অ্যালান টুরিং। যার মৃত্যুর ছয় দশকেরও বেশি সময় অতিবাহিত হওয়ার পরও মানুষ তার জীবনী সম্পর্কে জানতে ইচ্ছাপোষণ করে। এমনকি সেই মানুষগুলোও তার জীবন সম্পর্কে জানতে চান যাদের কম্পিউটার বিজ্ঞানের প্রতি বিন্দুমাত্র আকর্ষণও নেই। অ্যালান টুরিং বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সিনেমা, উপন্যাস এবং মিউজিক অ্যালবামে উঠে এসেছেন। অ্যালান টুরিংয়ের জীবনী নিয়ে নির্মিত বেনেডিক্ট কাম্বারব্যাচ অভিনীত দ্য ইমিটেশন গেম
মুভিটি ৮টি ক্যাটাগরিতে অস্কার লাভ করে। কিন্তু বাস্তব জীবনে তিনি কেমন ছিলেন? চলুন জেনে নিই তার সম্পর্কে ১৫টি তথ্য যিনি ১৯১২ সালের ২৩ জুন জন্ম নিয়েছিলেন।
১. আধুনিক কম্পিউটার বিজ্ঞানের জনক
টুরিং মূলত কম্পিউটার মেমরির ধারনা দিতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। ১৯৩৬ সালে তিনি ‘অন কম্পিউটেবল নাম্বারস’ নামে একটি চূড়ান্ত প্রতিবেদন তৈরি করেন যা দৈনিক ওয়াশিংটনে; ‘দ্যা ফাউন্ডিং ডকুমেন্ট অব দ্যা কম্পিউটার এজ’ নামে প্রকাশিত হয়। একটি দার্শনিক নিবন্ধে তিনি এমনটা রচনা করেন যে আমরা একদিন এমন ধরনের যন্ত্র আবিষ্কার করতে সক্ষম হব যা মানুষের মতো যে কোনো ধরনের গানিতিক সমস্যা সমাধান করতে পারবে শুধুমাত্র ০ এবং ১ ব্যবহার করে।
টুরিং একটি যন্ত্র উদ্ভাবন করেছিলেন ‘টুরিং মেশিন’ নামে পরিচিত ছিল। এটি শুধুমাত্র একক গানিতিক সমস্যাগুলো সমাধান করতে পারতো। তিনি এমন একটি সার্বজনীন কম্পিউটারের কথা ভাবছিলেন যার মেমরিতে শক্তিশালী নির্দেশনামূলক কিছু কোড থাকবে এবং সেই কোডগুলোর মাধ্যমে যেকোনো ধরনের জটিল গাণিতিক সমস্যাগুলো সমাধান করা যাবে। টুরিং কম্পিউটার মেমোরিকে আরো শক্তিশালী করতে এবং সহজে বহনযোগ্য যন্ত্রের সম্পর্কে ধারণা দিয়েছিলেন যা পরবর্তীতে আধুনিক কম্পিউটারের রূপ নেয়।
১৯৪৫ সালে তিনি একটি স্বয়ংক্রিয় গণনা যন্ত্রের আবিষ্কার করেন যেটি ছিল প্রথম প্রোগ্রাম সম্বলিত আধুনিক কম্পিউটার। এর আগের কম্পিউটার গুলোতে বৈদ্যুতিক মেমোরি সংরক্ষণের ব্যবস্থা ছিল না এবং প্রত্যেকটি প্রোগাম আলাদা আলাদা ভাবে চালু করতে হত।
২. দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জয়লাভে অবদান
১৯৩৯ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় টুরিং ব্রিটেনের ব্লেচলি পার্কে একটি গোপন হেডকোয়ার্টারে গুপ্তসংকেত সমাধানের জন্য কাজ করতে শুরু করেন। একটি মত অনুযায়ী, যুদ্ধ তাড়াতাড়ি শেষ করার জন্য তিনি দুইবছর এখানে কাজ করেছিলেন। এর ফলে লক্ষ লক্ষ মানুষের প্রাণ বেঁচে যায়। তিনি বোম্ব
নামের একটি গুপ্তসংকেত ভাঙার যন্ত্র নিয়ে কাজে নেমে পড়েন। এই যন্ত্রের সাহায্যে তিনি যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ব্রিটিশদের বিপক্ষে তৈরি করা ২০০টি গুপ্তসংকেত পাঠোদ্ধার করেন। তার সবচেয়ে বড় অর্জন হচ্ছে জার্মান আর্মিদের ‘এনিগমা’ নামক একটি ডিভাইস অকেজো করে দেয়া।
এর মাধ্যমে জার্মান আর্মিরা তাদের গুপ্তসংকেত পাঠোদ্ধার করতো। ডিভাইসটি অকেজো করা মোটামুটি অসম্ভব ছিল কেননা জার্মানরা প্রতিদিন এর কোড পরিবর্তন করতো। ১৯৪১ সালে টুরিং এই অসাধ্য সাধন করেন। ১৯৪২ সালে তিনি আমেরিকাতে যান এবং গুপ্তসংকেত ভাঙতে তাদের সাহায্য করেন।
৩. প্রধানমন্ত্রী চার্চিলের নিকট সরাসরি চিঠি না লেখার নিয়ম ভঙ্গ করেন টুরিং
পর্যাপ্ত পরিমাণ সাহায্যের অভাবে ব্লেচলি পার্কের অপারেশন ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে পড়ে। নানা অজুহাতে সরকারও পিঁছু হটতে শুরু করে। অবশেষে টুরিং ও তার সহকর্মী যারা ব্লেচলি পার্কে কাজ করতো তারা মিলে প্রধানমন্ত্রী উইনস্টোন চার্চিলের নিকট একটি চিঠি লেখেন। এই অপারেশনের সাথে জড়িত এক কর্মীর মাধ্যমে ১৯৪১ সালের অক্টোবরে চিঠিটি সরাসরি চার্চিলের হাতে পৌঁছায়। এই চিঠি পাওয়ার পর চার্চিল তার বাহিনীর প্রধানকে বলেন যে ব্লেচলি পার্কের প্রকল্পের জন্য তাদের যা যা দরকার সেগুলোকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে এবং বিষয়টি নিশ্চিত করে একটি রিপোর্ট করতে।
৪. কিছু অদ্ভুত অভ্যাস
অনেক জিনিয়াসের মতো টুরিংও খামখেয়ালীপনার ঊর্ধ্বে ছিলেন না। তিনি সাইকেল চালানোর সময় তার অ্যালার্জির সাথে সংগ্রাম করতে গ্যাস মাস্ক পরতেন। আবার তিনি তার সাইকেলের নষ্ট চেইন ঠিক করতেন একটু অন্য ভাবে। তিনি খুুব ভালোভাবে বুুঝেছিলেন যে একটা নির্দিষ্ট সময় পর পর চেইনটি পড়ছে। এরপর থেকে তিনি চেইন পরার আগেই সাইকেল থেকে নেমে চেইন ঠিক করতেন। তিনি তার চায়ের মগটি রেডিয়েটার দিয়ে পেঁচিয়ে রাখতেন যেন অন্য কেউ তার মগটি ব্যবহার না করে। এ কাজের জন্য তিনি ব্লেচলি পার্কের সকলের কাছে পরিচিত ছিলেন।
৫. স্কুলের প্রথমদিনে ৬০ মাইল সাইকেল চালিয়ে আসা
যদিও তাকে গড় ছাত্র হিসেবে বিবেচনা করা হতো, তবুও তিনি স্কুলে গমনের জন্য অনেক কষ্ট করেছেন। সাধারন ধর্মঘটের কারনে রেল বন্ধ থাকায় প্রথমদিন স্কুলে পৌঁছানোর জন্য তিনি ৬০ মাইলের মতো সাইকেল চালিয়েছিলেন। তখন তার বয়স ছিল মাত্র ১৪ বছর!
৬. অলিম্পিকে পদক লাভের চেষ্টা
টুরিং যখন স্কুলে পড়তেন তখন থেকেই দৌড়ানো শুরু করেন। যখন তিনি কিংস কলেজের ফেলো ছিলেন তখন প্রতিদিন কেমব্রিজ এবং এলীর মাঝে ৩১ মাইল দৌড়াতেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মাঝে মাঝে তিনি বিভিন্ন মিটিংয়ের জন্য ব্লেচলি পার্ক থেকে ৪০ মাইল দৌড়িয়ে লন্ডনে আসতেন।তিনি একজন অলিম্পিক অ্যাথলেট হয়েই উঠিছেলেন প্রায়।
১৯৪৮ সালের অলিম্পিকে কোয়ালিফাইং ম্যরাথনে তিনি পঞ্চম স্থান অধিকার করেছিলেন। ২ ঘন্টা ৪৬ মিনিটে তিনি ম্যারাথনটি শেষ করেছিলেন যা ছিল ১৯৪৮ সালের অলিম্পিক ম্যারাথন বিজয়ীর থেকে ১১ মিনিট বেশি। পরবর্তীতে পায়ে আঘাত পাওয়ার কারনে তার অ্যাথলেট হওয়ার স্বপ্ন শেষ হয়ে যায়।
৭. সমকামিতার অপরাধে তিনি দোষী সাব্যস্ত হন
১৯৫২ সালে তার বাড়িতে চুরির অভিযোগে তিনি পুলিশের কাছে একটি রিপোর্ট লেখান। কিন্তু পরে তিনি নিজেই গ্রেফতার হন। অনুসন্ধানের সময় পুলিশ আবিষ্কার করে যে আর্নল্ড মারে নামের এক ব্যক্তির সাথে টুরিংয়ের সম্পর্ক আছে। তখনকার সময়ে ইংল্যান্ডে সমকাম অবৈধ ছিল। এই কারনে তাকে বন্দি করা হয়।পরে তিনি তার আইনজীবীর উপদেশে নিজের দোষ স্বীকার করে নেন। যদিও তিনি ছিলেন নির্দোষ।
৮. সরকারের ভুল বুঝতে পারা
২০০৯ সালে ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী গর্ডন ব্রাউন ব্রিটিশ সরকারের নিকট একটি জনসমর্থন পেশ করেন যে কারনে টুরিং সাজা পেয়েছিলেন। ব্রাউন বলেন , “এটি সত্যিই দুঃখজনক যে অ্যালান টুরিং এর মতো একজন মানুষ এই সমকামিতার আইনের কারনে সাজা পেয়েছিলেন”।
পরবর্তীতে ব্রিটিশ সরকার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে টুরিংয়ের অবদানের কথা বিবেচনা করে অনুতপ্ত হন এবং টুরিংয়ের নিকট ক্ষমাপ্রার্থী হন।পরবর্তীতে ২০১৩ সালে ইংল্যান্ডের রাণী অনুমতি দিলে সমকামিতার আইন বাতিল হয়ে যায় এবং টুরিংয়ের নামে লেগে থাকা বদনামও ঘুঁচে যায়।
৯. আইন প্রণয়ন
উনিশ শতকে এই সমকামিতার অপরাধে সাজা পাওয়া অপরাধীদের মধ্যে অ্যালান ছিলেন অন্যতম। ১৯৬৭ সালে ইংল্যান্ডে সমকামিতার আইন বাতিল হয়ে যায়। পরবর্তীতে ২০১৭ সালে এসে টুরিং এর নামে সমকামিতার আইন কার্যকর হয়। এই আইনের ফলে বহু মানুষ এখন স্বাধীনভাবে জীবনযাপনে সক্ষম হয়েছে।
১০. আত্মহত্যা
অ্যালান টুরিংয়ের মৃত্যুকে ঘিরে এখন পর্যন্ত কিছু রহস্য রয়ে গেছে। ৪১ বছর বয়সে তিনি মারা যান। মৃত্যুর পর তার শরীরে সায়ানাইড বিষ পাওয়া যায়। অনেকে মনে করেন তিনি এই সায়ানাইড গ্রহণের মাধ্যমে আত্মহত্যা করেছেন। টুরিংয়ের জীবন তখন ঊত্থান-পতনের মাঝে চলছিল। তিনি তার চাকরি হারিয়েছিলেন।
কোর্টের ভাষ্যমতে, টুরিং সমকামিতা ছাড়ার জন্য হরমোন গ্রহন করতেন। এরফলে তার স্তন বৃদ্ধি পেতে শুরু করে এবং ধীরে ধীরে তিনি নপুংসকে পরিবর্তিত হতে শুরু করেন। এর ফলে তিনি আত্মহত্যা করেন। ২০১২ সালে জ্যাক কোপল্যান্ড নামক এক অধ্যাপক টুরিংয়ের মৃত্যু সম্পর্কে বিবৃতি দেন যে, ১৯৫৪ সালে পাওয়া সামান্য কিছু নজিরের মাধ্যমে বর্তমান যুগে কখনোই এটা প্রমান হতে পারে না যে টুরিং আত্মহত্যা করেছিলেন। তার পাশে পড়ে থাকা অর্ধেক খাওয়া আপেল হতে পারে বিষের উৎস। তবে কখনোই সেটা সায়ানাইডের জন্য পরিক্ষিত হয়নি।
তার মায়ের মতে, টুরিং দুর্ভাগ্যবশত বিষ দ্বারা আক্রান্ত হয়েছিলেন যখন তিনি তার বাড়ির ল্যাবরেটরিতে কাজ করছিলেন। কেননা টুরিং রাসায়নিক পদার্থ গুলোকে শনাক্ত করতে সেগুলোর স্বাদ গ্রহণ করতেন। হয়তো এভাবেই টুরিং অসচেতনতাবশত সায়ানাইড গ্রহণ করে ফেলেছিলেন। এক লেখকের মতে, টুরিং এর কাছে আমেরিকার কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ছিল যা অন্য কেউ জানতে পারলে আমরিকা ধ্বংস হয়ে যেতে পারতো। একারনে এফবিআই দ্বারা তাকে খুন করানো হয়।
১১. টুরিংয়ের সম্পূর্ণ কাজের কথা তিনি বেঁচে থাকাকালীন প্রকাশ পায়নি
তার সমসাময়িক সময়ে তিনি একজন খ্যাতিমান গনিতবিদ হিসেবে সকলের কাছে পরিচিত ছিলেন।তবে সারাবিশ্বের মানুষ তখন তার অবদানগুলোর কথা জানতো না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ‘এনিগমা মেশিন’ নিয়ে যে তিনিই কাজ করেছিলেন এই খবরটি তার মৃত্যুর পর সকলের কাছে পৌঁছায়।
তার জীবদ্দশায় সবাই তাকে একজন গনিতবিদ হিসেবেই জানতো। ১৯৭০ সালের আগ পর্যন্তও এই বিষয়টি সকলের অগোচরে ছিল যে তিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় কাজ করেছিলেন।২০১৩ সালে প্রকাশ পায় তিনি কোন কৌশল অবলম্বন করে এনিগমা ডিভাইসটি নষ্ট করেছিলেন।
১২. কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বিচারে টুরিং টেস্ট
১৯৫০ সালে তিনি একটি ধারনার উন্নতি সাধন করেন। ধারনাটি এমন ছিল যে কিভাবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা পরিমাপ করা যায়। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা পরিমাপের এই পরীক্ষা টুরিং টেস্ট নামে পরিচিত।তিনি এমন একটি পরীক্ষা করেছিলেন যার মাধ্যমে কোনো মেশিন কোনো মানুষের চিন্তা-ভাবনা, চাল-চলন অনুকরণ করতে পারবে ও বুঝতে পারবে।
১৩. পুরাতন পদ্ধতি
প্রযুক্তির উন্নতির সাথে সাথে অনেকে মনে করে যে টুরিং টেস্ট কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা পরিমাপের জন্য যথেষ্ট নয়। তারা ভাবে যে বর্তমানে প্রযুক্তি যেভাবে অগ্রসর হচ্ছে তার পরিমাপ করা টুরিং টেস্টের পক্ষে সম্ভব নয়।
১৪. সর্বপ্রথম কম্পিউটারে দাবা খেলার প্রোগাম তৈরি
ব্লেচলি পার্কে কাজ করার সময় একজন দাবা খেলোয়াড়ের কাছ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি একটি অ্যালগারিদম তৈরি করেন যেটি ছিল বর্তমান কম্পিউটার দাবার প্রথমদিকের একটি ভার্সন। যদিও তখন এই প্রোগ্রামটি কোনো কম্পিউটারে ব্যবহৃত হয়নি।
২০১২ সালে রাশিয়ান চেজ গ্র্যান্ডমাস্টার গ্যারি কাসপারাভ টুরিংয়ের তৈরি অ্যালগারিদমের বিপক্ষে খেলেন এবং এবং ১৬ টি চালের মাধ্যমে টুরিংয়ের অ্যালগারিদমকে হারিয়ে দেন।
১৫. অ্যালান টুরিংয়ের মনোপলি
২০১২ সালে তার জন্মের ১০০ বছর পূর্তি উপলক্ষে একটি মনোপলি প্রকাশিত হয় যেটি ছিল অ্যালান টুরিংয়ের সংস্করণ। টুরিং বেঁচে থাকার সময় এই মনোপলি খেলাটি খুব ভালোবাসতেন। ১৯৫০ সালে তার বন্ধু উইলিয়াম নিউম্যান টুরিংয়ের থিম সমৃদ্ধ একটি হাতে আঁকা মনোপলি তৈরি করেন।
এই মনোপলিটিতে সাধারন ছবির পরিবর্তে ব্লেচলি পার্কের ঘরবাড়ি সহ টুরিংয়ের কিছু ছবিও ব্যবহৃত হয় যা আগে কখনো দেখা যায় নি। মনোপলির এই সংস্করণটি এখন খুঁজে পাওয়া মুশকিল তবে অ্যামাজনে এই সংস্করণের কিছু কপি এখনোও আছে।