বর্তমানে ফ্রিল্যান্সিং একটি জনপ্রিয় আয়ের মাধ্যম হয়ে উঠেছে। এখন ঘরে বসেই অনেকে ফ্রিল্যান্সিংয়ের মাধ্যমে মাসে হাজার হাজার টাকা আয় করছেন। ফ্রিল্যান্সিং জনপ্রিয় হওয়ার প্রধান কারণ হচ্ছে এটি সম্পূর্ণ ব্যক্তি স্বাধীন। কেননা এখানে আপনি আপনার ইচ্ছামত কাজ করতে পারবেন। এখানে কেউ আপনার বস নয়। আপনি নিজেই নিজের বস।আবার অনেকে ফ্রিল্যান্সিংকে পেশা হিসেবে বেছে নেয় এই কারণে যে এখানে কাজের অতটা চাপ নেই। আপনি নিজের সুবিধামত কাজ করে টাকা আয় করতে পারবেন।
অনেকে আবার বাড়তি আয়ের আশায় চাকরির ফাঁকে ফাঁকে ফ্রিল্যান্সিং করে থাকেন। এদের মধ্যে কেউ কেউ ফ্রিল্যান্সিংকে ক্যারিয়ার হিসেবে গ্রহণ করে থাকেন। আপনি যদি তাদের মধ্যে একজন হন তবে এই লেখাটি আপনার জন্য। ফ্রিল্যান্সিংয়ের মাধ্যমে আপনি যদি আপনার নিজস্ব কর্মসংস্থান তৈরি করতে ইচ্ছুক হন তবে লেখাটি মনোযোগ দিয়ে পড়ুন। পেশাদার ফ্রিল্যান্সার হতে গেলে আপনাকে কিছু বিষয় বিবেচনা করতে হবে। এই বিষয়গুলো আপনাকে একজন সফল ফ্রিল্যান্সার হতে অনেক সাহায্য করতে পারে। চলুন জেনে নেই বিষয়গুলো কী কী।
১. ব্যক্তিত্ব
ফ্রিল্যান্সিং সবার জন্য নয়। খুব কম মানুষই এর জন্য উপযুক্ত। দেখা যায়, অনেকে এর মাধ্যমে হাজার হাজার টাকা রোজগার করেন আবার অনেকে সারা মাস পরিশ্রম করে পাঁচ হাজার টাকাও আয় করতে পারেন না। একজন ফ্রিল্যান্সার হতে গেলে যে জিনিসটি আপনার অবশ্যই থাকতে হবে সেটি হচ্ছে ধৈর্য। কেননা ফ্রিল্যান্সিংয়ের সময় ধৈর্য আপনার কঠিন পরীক্ষা নেবে। খুব কম সংখ্যক মানুষই এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারেন। আপনি যদি স্ব-প্রণোদিত হন এবং কোনো কাজ গুরুত্ব সহকারে শুরু করার ক্ষমতা আপনার থাকে তবে ফ্রিল্যান্সিং আপনার জন্য একটি আদর্শ কাজ হতে পারে। আত্মকর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে ঊত্থান ও পতন থাকবে এটাই স্বাভাবিক। এর সাথে নিজেকে খাপ খাওয়ানোর ক্ষমতা আপনার মধ্যে থাকতে হবে।
যদি এই বিষয়টি সহজভাবে মেনে না নিতে পারেন তবে আপনি কখনোই সফলতা অর্জন করতে পারবেন না। ফ্রিল্যান্সার হিসেবে কাজ করার সময় আপনি সুসময় ও দুঃসময় উভয়েরই মুখোমুখি হবেন। আপনি যখন ভালো সময় পার করবেন তখন আপনি চমৎকার ক্লায়েন্টের সাথে বড় ধরনের কোনো প্রকল্পের কাজ পেতে পারেন। অাবার ভালো কাজের ফলস্বরূপ আপনি বোনাসও পেতে পারেন। তেমনি এমন অনেক সময় আসবে যখন আপনার নিকট কোনো কাজ আসবে না বা আপনার অর্জিত টাকা পেতে দেরি হবে। এমন অবস্থায় আপনাকে টিকে থাকতে হবে।
ধৈর্যহারা হলে আপনি ফ্রিল্যান্সিং করতে পারবেন না। আপনার দক্ষতা বাড়াতে নিজের কাছে নিজেই প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হন। খুঁজে বের করুন কোন বিষয়গুলো আপনাকে শিখতে হবে। সেই বিষয়গুলো শেখার জন্য সেরা পন্থা অবলম্বন করুন। আপনি চাইলে অনলাইন থেকে বিনামূল্যে বিভিন্ন টিউটোরিয়াল দেখার মাধ্যমে নিজের দক্ষতা বাড়াতে পারেন। কাজ নিয়ে কখনো গড়িমসি করবেন না। কেননা ফ্রিল্যান্সিং করার সময় আপনার কাজ দেখভাল করার জন্য কোন বস থাকবে না।
একটি কাজ শেষ করার জন্য আপনাকে একটি নির্দিষ্ট সময়সীমা নির্ধারণ করতে হবে। মনে রাখবেন আপনি যদি কাজ করেন তবেই আপনি আয় করতে পারবেন। আপনি যদি সেই লোকগুলোর মত হন যারা নিজের কাজকে ভালোবাসেন, কাজ নিয়ে কখনো আলসেমি করেন না, ঝুঁকি নিতে পছন্দ করেন এবং স্ব-প্রণোদিত হয়ে আত্মকর্মসংস্থান তৈরি করতে চান, তবেই আপনি ফ্রিল্যান্সার হিসেবে কাজ শুরু করতে পারেন। অন্যথায় আপনি ফ্রিল্যান্সিংয়ের জন্য উপযুক্ত নন।
২. পারদর্শিতা
আপনি কোন কোন বিষয়ে পারদর্শী সেটা আপনার থেকে থেকে অন্য কেউ ভালো জানে না। আপনি যদি আপনার পারদর্শিতার কথাগুলো প্রচার করতে পারেন তবে আপনার কাজের কোনো অভাব হবে না। কেননা বর্তমানে অনলাইনে এজেন্সিগুলো বিভিন্ন বিষয়ে পারদর্শী লোকগুলোকে ভাড়া করার মাধ্যমে তাদের কাজ করিয়ে নেয়।এজন্য আপনি যেটা করতে পারেন তা হল কোন বিষয়ে আপনি বেশি অভিজ্ঞ, কোন বিষয়ে আপনি বেশি পারদর্শী সেটা খুঁজে বের করতে পারেন।
একবার আপনার পারদর্শিতার বিষয়টি খুঁজে বের করার পর আপনি সেই বিষয়ে বিশেষজ্ঞ হয়ে ওঠার চেষ্টা করুন। তারপর বিভিন্ন অনলাইন গ্রুপে যুক্ত হয়ে আপনি আপনার পারদর্শিতার বিষয়গুলো সকলকে জানাতে থাকুন। সেখানে আপনার দক্ষতার কথাগুলো লিখুন এবং আলোচনা করতে থাকুন। এর মাধ্যমে সবাই আপনার দক্ষতার কথা জানতে পারবে এবং আপনাকে দিয়ে কাজ করাতে ইচ্ছাপোষণ করবে। এভাবে আপনি প্রচুর পরিমাণ কাজ পাবেন এবং আপনার ফ্রিল্যান্সিং ক্যারিয়ারের উন্নতি করতে পারবেন।
৩. যোগাযোগ
একজন ফ্রিল্যান্সার হিসেবে আপনি ততক্ষণ পর্যন্ত পর্যাপ্ত পরিমাণ কাজ পাবেন না যতক্ষণ পর্যন্ত কেউ আপনাকে ভাড়া না করবে। এজন্য যে বা যারা আপনাকে বা আপনার পরিচিত কাউকে এর আগে ভাড়া করেছিল, তাদের সাথে যোগাযোগ রাখুন। ফ্রিল্যান্সিংয়ের মাধ্যমে ভালো পরিমাণ আয় করার মূলমন্ত্র হচ্ছে বিভিন্ন ক্লায়েন্ট এবং বিভিন্ন এজেন্সির সাথে প্রতিনিয়ত যোগাযোগ রাখা। আপনি যদি তাদের সাথে প্রতিনিয়ত যোগাযোগ রাখতে পারেন তবে আপনি বিভিন্ন ধরনের কাজ পাবেন।
আপনি চাইলে সোশ্যাল মিডিয়াগুলোতে বিভিন্ন ফ্রিল্যান্সার অথবা ফ্রিল্যান্সিং গ্রুপের সাথে যোগাযোগ রাখতে পারেন এবং তাদের কাছ থেকে কাজ নিতে পারেন। আপনার প্রোফাইল প্রতিনিয়ত আপডেট করুন। আপনি যে বিষয়গুলোতে দক্ষ সেই বিষয়গুলো আপনার প্রোফাইলে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করুন। আপনার এলাকায় যদি অন্য কোনো ফ্রিল্যান্সার থেকে থাকে, তবে তাদের সাথে সুসম্পর্ক রাখার চেষ্টা করুন। পাশাপাশি যারা তাদেরকে কাজে নিয়ে থাকে,সেসব নিয়োগদাতাদের চেনার চেষ্টা করুন।
এছাড়া আপনি ফ্রিল্যান্সারদের নিয়ে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন ইভেন্টে অংশগ্রহণ করতে পারেন। এর মাধ্যমে আপনার অনেকের সাথে পরিচয় ঘটবে এবং আপনার কাজ পাওয়ার সম্ভাবনা অনেক বৃদ্ধি পাবে। মনে রাখবেন ফ্রিল্যান্সিংয়ের সাথে জড়িত লোকজনের সাথে আপনার যদি যোগাযোগ কম থাকে তবে আপনি প্রত্যাশামত সফল হতে পারবেন না।
৪. কর্মক্ষেত্র
আপনি যদি অধিক আয়ের আশায় কয়েকজন ফ্রিল্যান্সারের সাথে যুক্ত হয়ে একটি দল গঠন করে ফ্রিল্যান্সিং করতে চান তবে অবশ্যই আপনার একটি ভালো মানের কর্মক্ষেত্র প্রয়োজন হবে। আপনি যদি একটি দল তৈরির মাধ্যমে ফ্রিল্যান্সিং করেন তবে আপনি অনেক দিক দিয়ে উপকৃত হবেন।এতে যেমন সবাই মিলে অধিক আয় করতে পারবেন, অন্যান্য ফ্রিল্যান্সারদের কাছ থেকেও অনেক কিছু শিখতে পারবেন। সেই সাথে বিভিন্ন বড় বড় প্রকল্পের কাজও হাতে নিতে পারবেন।
সবাই মিলে যদি একসাথে কাজ করতে চান তবে আপনাকে কাজের জায়গার উপর নজর দিতে হবে। এক্ষেত্রে আপনার একটি মোটামুটি বড় ধরনের রুম দরকার হবে। রুমটি যেন কোলাহলমুক্ত হয় সেটি নিশ্চিত করতে হবে। এছাড়া কম্পিউটার ডেস্ক এবং বসার চেয়ারটি আরামদায়ক হতে হবে। কেননা ঘন্টার পর ঘন্টা এই চেয়ারে বসেই সবাইকে কাজ করতে হবে। কাজ করার সময় অন্য কেউ যেন সমস্যা সৃষ্টি না করে যে বিষয়টির দিকে খেয়াল রাখতে হবে।যেহেতু রুমে পুরো একটি দল কাজ করবে, তাই রুমে পর্যাপ্ত পরিমাণ আলোবাতাসের ব্যবস্থা রাখতে হবে।
রুমটি সবসময় সুন্দর এবং পরিষ্কারপরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। কাজের জায়গাটি যদি সবার পছন্দ না হয় তবে কেউই কাজ করে মজা পাবে না। এর ফলে আয়ের পরিমাণও কম হবে। তাই বেশি পরিমাণ আয় করতে হলে আপনার কর্মক্ষেত্রটি যথাসম্ভব সুন্দর করে তুলুন এবং একটি পেশাদারি অফিস হিসেবে গড়ে তুলতে চেষ্টা করুন। এসব করতে প্রথম দিকে আপনার হয়তো কিছু টাকা খরচ হবে তবে পরবর্তীতে আপনি এর সুফল পাবেন।
৫. টাকা
আপনি যখন প্রথম অবস্থায় একজন ফ্রিল্যান্সার হিসেবে কাজ শুরু করবেন তখন আপনাকে প্রচুর পরিমাণ সময় কাজের পেছনে ব্যয় করতে হবে। কিন্তু এর বিনিময়ে আপনি অতি সামান্য কিছু পরিমাণ উপার্জন করতে পারবেন। আবার অনেক এজেন্সিতে কাজ করতে হলে আপনাকে প্রথমে বিনিয়োগ করতে হবে এবং তারপর কাজ হাতে নিতে হবে এবং পরবর্তীতে আপনি সেখান থেকে যা আয় করবেন তা আপনার বিনিয়োগের থেকে অনেকাংশে কম হতে পারে। অনেক ক্ষেত্রে আপনি বিনিয়োগ করে কাজ করেও এজেন্সি বা ক্লায়েন্টের থেকে পারিশ্রমিক আদায় করতে পারবেন না।
পারিশ্রমিক না পেলে হতাশ হবেন না। ভালো মানের এজেন্সি বা ক্লায়েন্ট খুঁজুন যারা ঠিকমতো পারিশ্রমিক দিয়ে থাকেন। অনেক ফ্রিল্যান্সারই পারিশ্রমিক না পেয়ে হতাশ হয়ে ফ্রিল্যান্সিংকে বিদায় জানাতে বাধ্য হয়। তাই আপনাকে ক্লায়েন্ট বা এজেন্সি নির্বাচনের ক্ষেত্রে সতর্ক থাকতে হবে। কোথাও বিনিয়োগ করার আগে আপনাকে বিবেচনা করতে হবে যে আপনি কোথায় বিনিয়োগ করছেন এবং সেখান থেকে আপনি কতটা লাভবান হতে পারবেন।
কোথাও বিনিয়োগ করার আগে অন্যান্য ফ্রিল্যান্সারদের পরামর্শ নিতে পারেন। আপনার যতটুকু বাজেট তার বেশি বিনিয়োগ করতে যাবেন না। আপনি যদি এসব ব্যাপারে সতর্ক হন তবে ফ্রিল্যান্সিংয়ের মাধ্যমে যথেষ্ট পরিমান আয় করতে পারবেন।
আপনি যদি ফ্রিল্যান্সকে পেশা হিসেবে বেছে নিতে চান তবে উপরের বিষয়গুলো অবশ্যই বিবেচনা করুন। সবার আগে নিজেকে প্রশ্ন করুন। আপনি কি সত্যিই ফ্রিল্যান্সিংয়ের জন্য উপযুক্ত? আপনার উত্তর যদি ‘হ্যাঁ’ হয়ে থাকে তবে দেরি না করে আজই ফ্রিল্যান্সিং শুরু করে দিন।