আমরা প্রায় সকলেই আধুনিক হতে চেষ্টা করি। এই আধুনিকতার যুগে আমরা সকলেই আমাদের জীবনকে সহজ করে তুলতে কোনো না কোনো প্রযুক্তি ব্যবহার করে থাকি। তবে বর্তমান যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলার জন্য এবং জীবনকে অধিক সহজতর করে তোলার জন্য আমরা প্রায় সবাই বেশিরভাগ সময় ইন্টারনেট ব্যবহার করে থাকি। আমরা আমাদের দৈনন্দিন কাজের অধিকাংশই ইন্টারনেটের সাহায্য নিয়ে সম্পন্ন করি। বর্তমান যুগে প্রায় সবকিছুই ইন্টারনেট নির্ভর হয়ে পড়েছে। ইন্টারনেটের মাধ্যমে কাজ করে আমরা আমাদের মূল্যবান সময় অনেকাংশে বাঁচাতে সক্ষম হয়েছি।
এখন আর আমাদের লাইনে দাঁড়িয়ে রেল বা বাসের টিকেট কাটতে হয় না। আবার ঘরে বসেই আমরা আমাদের কেনাকাটা শেষ করতে পারি। এমনকি অতি দ্রুত টাকা পয়সার লেনদেনও এই ইন্টারনেটের মাধ্যমে করতে পারি। বলতে গেলে প্রায় সবকিছুই আমরা এখন ইন্টারনেট দ্বারা করে থাকি।
তবে এই ইন্টারনেটের সুবিধাগুলো ভোগ করতে হলে এখানে আমাদের বিভিন্ন ধরনের অ্যাকাউন্ট খুলতে হয়। অ্যাকাউন্টগুলো খুলতে আমরা আমাদের ব্যক্তিগত বিভিন্ন ধরনের তথ্য, আর্থিক অবস্থার বিবরণ সহ অতি সংবেদনশীল তথ্যও দিয়ে থাকি। আর আমার আপনার এই মূল্যবান তথ্যগুলো পাওয়ার জন্য অনেক হ্যাকার ইন্টারনেটে ওঁৎ পেতে থাকে। এদের হাত থেকে সুরক্ষিত থাকতে ১০টি কার্যকরী টিপস নিয়ে আজ আলোচনা করবো।
১. পাবলিক ওয়াই-ফাই ব্যবহারে সতর্ক থাকুন
আমরা হাতের নাগালের মধ্যে কোনো ওয়াই-ফাই পেলেই সেটা ব্যবহার করার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠি। আর সেটি যদি পাবলিক ওয়াই-ফাই হয় তাহলে তো কোনো কথাই নেই। যতদ্রুত সম্ভব আমরা সেখানে কানেক্টেড হয়ে বিভিন্ন ধরনের ফাইল ডাউনলোড করতে শুরু করে দেই। আর এভাবেই আমরা মারাত্মক ভুলটা করে বসি। সাধারণত পাবলিক ওয়াই-ফাই নেটওয়ার্কগুলো খুব একটা নিরাপদ হয় না। হ্যাকাররা অতি সহজেই এখান থেকে আপনাকে তাদের তালুবন্দি করতে পারে।
এজন্য যতটা সম্ভব আপনি আপনার ব্যক্তিগত তথ্য গুলো পাবলিক ওয়াই-ফাই ব্যবহার করার সময় কম শেয়ার করার চেষ্টা করুন। অনেক মানুষ ব্যবহার করে এমন কম্পিউটার ব্যবহারের ক্ষেত্রেও সর্তকতা অবলম্বন করুন। সবচেয়ে ভালো হয় আপনি যদি এগুলোর ব্যবহার থেকে বিরত থাকতে পারেন। যদি পাবলিক ওয়াই-ফাই ব্যবহার করতেই হয় তবে VPN দিয়ে ব্যবহার করুন। কেননা VPN আপনার ও হ্যাকারের মাঝে দেওয়াল সৃষ্টি করবে।
২. আপনার ব্যবহৃত সফটওয়্যারগুলো আপডেটেড রাখুন
আপনি যে অপারেটিং সিস্টেম ব্যবহার করছেন তার সফটওয়্যার এবং প্রোগ্রামগুলো আপডেট করুন। এমনকি নতুন কোনো সফটওয়্যার ইন্সটলের প্রয়োজন হলে তার আপডেট ভার্সন ব্যবহার করুন। আপনি চাইলে আপনার অপারেটিং সিস্টেমের জন্য অটোমেটিক আপডেট অপশনটি চালু রাখুন। এতে আপনার অপারেটিং সিস্টেমের নতুন কোনো সংস্করণ প্রকাশিত হওয়া মাত্র আপনি সেটি ব্যবহার করতে পারবেন।
ওয়েব ব্রাউজারের ক্ষেত্রে অটোমেটিক সিকিউরিটি আপডেট নেয় এমন ধরনের ব্রাউজার ব্যবহার করুন। এক্ষেত্রে আপনি ক্রোম বা ফায়ারফক্স ব্যবহার করতে পারেন। এছাড়া আপনি আপনার কম্পিউটারে Secunia PSI নামক অ্যাপ্লিকেশনটি ইন্সটল করে রাখতে পারেন। এটি আপনার কম্পিউটারে থাকা সমস্ত অ্যাপ্লিকেশনগুলোর মধ্যে যেগুলোর আপডেট দিতে হবে তা আপনাকে জানিয়ে দেবে।
৩. ফিশিং এবং স্পামিংয়ের দিকে নজর রাখুন
ইন্টারনেটে আপনি হারহামেশাই বিভিন্ন ধরনের আকর্ষণীয় অফার দেখতে পাবেন। এগুলো আসলে কোনো অফার নয়। এই অফারগুলোর মধ্যে অধিকাংশই আপনাকে হ্যাকারদের জালে আটকানোর ফাঁদ। এছাড়া হ্যাকাররা আপনাকে বিভিন্ন ধরনের ই-মেইল করতে পারে অথবা আপনাকে বিভিন্ন লিংক দিতে পারে। এক্ষেত্রে আপনি আগে নিশ্চিত হয়ে নেবেন যে, ইমেইলটি বা লিংকটি কোন সূত্র থেকে এসেছে। যদি বিশ্বস্ত কোন সূত্র থেকে ইমেইলটি বা লিংকটি এসে থাকে তবেই সেটিতে ক্লিক করবেন। অচেনা কোন সূত্র হলে সেটা এড়িয়ে যাওয়াই ভালো।
৪. যথাসম্ভব শক্তিশালী পাসওয়ার্ড ব্যবহার করুন
বিভিন্ন ধরনের অ্যাকাউন্টের ক্ষেত্রে আমরা বিভিন্ন ধরনের পাসওয়ার্ড ব্যবহার করে থাকি। আমরা অনেক সময় আমাদের বিভিন্ন অ্যাকাউন্টগুলোর পাসওয়ার্ড মনে রাখার সুবিধার্থে একই পাসওয়ার্ড বারবার ব্যবহার করি। তবে এই কাজটি করা মোটেও নিরাপদ নয়। কেননা হ্যাকার কোনভাবে যদি আপনার একটি অ্যাকাউন্টের পাসওয়ার্ড জানতে পারে তবে সে আপনার সবগুলো অ্যাকাউন্ট নিজের দখলে নিতে পারবে। তাই ভিন্ন ভিন্ন অ্যাকাউন্টের ক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন পাসওয়ার্ড ব্যবহার করাই বুদ্ধিমানের কাজ। সব সময় আপনি আপনার পাসওয়ার্ড কে অধিক শক্তিশালী করার চেষ্টা করুন। পাসওয়ার্ডের ক্ষেত্রে কম করে হলেও ২০টি ক্যারেক্টার ব্যবহার করুন।
আপনি চাইলে ছোট ও বড় হাতের অক্ষর মিশিয়ে পাসওয়ার্ড দিতে পারেন এবং বিভিন্ন ধরনের সিম্বল ব্যবহার করতে পারেন। এতে করে আপনার পাসওয়ার্ডটি হ্যাকারের কাছে দুর্বোধ্য হয়ে উঠবে। এছাড়া কিছুদিন পর পর পাসওয়ার্ড পরিবর্তন করুন। ভুলেও কখনো কারো কাছে পাসওয়ার্ড শেয়ার করবেন না এবং পাসওয়ার্ড কোথাও লিখে রাখবেন না। পাসওয়ার্ড নির্বাচনের ক্ষেত্রে এমন পাসওয়ার্ড নির্বাচন করুন যেটা আপনার নাম, পরিচয়, ঠিকানা বা আপনার কোন প্রিয় বিষয়ের সাথে সম্পর্কিত না হয়। শক্তিশালী পাসওয়ার্ড আপনাকে হ্যাকিং এর হাত থেকে সুরক্ষিত রাখতে পারে।
৫. ক্লিক করার আগে অন্তত একবার ভাবুন
আপনি যে লিংকটি বা যে ওয়েবসাইটিতে ক্লিক করেছেন তা সম্পর্কে আপনি কতটুকু জানেন? এক্ষেত্রে আপনার উচিত যে কোন লিংক বা ওয়েবসাইটে প্রবেশ করার আগে সেটি কতটুকু নিরাপদ তা বিবেচনা করা। অচেনা ওয়েবসাইট ভিজিট করা থেকে বিরত থাকুন এবং বিশ্বস্ত সোর্স ব্যতীত অন্য কোন সোর্স থেকে ফাইল ডাউনলোড করবেন না। এই বিষয়গুলো আপনি যদি খেয়াল না করেন তবে আপনি ম্যালওয়্যারের শিকার হতে পারেন যা আপনার অগোচরে সমস্ত তথ্য অন্যের কাছে পাচার করে দিতে পারে।
৬. ডিভাইস সম্পূর্ণরূপে বন্ধ না করে কোথাও যাবেন না
আমরা প্রায় সময়ই এই ভুল কাজটি করে থাকি। কিন্তু এই সামান্য ভুলের কারণে আপনাকে অনেক বেশি পরিমাণে মাশুল গুনতে হতে পারে। আমাদের সকলের উচিত কোথাও যাওয়ার আগে ব্যবহৃত ডিভাইসগুলো সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করে যাওয়া। আপনি যদি এমনটি ভাবেন যে তাড়াতাড়িই তো ফিরে আসবো তবে আপনি ভুল। কেননা আপনাকে হ্যাক করতে হ্যাকারের খুব বেশি সময়ের প্রয়োজন হবে না। আপনার ব্যবহৃত ল্যাপটপ, ফোন বা ট্যাবলেট ছেড়ে আপনাকে যদি কোথাও যেতে হয় তবে সেটি লক করে যাবেন।
আপনার ফ্ল্যাশ ড্রাইভ বা এক্সটার্নাল মেমোরিতে যদি সংবেদনশীল কোন তথ্য থাকে তবে সেগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করুন। ডেস্কটপ কম্পিউটারের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণরূপে সেটিকে বন্ধ করুন অথবা স্ক্রিনটিকে লক করে রাখুন। অন্যের ডিভাইস দিয়ে নিজের অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করতে যাবেন না। আমাদের সকলের উচিত কাজ শেষে যেকোনো ধরনের অ্যাকাউন্ট থেকে লগআউট করা।
৭. সংবেদনশীল ডাটাগুলোকে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা দিন
আপনার সংবেদনশীল তথ্য যেমন ক্রেডিট কার্ডের তথ্য, স্টুডেন্ট রেকর্ডস বা আপনার স্বাস্থ্য সংক্রান্ত কোনো তথ্য গুলোর ক্ষেত্রে সচেতন হোন। কোথাও এই তথ্যগুলো ব্যবহার করার আগে ভেবেচিন্তে ব্যবহার করুন। আপনার যদি দরকার না পড়ে সে ক্ষেত্রে তথ্যগুলো আপনার ব্যবহৃত সিস্টেম থেকে সতর্কতার সাথে মুছে ফেলুন।
ইন্টারনেট ব্যাংকিং অথবা অনলাইন শপিংয়ের ক্ষেত্রে সচেতন হোন। আপনার ক্রেডিট কার্ডটি অনিরাপদ কোথাও ব্যবহার করছেন কিনা সেটি লক্ষ্য করুন। সংবেদনশীল তথ্যগুলো যদি কোথাও সংরক্ষণের বা আদান-প্রদানের দরকার হয় তবে সব সময় এনক্রিপশন করে ব্যবহার করুন।
৮. আপনার মোবাইল ফোনটি সতর্কভাবে ব্যবহার করুন
বর্তমানে আমরা প্রায় সবাই ফোনের মাধ্যমে ইন্টারনেট ব্যবহার করে থাকি। আমাদের সকলের উচিত ফোনটিকে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা প্রদান করা। কেননা কোনো কারণে ফোনটি যদি হারিয়ে যায় তবে কেউ যেন সেটি ব্যবহার করে আমাদের তথ্যগুলো হস্তগত করতে না পারে। এজন্য পাবলিক প্লেসে আপনার ফোনটি ব্যবহারের আগে সেটিতে পিন অথবা পাসওয়ার্ড দিয়ে রাখুন। কোন অ্যাপস ইনস্টলের দরকার হলে বিশ্বস্ত সোর্স থেকে ইন্সটল করুন।
আপনার ব্যক্তিগত কোনো তথ্য ফোনে সংরক্ষণ করবেন না। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতে আপনি আপনার কোন ধরনের তথ্য দিচ্ছেন সেটি মাথায় রাখুন। আপনার ফোনে জিপিএস লোকেশন ট্র্যাকিং অপশনটি চালু রাখুন। কোন কারণে আপনার ফোনটি হারিয়ে গেলে বা চুরি হয়ে গেলে এই অপশনটি আপনার ফোনটিকে খুঁজে পেতে সাহায্য করবে।
৯. অ্যান্টিভাইরাস এবং অ্যান্টি-ম্যালওয়ার ব্যবহার করুন
হয়তো আপনি শুধুমাত্র কম্পিউটারের ক্ষেত্রে অ্যান্টিভাইরাস ব্যবহার করেন। কিন্তু অন্যান্য ডিভাইসগুলোকে তেমন গুরুত্ব দেন না। এই কাজটি কখনোই করবেন না। ইন্টারনেট ব্যবহারের জন্য আপনি যে ধরনের ডিভাইসই ব্যবহার করুন না কেন সেটিতে অ্যান্টিভাইরাস এবং অ্যান্টি-ম্যালওয়ার ব্যবহার করুন। অ্যান্টিভাইরাস ব্যবহারের আগে দেখে নিন সেটা কতটুকু বিশ্বস্ত।
এই অ্যান্টিভাইরাস আপনার তথ্যগুলোকে বিভিন্ন ধরনের ক্ষতিকর ভাইরাসের হাত থেকে রক্ষা করবে এবং অ্যান্টি-ম্যালওয়্যার আপনাকে ম্যালওয়্যারের শিকার হতে দেবে না। আপনি সুরক্ষার জন্য Avast Antivirus, Bitdefender Antivirus, AVG Antivirus, Malwarebytes Anti-Malware ব্যবহার করতে পারেন।
১০. আপনার ডাটাগুলোকে ব্যাকআপ করে রাখুন
আপনার সমস্ত ডাটাগুলোকে ব্যাকআপ করে রাখুন। ভুলবশত আপনি যদি কোনো গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ডিলিট করে ফেলেন বা আপনার ডিভাইসটি যদি হারিয়ে যায় অথবা নষ্ট হয়ে যায় তবে আপনি ব্যাকআপ করা ডাটা থেকে সেগুলো পুনরূদ্ধার করে ব্যবহার করতে পারবেন।
ইন্টারনেট প্লাটফর্মে আপনি নিজেকে কখনোই শতভাগ সুরক্ষিত রাখতে পারবেন না। কিন্তু আপনি যদি উপরের কাজগুলো করেন তবে আপনি অনেকাংশেই সুরক্ষিত থাকবেন।