সকল প্রকার জাগতিক, মহাজাগতিক সম্পদ এবং প্রাকৃতিক সম্পদের সঠিক পরিচর্যা করার দায়িত্ব আমাদের। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় যে, পরিবেশের অধিকাংশ ক্ষতি আমাদের হাতেই সাধিত হয়। এক গবেষণায় দেখা গেছে যে, অন্যান্য সকল প্রজাতির প্রাণী থেকে মানবজাতিই পরিবেশের অধিক ক্ষতি সাধন করে থাকে। বর্তমানে ‘দূষণ’ একটি বৈশ্বিক আলোচনার বিষয়। তৎক্ষণাৎ ভাবে আমরা এর প্রভাব সম্পর্কে না বুঝতে পারলেও এর সূদুরপ্রসারী প্রভাব সম্পর্কে আমরা সকলেই অবহিত। এর কারণে শুধু কতিপয় দেশ নয় বরং পুরা বিশ্বের ক্ষতি হতে চলেছে।
অনেকের ধারণা, কেবল মাত্র নিজের ঘর কিংবা বাসা-বাড়ি পরিষ্কার রাখলেই হয়ত দূষণ এড়ানো সম্ভব। কিন্তু এক্ষেত্রে ব্যক্তি পর্যায়ে কাজ না করে দলগত ভাবে অংশগ্রহণ করলে অধিক ফলপ্রসূ হবে। আমাদের দৈনন্দিন অভ্যাস সমষ্টিগত সমস্যার বৃদ্ধিতে বেশ অবদান রাখে। জেনে বা না জেনে আমরা প্রতিদিন এমন অসংখ্য বস্তু ব্যবহার করে থাকি যেগুলো আমাদের পরিবেশের উপর বিরুপ প্রভাব ফেলে। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত এরকম একটি দুইটি বস্তু আপাতদৃষ্টিতে তেমন ক্ষতিকর না হলেও সামগ্রিক ভাবে এগুলোর বিরূপ প্রভাব অনেক বেশি।
১. কফির কাপ
প্রতিদিন সকালে অফিসে যাওয়ার পর থেকে ঘুমাতে যাওয়ার আগ পর্যন্ত কর্মব্যস্ত মানুষের নিত্যসঙ্গী হলো কফি। বাসায় যেমন নিজের মগে কফি খাওয়ার সু্যোগ থাকে, কর্মক্ষেত্রে গেলে সেখানে কফি মেশিনের সাথেই এক ধরণের কাপ পাওয়া যায় যাদের ‘কে-কাপ’ বলা হয়। এই কাপ প্লাস্টিকের একটি ছোট কন্টেইনার যার উপরে একটি ফয়েল পেপার থাকে কফি ঢেকে রাখার জন্য। এই কাপগুলোর উপযোগিতা কফি খাওয়া পর্যন্ত থাকে এবং অসাবধানতাবশত কফি খাওয়া শেষে আমরা এগুলো যেখানে সেখানে ফেলে দেই। এই প্লাস্টিক, ফয়েলপেপারকে পুনরায় ব্যবহার করা যায় কিন্তু তা পরিমাণে খুব কম হয়ে থাকে। তাছাড়া পরিবেশের সাথে কিংবা মাটিতে এগুলো মিশে যেতে পারে না যার জন্য এগুলোর দ্বারা জৈবিক বিক্রিয়ায় অংশ নেয়াও সম্ভব হয় না। ফলে পরিবেশ দূষিত হয়।
২. স্ট্র
এরপর তালিকায় রয়েছে জুস, পানীয় খাওয়ার স্ট্র। স্ট্র হচ্ছে প্লাস্টিকের তৈরি ফাঁপা নলাকার পাইপ। সাধারণত দোকানগুলোতে জুস, পানীয় কিনলে সাথে দেয় এবং আমরাও খাওয়ার পর প্যাকেটের সাথে এই প্লাস্টিকের জিনিসটি ফেলে দেই এর ক্ষতিকর প্রভাব না জেনেই। পরিবেশে প্লাস্টিকের বন্যার ফলে বন্যপ্রাণী ও মানুষের বাসস্থানকে বিপর্যস্ত করছে। এর বিস্তৃত ব্যবহার আমাদের ভূমি ও পানি দূষিত করছে। যেহেতু এটি অবনতির লক্ষণ, এর ব্যবহার প্রতিরোধ করার একটি প্রচেষ্টা তৈরি করতে হবে।
৩. পানির বোতল
আমরা প্রতিদিন যে পানির বোতলগুলো ব্যবহার করে থাকি সেসব পানির বোতল পরিবেশের জন্য হুমকি স্বরুপ। যদিও এসব ব্যবহার যোগ্য, তারপরও পরিবেশের কথা চিন্তা করে এর ব্যবহার কমানো উচিত। প্রতি মিনিটে প্রায় এক মিলিয়ন পানির প্লাস্টিক বোতল ব্যবহার করা হয়। এ কারণে বিজ্ঞানীরা এসব প্লাস্টিকের ডিকম্পোজেবল বোতলের ব্যবহারের নির্দেশ দিয়েছেন।
৪. পলিথিন ব্যাগ
বাজার করার কাজে আমরা যে পলিথিনের ব্যাগ ব্যবহার করে থাকি, সেটি পরিবেশের জন্য এক বিশাল হুমকি। মাটি দূষণের সাথে সাথে এসব পলিথিন ড্রেনে আটকে পড়ে পানি নিষ্কাশনে ব্যাঘাত ঘটায়। যেহেতু পলিথিন কোনোরকম বিক্রিয়ায় অংশ নিতে পারে না এবং ফেলে দেয়ার পর ও একই অবস্থায় থাকে এজন্য এরা মাটি দূষণের জন্যও দায়ী। ইতোমধ্যে আমাদের দেশে ২০০২ সালের দিকে এই পলিথিনের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু হয় এবং এর প্রচলন বন্ধ করে দেওয়া হয়। তবে সঠিক আইনের অভাবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে এখনো এর ব্যবহার দেখা যায়। এর পরিবর্তে পরিবেশ বান্ধব চট বা পাটের ব্যাগ, কাপড়ের ব্যাগ ব্যবহার প্রশংসনীয়।
৫. ব্যাটারি
আমরা বিভিন্ন ইলেক্ট্রনিক্স জিনিসের জন্য যে ব্যাটারি ব্যবহার করে থাকি সেগুলোর মধ্যে বিভিন্ন রকমের এসিড এবং রাসায়নিক পদার্থ থাকে যা পরিবেশের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। এসব ব্যাটারি পুরাতন এবং অকেজো হয়ে গেলে এদের আমরা ফেলে দেই এবং এদের মধ্য থেকে সেই পদার্থ সমূহ নিঃসৃত হয় যা একাধারে মাটি এবং পরিবেশ উভয়ের জন্য ক্ষতিকর।
৬. বিদ্যুৎ
আমাদের মধ্যে অনেকেরই অভ্যাস আছে বাসায় অনবরত বিদ্যুৎ ব্যবহার করার। কাজের প্রয়োজন শেষ হয়ে গেলেও সুইচ অন করে রেখে দেই। যে হারে পৃথিবীতে জনসংখ্যা বেড়ে চলেছে এতে বাড়তি জনবলের জন্য বাড়তি শক্তিও প্রয়োজন। কিন্তু এভাবে ব্যবহার করতে থাকলে অচিরেই তা নিঃশেষ হয়ে যাবে।
৭. কীটনাশক
বাড়ির সামনে লন, বাগান, খেত খামারে যে কীটনাশক ব্যবহার করা হয় এগুলাও পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করে।
৮. নগরায়ণ-শিল্পায়ণ
অধিক জনসংখ্যার চাপ সামলানোর জন্য বাড়তি জায়গা এবং নগরায়ণ-শিল্পায়ণের জন্য নির্বিচারে গাছ কেটে ফেলা হচ্ছে। এতে একদিকে যেমন মাটিক্ষয় বেড়ে যাচ্ছে অন্যদিকে প্রাকৃতিক পরিবেশের ও ক্ষতি সাধিত হচ্ছে। বন্যা, ভূমিকম্প সহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ বেড়েই চলেছে এবং এতে জানমালের ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে।
৯. অনবায়নযোগ্য শক্তির অপব্যবহার
আমরা সবাই অধিক হারে বিদ্যুৎ এবং আনুষঙ্গিক কাজে বিভিন্ন শক্তি ব্যবহার করি যা অনবায়নযোগ্য। এক্ষেত্রে এদের নিঃশেষ কিংবা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য পর্যাপ্ত শক্তি না থাকার একটি সম্ভাবনা রয়েছে। তাই সৌর শক্তির উপর নির্ভরতা বাড়ানো এবং সঠিক পদ্ধতিতে তা ব্যবহারের পরামর্শ দেয়া হচ্ছে।
১০. পানি দূষণ
কলকারখানা থেকে বর্জ্য পদার্থ, সামুদ্রিক জলযান থেকে নিঃসৃত তেল- এসব পদার্থ ক্রমাগত পানি দূষণের জন্য দায়ী।
পরিবেশের অন্যতম প্রধান উপাদান হলো মাটি ,পানি ,বায়ু ইত্যাদি। অতিরিক্ত এবং অসচেতনভাবে ব্যবহারের ফলে একদিকে যেমন ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য হুমকি হয়ে যাচ্ছে তেমনি পরিবেশের উপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে। ফলে বৈশ্বিক উষ্ণায়ণ সহ আরো অনেক উপর্যুপরি ক্ষতি সাধিত হচ্ছে।