যত দিন যাচ্ছে মানুষ সামাজিক হচ্ছে। মানুষে মানুষে সম্পর্ক বাড়ছে। পরস্পরের মধ্যে পূর্বের যে কোনো সময়ের চেয়ে অধিক যোগাযোগ হচ্ছে। এইসব কারণে মানুষ ক্রমশ অনেক বেশি উৎসব প্রিয়, উদযাপন প্রিয় হয়ে উঠছে।
বর্তমান সময়ে আমাদের দেশে পারিবারিকভাবে এমন অনেক ছোট ছোট অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়, ২০ বছর আগে যার কোনো অস্তিত্বই ছিল না। তেমনি বর্তমান সময়ে বড় উৎসব, কনসার্ট, অনুষ্ঠানের আয়োজন হচ্ছে পর্যাপ্ত। তাছাড়া জীবনমানের সার্বিক উন্নতি হওয়ার কারণে মানুষ পূর্বের তুলনায় অনেক বেশি সৃজনশীল ও শৌখিন হয়ে উঠেছে।
কাজেই এই সৃজনশীল, সৌখিন মানুষদের জন্য কোনো বড় অনুষ্ঠানের আয়োজন করলে তা নিয়ে ভাবতে হয় বিস্তর! আমি ইতিপূর্বে একটি নিবন্ধ বড় অনুষ্ঠান আয়োজনের পূর্বপ্রস্তুতি সম্বন্ধে আলোচনা করেছি। আজকের নিবন্ধ আলোচনা করবো অনুষ্ঠান আয়োজন করার পর কিভাবে সফলভাবে তা শেষ করা যায়, অর্থাৎ কোনো আয়োজিত অনুষ্ঠান সফল এবং সুশৃংখলভাবে শেষ করতে কী কী প্রস্তুতি রাখতে হবে। অনুষ্ঠান চলাকালীন কী কী করণীয় এসব বিষয়ে কিছু দরকারী পরামর্শ।
১. ছোট ছোট বিষয়ের দিকে নজর দিতে হবে
বড় অনুষ্ঠানে ছোট ছোট ভুল হয়, আরে ছোট ছোট ভুলগুলো অনুষ্ঠান চলাকালীন খুব খারাপ পরিস্থিতির জন্ম দেয়। সুতরাং কোনো ইভেন্ট আয়োজন করার পূর্বে খুব সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিষয়গুলো নিয়েও যথাযথ পরিকল্পনা করুন। আগত দর্শকদের প্রবেশ এবং প্রস্থান সুশৃংখল করতে মনোযোগী হোন। সাথে সাথে আমন্ত্রিত অতিথির নিরাপত্তা এবং সুন্দর আপ্যায়ন নিশ্চিত করুন।
২. নিজেকে সুস্থ রাখা
কোনো বড় অনুষ্ঠান একা আয়োজন করা যায় না। নিশ্চয়ই তার জন্য টিমওয়ার্কের প্রয়োজন হয়। কিন্তু বড় অনুষ্ঠান আয়োজন করতে সপ্তাহব্যাপী একটি টিম প্রচুর পরিশ্রম করে এবং অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় অনুষ্ঠানের দিন টিমের বেশিরভাগ সদস্য অসুস্থ বা ক্লান্ত হয়ে পড়ে!
সুতরাং এদিকে নজর রাখাও খুব জরুরি। শুধু অনুষ্ঠানের প্রস্তুতির কথা চিন্তা করে নিজেদের সুস্থতার কথা ভুলে গেলে চলবে না। সব প্রস্তুতি সুন্দর মতো শেষ করার পর শেষ মুহূর্তে এসে যদি আপনি অসুস্থ হয়ে পড়েন তবে পুরো আয়োজনটি ভন্ডুল হয়ে যেতে পারে। সুতরাং কাজ করার সাথে সাথে নিজের এবং টিমের সুস্থতার দিকেও নজর রাখুন।
৩. অনুষ্ঠান সূচনা
বড় কনসার্ট আয়োজন করলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে যথাসময়ে শুরু করা কঠিন হয়ে পড়ে। আধঘন্টা বা এক ঘন্টার কালক্ষেপণ হতে পারে। এই সময়টুকুর জন্যও আপনাকে প্রস্তুত থাকতে হবে। মনে রাখতে হবে, আপনার সামনে বিপুলসংখ্যক দর্শক-শ্রোতা অপেক্ষা করছে।
সুতরাং অনুষ্ঠান শুরুর পূর্বেই তারা যদি বিরক্ত হয়ে পড়ে তাহলে অনুষ্ঠান চলাকালীন তা খুব বেশি উপভোগ্য হয়ে উঠবে না। সুতরাং মূল অনুষ্ঠান শুরুর পূর্বের কালক্ষেপণের সময়টুকুও প্রাণবন্ত করে তোলার প্রস্তুতি রাখতে হবে। সাথে সাথে অনুষ্ঠানে কখন কী হচ্ছে তা যথাযথভাবে একজন দক্ষ এবং হাস্যোজ্জ্বল উপস্থাপকের দ্বারা উপস্থাপন করতে হবে।
৪. অনুষ্ঠানের ব্যাপ্তি
আপনার অনুষ্ঠান কত দীর্ঘ হবে তার উপর নির্ভর করে আপনার দর্শক কতটা আনন্দিত হবে। কোনো অনুষ্ঠান মোটামুটিভাবে তিন ঘণ্টার বেশি ব্যাপ্তির হওয়া উচিত না। এতে মানুষ ধৈর্য হারাতে পারে, আনন্দ বিরক্তিতে রূপ নিতে পারে। তাছাড়া অনুষ্ঠানের ব্যক্তির উপর নির্ভর করে আপনাকে অনুষ্ঠানসূচি নির্ধারণ করতে হবে।
সুতরাং অনুষ্ঠানের ব্যক্তি আগে থেকেই নির্ধারণ করে রাখা খুব গুরুত্বপূর্ণ। তবে অনুষ্ঠান খুব বেশি প্রাণবন্ত হলে দর্শকের আগ্রহ ব্যাপ্তি দীর্ঘ হতে পারে, আপনাকে এই বিষয়টি মাথায় রেখে পরিকল্পনা করতে হবে। সম্পূর্ণ অনুষ্ঠানের সময়কে আলাদা আলাদাভাবে ভেঙে পরিকল্পনা করুন। তাহলে সম্পূর্ণ অনুষ্ঠানটি প্রানবন্ত করে তোলা সহজ হবে।
৫. চুক্তি এবং অনুমতি
অনুষ্ঠান শুরুর পূর্বেই আপনাকে নিশ্চিত করতে হবে, যে স্থানে অনুষ্ঠান করছেন সেই স্থানের নিয়ন্ত্রণকারী বা মালিকের সাথে আপনার একটি চুক্তি হয়েছে এবং যাদের অনুষ্ঠানে এনেছেন তাদের সাথেও অনুরূপ একটি চুক্তি হয়েছে। কেননা অনুষ্ঠান চলাকালীন যেকোনো সময় যেকোনো ধরনের মতপার্থক্য সৃষ্টি হতে পারে। কাজেই এ ব্যাপারে আপনাকে আগে থেকে প্রস্তুত থাকতে হবে।
সাথে সাথে স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনের কাছ থেকে লিখিত অনুমতি নিতে হবে। কোনোক্রমেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে অবহিত না করে কোনো বড় অনুষ্ঠান আয়োজনের ঝুঁকি নিবেন না। এতে আপনি অপরাধী হিসেবে সাব্যস্ত হয়ে গ্রেপ্তারও হতে পারেন। তাছাড়া সম্পূর্ণ অনুষ্ঠান এবং আমন্ত্রিত অতিথিদের নিরাপত্তার স্বার্থে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহযোগিতা আপনাকে নিতেই হবে।
৬. দর্শক সমাগম কম হলে করণীয়
এমন অনেক অনুষ্ঠান থাকে যেখানে দর্শকদের উপস্থিত হতে বিশেষ কোনো টিকেট সংগ্রহ বা অর্থ পরিশোধের প্রয়োজন হয় না। বিনামূল্যে যেকেউ আসতে পারে। এমন অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে আপনি আগে থেকে নিশ্চিত হতে পারবেন না ঠিক কত সংখ্যক দর্শক আপনার অনুষ্ঠানে আসবে।
সুতরাং আপনার অনুষ্ঠানের সাফল্যের ব্যাপারে শতভাগ নিশ্চিত থাকাও এক ধরনের বোকামি! হতে পারে আপনার অনুষ্ঠানে কাঙ্ক্ষিত দর্শক সমাগম হয়নি! তাহলে কী করবেন? কাঙ্ক্ষিত দর্শক সমাগম না হলে কী করণীয় তা আগে থেকে নির্ধারণ করে রাখতে হবে অথবা বিকল্প কী পন্থা অবলম্বন করতে পারেন তারও যথাযথ পরিকল্পনা করে রাখতে হবে।
৭. সম্পর্কিত প্রস্তুতি
কোনো বড় অনুষ্ঠান আয়োজন করার সাথে সাথে ভালো কোনো আবাসিক হোটেলও ভাড়া করতে হয়। আবার আমন্ত্রিত অতিথিদের হোটেল থেকে অনুষ্ঠানস্থলে নিয়ে আসতে গাড়ির প্রয়োজন হয়। সুতরাং কোনো বড় অনুষ্ঠান আয়োজনের ক্ষেত্রে শুধুমাত্র অনুষ্ঠানস্থলের কথা চিন্তা করলে হবে না অনুষ্ঠান সম্পর্কিত অন্যান্য বিষয়গুলোতেও সমান গুরুত্ব দিতে হবে।
৮. আপদকালীন কর্মী
সব আয়োজন সম্পন্ন করার পরও অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার পর দেখা যাবে ছোট্ট কোনো ভুল হয়ে গেছে, অথবা কোনো একটি জিনিসের ঘাটতি পড়েছে। এই সমস্যা সমাধানে আপদকালীন কর্মী প্রস্তুত রাখতে হবে, যারা যেকোনো মুহূর্তে যেকোনো সমস্যা সমাধানে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারেন।
সাধারণ দর্শকের চোখে একটা অনুষ্ঠান যতটা দৃষ্টিনন্দন দেখায় আয়োজকদের কাছে কাজটি ঠিক ততটাই কঠিন এবং জটিল। সুতরাং কোনো বড় অনুষ্ঠান আয়োজন করতে হলে এই সবগুলো বিষয় আপনাকে নজরে রাখতে হবে। কিন্তু এতগুলো কাজ একসাথে একা করা সম্ভব না। এর জন্য প্রয়োজন একটি দক্ষ এবং নিবেদিতপ্রাণ দল। দলগতভাবে পরিকল্পনামাফিক কাজ করতে পারলে যেকোনো বড় অনুষ্ঠানই সফল করে তোলা সম্ভব।