রাখতে হবে সেই সাথে মনের ভিতর একটি সৎ উদ্দেশ্য রাখতে হবে যে, আপনি কোনো ব্যক্তিগত স্বার্থ বা ব্যক্তি সুযোগ সন্ধানের জন্য তাদের সাথে সম্পর্ক তৈরি করছেন না।
কারণ তারা আপনার বন্ধু কাজেই তাদের সাথে আপনার কোন ব্যক্তি স্বার্থবাদী বা সুযোগের কোন জায়গা নেই। বিশ্বাস স্থাপন করা জরুরী যখন আপনাদের মাঝে ভাল সম্পর্ক তৈরী হবে তখন আপনার বন্ধু বা সহকর্মী আপনার প্রয়োজনে আপনার পাশে এমনিই দাঁড়াবে।
৫. ধৈর্য হারাবেন না
এমন হতেই পারে প্রথম প্রথম আপনার সহকর্মীরা আপনার কাছে সব ধরনের কথা বা সমস্যা শেয়ার করতে ততটা স্বাচ্ছন্দ বোধ করবে না। কেননা প্রতিটি সম্পর্কই বিশ্বাসের উপর গড়ে উঠে। আপনাকে বিশ্বাস রাখতে হবে যে, আপনি যদি সঠিকভাবে আপনার সহকর্মীদের সাথে চলতে পারেন, ভালো আচরণ করেন, সেই সাথে সবসময় সৎ থাকতে পারেন আপনার সাথে সহকর্মীদের আস্থার জায়গা তৈরি হবেই।
আর তাই যেকোনো সম্পর্ক স্থাপনের ক্ষেত্রে শুরুতেই ধৈর্য হারাবেন না। কিছুটা সময় দিন সহকর্মীদের সাথে ভালো সময় কাটান দেখবেন আপনাদের মাঝে খুব দ্রুতই বন্ধুসুলভ সম্পর্ক তৈরি হয়ে গেছে।