অনেকের কালক্ষেপণ করার বদঅভ্যাস আছে। আমরা অযথাই কালক্ষেপণ করে সময় নষ্ট করি, এবং সময় চলে গেলে তার জন্য হা-হুতাশ করি। কোনো কাজ করার জন্য হাতে পর্যাপ্ত সময় থাকলে আমরা শুরুতে নানা অজুহাতে কালক্ষেপণ তথা সময় নষ্ট করি। মনে করি কাজটি করার জন্য যে সময় হাতে আছে তা পর্যাপ্ত। নিশ্চয়ই এই সময়ের মধ্যে সব ঠিকঠাক হয়ে যাবে। কিন্তু কালক্ষেপণ করতে করতে শেষ পর্যন্ত কাজটি আর ঠিকমতো করা হয় না।
২০১৫ সালে পরিচালিত এক জরিপ মতে, মানুষ প্রতিদিন ২১৮ মিনিট অকারণে নষ্ট করে, যা বছর শেষে হতাশাজনক ৫৫ দিনে রূপান্তরিত হয়। প্রতিবছর মানুষ এই ৫৫ দিন অযথা কালক্ষেপণ করে নষ্ট করে! সুখী, সুন্দর, এবং সফল জীবনের জন্য এই কালক্ষেপণ বন্ধ করতে হবে। নিজেকে আরও সচেতন করে তুলতে হবে এবং এই খারাপ অভ্যাস চিরতরে দূর করতে হবে।
আজকের নিবন্ধে আমি কালক্ষেপণের কয়েকটি উদাহরণ তুলে ধরবো এবং তা সমাধানের উপায় নিয়ে আলোচনা করবো। আমার বিশ্বাস এই নিবন্ধটি পড়ার পর আপনি আবিষ্কার করতে পারবেন নিজের অজান্তেই কালক্ষেপণ করে সময় নষ্ট করেন কিনা। এমনকি তার সমাধানের উপায়ও পেয়ে যাবেন।
পারফেকশনিস্ট
পারফেকশনিস্ট হচ্ছে সেই শ্রেণীর মানুষ যারা সবকিছু নিখুঁতভাবে করতে চায় এবং ছোটখাটো বিষয়ে বেশি মনোযোগ দেয়। আপনার চারপাশে নিশ্চয়ই এমন পারফেকশনিস্ট কাউকে পেয়ে যাবেন। এমনকি আপনার মধ্যেই এই বদঅভ্যাস লুকিয়ে থাকতে পারে।
এই শ্রেণীর মানুষ যেকোনো কাজ শুরু করতে ভয় পায় এবং কাজ শুরু করার আগে প্রয়োজনের অতিরিক্ত প্রস্তুতি নেয়। কেননা তারা চায় কাজটি সর্বাঙ্গিক সুন্দর করতে। এই সুন্দর করতে গিয়ে অপ্রয়োজনীয় অনেক গভীর বিষয়ে তারা অধিক সময় ব্যয় করেন। অর্থাৎ আসল কাজ ফেলে রেখে আনুষাঙ্গিক ছোট ছোট গভীর বিষয় নিয়ে বেশি মনোযোগী হয়ে পড়ে। এমনকি কোনো কাজ শুরু করার পর তারা মাঝপথে ভাল হচ্ছে না ভেবে আটকে যায়!
এই শ্রেণীর মানুষ কর্মক্ষেত্রে সফল হয় খুবই কম। তাছাড়া অধিক প্রস্তুতি নিয়ে একটি কাজ মনঃপূত ভাবে শেষ করতে তারা যে সময় ব্যয় করে এই একই সময়ে অন্য কেউ কয়েকগুণ বেশি কাজ করতে পারে। ফলে তাদের উৎপাদনশীলতা কমে যায়। সময় নিয়ন্ত্রণ করতে না পারায় এমনকি শেষ পর্যন্ত ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।
পারফেকশনিস্টদের প্রতি পরামর্শ
খুটিনাটি বিষয়ে গভীর মনোযোগ দেওয়ার পরিবর্তে সমগ্র বিষয়টি নিয়ে বেশি মনোযোগী হোন। ছোট ছোট বিষয়কে আলাদা ভাবে না দেখে সমগ্র কাজটি সামনে নিয়ে পরিকল্পনা স্থির করুন। সম্পূর্ণ কর্মযোগের উদ্দেশ্য সম্বন্ধে নিশ্চিত হোন। এবং কাজটি শেষ করার জন্য নিজেকে সময়সীমা বেঁধে দিন।
কোনোক্রমেই এই সময়সীমা অতিক্রম করবেন না। সব সময় ফোকাস করুণ কাজের উদ্দেশ্যের দিকে। আপনার উদ্দেশ্য পূর্ণ হলে কাজ চলাকালীন ছোটখাট বিষয়ে বিচ্যুতির কথা ভুলে যান। নিজেকে কাজ শেষ করার সময়সীমা বেঁধে দিলে আপনা থেকে এক ধরনের তাগিদ অনুভব করবেন, যা আপনাকে এই বদ অভ্যাস দূর করতে সহযোগিতা করবে।
মনে রাখবেন, জীবন কোনো হলিউড চলচ্চিত্র নয়। এখানে সবগুলো শর্ট পারফেক্ট হবে এমন কোনো কথা নেই। তাছাড়া যে সময়টা চলে যায় সেই সময়ে আবার ফিরে গিয়ে সবকিছু নিখুঁতভাবে করার সুযোগ থাকে না। সুতরাং ছোটখাটো বিচ্যুতি উপেক্ষা করে যেকোনো কাজের মূল উদ্দেশ্যের দিকে মনোযোগী হোন। খুঁটিনাটি বিষয়ে অধিক মনোযোগী হওয়া বন্ধ করুন।
উদাহরণস্বরূপ: ধরা যাক কোনো বিষয়ে আপনি একটি রিপোর্ট লিখতে চলেছেন। সুতরাং রিপোর্টের উদ্দেশ্য কি তা আগে নিশ্চিত হয়ে নিন।
এরপর রিপোর্ট লিখতে গিয়ে আপনি অসংখ্য তথ্য পাবেন, যা সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তিত হয়েছে। এমনকি বলার মতো অসংখ্য গল্প পাবেন। কিন্তু আপনি যদি বিভিন্ন সময় পরিবর্তন হওয়া তথ্য এবং ঘটনাপ্রবাহ রিপোর্টে উল্লেখ করতে চান তবে রিপোর্টের মূল উদ্দেশ্য ব্যাহত হবে।
সুতরাং রিপোর্ট লেখার সময় অধিক সৃজনশীল বাক্য লেখা বা অপ্রয়োজনীয় তথ্য উপস্থাপন করা বন্ধ করুন। সবসময় রিপোর্টের মূল উদ্দেশ্যের দিকে মনোযোগ রাখো রিপোর্টে যে চূড়ান্ত বিষয়বস্তু তুলে ধরতে চান শুধু সে সম্পর্কিত কথাগুলোই উল্লেখ করুন। যদিও এ সম্পর্কিত প্রতিটি গল্পই চমৎকার তবুও রিপোর্টে এই ঘটনা সম্পর্কিত সব গল্প উল্লেখ করার কোনো প্রয়োজন নেই।
অনুপ্রেরণা প্রত্যাশী
আমাদের সমাজে এক শ্রেণীর মানুষ আছে যারা অনুপ্রাণিত হতে পছন্দ করে। সফল মানুষদের সাথে সখ্যতা গড়ে তোলে। সবসময় ইতিবাচক চিন্তা করে, এবং সাফল্যের সর্বোচ্চ শিখরে আরোহণের স্বপ্ন দেখে। কিন্তু কাজ করে না!
এই শ্রেণীর মানুষ খুঁজে খুঁজে সব সফল মানুষের গল্প শোনে, বই পড়ে, অনলাইনে ভিডিও দেখে, অনুপ্রেরণামূলক সেমিনারে অংশ নেয়, কিন্তু নিজের জন্য নির্ধারিত কাজ সম্পূর্ণ করে না।
অনুপ্রেরণা প্রত্যাশীদের জন্য পরামর্শ
আপনি যদি একের পর এক অনুপ্রেরণা মূলক অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে থাকেন, কিন্তু অনুপ্রাণিত হয়ে এখনো নিজের কাজ শুরু করার মতো আত্মবিশ্বাস অর্জন করতে না পারেন, তবে জেনে রাখুন আপনি অনুপ্রাণিত হওয়ার রোগে ভুগছেন।
আপনার জন্য পরামর্শ হলো, অনুপ্রেরণা যথেষ্ট নেওয়া হয়েছে, এবার থামুন এবং কাজে যোগ দিন। হাজারটা সাফল্যের গল্প আপনার জীবনে কোনো কাজে আসবে না যদি কিনা আপনি কোনো সাফল্যের গল্প সৃষ্টি করতে না পারেন। সুতরাং অন্যদের সাফল্যের গল্প শোনা বন্ধ করে নিজেই সফল হওয়ার চেষ্টা করুন।
উদাহরণস্বরূপ: বর্তমান সময়ের জনপ্রিয় অনলাইন মাধ্যম ইউটিউবে আপনি ক্রমাগত মোটিভেশনাল ভিডিও, বক্তব্য শুনছেন। একের পর এক ভিডিও দেখছেন এবং অনুপ্রাণিত হচ্ছেন। এটা নিঃসন্দেহে একটি ভালো ঘটনা। কিন্তু একবারও কি ভেবে দেখেছেন ক্রমাগত অনুপ্রেরণার ভিডিও দেখতে দেখতে আপনি যে সময় নষ্ট করছেন এই সময়ের মূল্য কিভাবে নির্ধারণ করবেন?
সফল হওয়ার জন্য দৈনন্দিন কাজের চেয়ে অনুপ্রেরণা গ্রহণের সময় যদি বেশি হয়ে থাকে তবে আপনি শত অনুপ্রেরণা নিয়েও সবচেয়ে ব্যর্থ মানুষে পরিণত হবেন। সুতরাং আজই এই প্রবণতা ত্যাগ করুন, এবং অনুপ্রাণিত হওয়ার জন্য নিজেকে নির্দিষ্ট সময় বেঁধে দিন।
আপনি চাইলে এক দিনেই এই প্রবণতা দূর করতে পারবেন না। সুতরাং দৈনিক কর্মঘন্টা নির্ধারণ করুন, এবং নিজের কাজ সম্পন্ন করার পর অবসরে অনুপ্রেরণামূলক ভিডিও দেখুন। এভাবে কাজের মাত্রা বাড়ান এবং অনুপ্রাণিত হবার জন্য সেমিনার, ভিডিও দেখার মাত্রা কমান। এক সময় নিজের কাজ দিয়ে আপনি এতটা সফল হবেন যে অন্যরা আপনার সাফল্যের গল্প শুনে অনুপ্রাণিত হবে। সুতরাং সাফল্যের গল্প না শুনে নিজে গল্প হয়ে উঠুন।