বর্তমান পৃথিবী এমন একটি জাল দ্বারা আবৃত যে জালে আমরা প্রায় সকলেই কোনো না কোনোভাবে জড়িয়ে আছি। এই জালের নাম হচ্ছে ইন্টারনেট। এই জালটি শুধুমাত্র সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোকে নির্দেশ করছে না। সমগ্র পৃথিবী ব্যাপী বিস্তৃত এই জালটি আমাদের বিভিন্ন ধরনের ব্যক্তিগত তথ্য জমা রাখার এবং পুনরুদ্ধার করার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। আমরা এই ইন্টারনেটকে একটি নিরাপদ ভল্ট হিসেবে বিবেচনা করে আমাদের বিভিন্ন সংবেদনশীল ও গুরুত্বপূর্ণ তথ্যগুলো এখানে সংরক্ষণ করে থাকি।
কিন্তু কিছু কিছু কম্পিউটার জিনিয়াসের কাছে আমাদের এই ব্যক্তিগত তথ্যগুলো হস্তগত করা নিছক ছেলেখেলা মাত্র। এই কম্পিউটার জিনিয়াসগণ হ্যাকারস, ব্ল্যাক হ্যাট হ্যাকারস, ভিলেনস, ক্র্যাকারস, সাইবার-ক্রিমিনাল, সাইবার পাইরেটস ইত্যাদি নামে বহুল পরিচিত। বিভিন্ন ক্ষতিকারক সফটওয়্যার অথবা ভাইরাস ব্যবহারের মাধ্যমে তারা তাদের কাঙ্ক্ষিত তথ্য হস্তগত করতে সমর্থ। এমনকি কোনো সিস্টেম অকেজো করে দিতে বা নিজের আয়ত্তে নিয়ে আসতেও এরা পটু। চলুন জেনে নিই এমন দশ জন সেরা হ্যাকার সম্পর্কে।
১. গ্যারি ম্যাকিনন
ছোটবেলা থেকেই এই জিনিয়াসের ইউএফও (UFO) সম্পর্কে তথ্য জানার প্রবল আগ্রহ ছিল। তিনি ভেবেছিলেন কোনোভাবে যদি নাসার ওয়েবসাইটে সরাসরি প্রবেশ করার অনুমতি পাওয়া যায় তবে ইউএফও সম্পর্কে অনেক কিছু জানা যাবে। এই ভেবে তিনি আমেরিকান আর্মড ফোর্স এবং নাসার ৯৭টি কম্পিউটার হ্যাক করেন। তিনি ভাইরাস ইনস্টলের মাধ্যমে কিছু গুরুত্বপূর্ণ ফাইলও মুছে দেন। সব কিছুই তিনি জানার আগ্রহ থেকে করেছিলেন। তিনি লন্ডনে তার বান্ধবীর আন্টির বাড়িতে বসে এই হ্যাকিং সম্পন্ন করেন। তিনি শুধু বেআইনিভাবে এই ওয়েবসাইটগুলোতে প্রবেশ ও তথ্য মুছে দিয়েই ক্ষান্ত হননি। তিনি এই ওয়েবসাইটগুলোর নিরাপত্তা বিভাগের দায়িত্বে থাকা দলের উদ্দেশ্যে একটি বার্তা লিখে রাখেন।
বার্তাটি ছিল “ইউর সিকিউরিটি ইজ ক্র্যাপ” যা ছিল ওয়েবসাইটগুলোর নিরাপত্তায় নিযুক্ত থাকা দলের কাছে ভীষণ লজ্জাজনক। এছাড়া তিনি ওয়াশিংটন নেটওয়ার্কের আওতায় থাকা ইউএস মিলিটারির প্রায় ২০০০টি কম্পিউটার ২৪ ঘন্টার জন্য বন্ধ রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন। এটি ছিল সর্বকালের সেরা মিলিটারি কম্পিউটার হ্যাকের ঘটনা।
২. লুলজসিক
লুলজসিক বা লুলজ সিকিউরিটি একটি প্রচন্ড শক্তিশালী ব্ল্যাক হ্যাট হ্যাকার গ্রপ যারা সনি, নিউজ ইন্টারন্যশনাল, সিআইএ, এফবিআই, স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের মতো কোম্পানির ওয়েবসাইট হ্যাক করেছিল। বিভিন্ন নিউজ কর্পোরেশনের অ্যাকাউন্ট হ্যাক করে তারা বিভিন্ন ধরনের মিথ্যা সংবাদ প্রচার করতো।
এই দলটি ‘দ্য টাইমস’ এবং ‘দ্য সান’ এর মতো জনপ্রিয় পত্রিকার ওয়েবসাইট হ্যাক করে সেখানে তাদের অবসরে যাওয়ার সংবাদ প্রচার করেছিল। অনেকে মনে করেন এই দলটি হ্যাকারসদের বিরুদ্ধে পর্যাপ্ত পরিমাণ নিরাপত্তা গ্রহণের লক্ষ্যে সকলের মাঝে সচেতনতা তৈরি করার জন্য কাজ করতো।
৩. আদ্রিয়ান লামো
আদ্রিয়ান লামো তার ক্যারিয়ার পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নেন যখন তিনি তার হ্যাকিং প্রতিভা বুঝতে পারেন। তিনি ইয়াহু, মাইক্রোসফট, গুগল এবং নিউইয়র্ক টাইমসের মতো সর্বোচ্চ নিরাপত্তাযুক্ত ওয়েবসাইটগুলো হ্যাক করে শিরোনামে এসেছেন।
তার হ্যাকিং করার পদ্ধতি ছিল অন্যদের থেকে আলাদা। তিনি বিভিন্ন পাবলিক ইন্টারনেট ব্যবহার করে এসব ওয়েবসাইটগুলো হ্যাক করতেন। এজন্য তাকে ‘হোমলেস হ্যাকার’ উপাধি দেওয়া হয়। হ্যাকিংয়ের দায়ে ২০০৪ সালে তিনি গ্রেফতার হন এবং তাকে ৬৫ হাজার ডলার জরিমানা গুনতে হয়।
৪. ম্যাথু বেভান এবং রিচার্ড প্রাইস
তারা দুইজন ছিলেন একে অপরের সহযোগী। তাদের লক্ষ্য ছিল আমেরিকা এবং উত্তর কোরিয়ার মাঝে বিভিন্ন সংবেদনশীল তথ্য হস্তগত করা। তারা ইউএস মিলিটারির কিছু কম্পিউটার হ্যাক করেছিলেন এবং কোরিয়ান পারমাণবিক গবেষণা কেন্দ্রকে ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে সেগুলো ব্যবহার করতেন।
তারা আমেরিকার পরিচয় গোপন রেখে কাজগুলো করতেন। যেহেতু উত্তর কোরিয়ার সাথে দক্ষিণ কোরিয়ার সম্পর্ক ভালো ছিল না তাই এই হ্যাকিংয়ের দায় উত্তর কোরিয়া দক্ষিণ কোরিয়ার উপরে চাপিয়ে দিত। যা পরবর্তীতে আন্তর্জাতিক সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়।
৫. জোনাথন জেমস
তিনিই ছিলেন প্রথম তরুণ যাকে সাইবার অপরাধের দায়ে ১৬ বছর বয়সে বন্দি করা হয়। জোনাথন জেমস ‘কমরেড’ নামে অধিক পরিচিত। তিনি ইউএস ডিপার্টমেন্টের ডিফেন্স থ্রেট রিডাকশন এজেন্সি হ্যাক করেছিলেন। তিনি এই এজেন্সিতে এমন একটি সিস্টেম ইন্সটল করেছিলেন যা দ্বারা এজেন্সিতে কর্মরত সকল কর্মচারীর মধ্যে আদান-প্রদানকৃত বার্তা সমূহ নিজের আয়ত্তে নিতে পারতেন।
এই প্রক্রিয়া ব্যবহারের মাধ্যমে কর্মচারীদের ইউজারনেম এবং পাসওয়ার্ড সংগ্রহের পর তিনি তাদের সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত তথ্য হস্তগত করতেন। এমনকি তিনি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সফটওয়্যারও চুরি করতেন। নাসার সিস্টেম হ্যাক করে তিনি ৪১ হাজার ডলার নিজের পকেটে পুরেছিলেন। ২০০৮ সালে তিনি আত্মহত্যা করেন।
৬. কেভিন পলসেন
আপনি যদি আপনার স্বপ্নের বাড়ি কিংবা স্বপ্নের গাড়িটি পেতে চান তবে কি করবেন? অথবা আপনি যদি কোন অনলাইন প্রতিযোগিতা বা রেডিও শো এর প্রতিযোগিতায় জিততে চান তবে কি করবেন? আপনি যদি কেভিন পলসেন না হন তবে আপনার ভাগ্যের উপরই সেটা ছেড়ে দেবেন। সাইবার জগতে তিনি ‘ডার্ক দান্তে’ নামে পরিচিত ছিলেন।
লস এঞ্জেলসের একটি রেডিও চ্যানেল হ্যাক করে তিনি বিখ্যাত হন। তখন সেই রেডিওতে একটি প্রতিযোগিতা চলছিল। প্রতিযোগিতাটি এমন ছিল যে ১০২ নম্বর কলারকে একটি দামী পোর্শে গাড়ি পুরস্কার দেওয়া হবে। কেভিন গাড়িটি পাওয়ার জন্য পুরো টেলিফোন লাইন জ্যাম করে দিয়েছিলেন এবং নিজে ১০২ নম্বর কলার হয়ে পুরস্কারটি জিতে নেন। অবশ্য পরবর্তীতে তিনি এফ বি আই এর হাতে বন্দী হন।
৭. কেভিন মিটনিক
এক সময়ে তিনি ছিলেন আমেরিকার মোস্ট ওয়ান্টেড সাইবার অপরাধী। তিনি আইবিএম, নোকিয়া, মটোরোলা, পেন্টাগন সহ বেশকিছু টেলিকম কোম্পানির ডাটাবেজ হ্যাক করেছিলেন এবং এর থেকে প্রায় এক বিলিয়ন ডলার আয় করেছিলেন। তিনি আমেরিকার ন্যাশনাল সিকিউরিটি সিস্টেম হ্যাক করতে চেয়েছিলেন।
এই সব অপরাধের জন্য তাকে সর্বোমোট ৫ বছর কারাভোগ করতে হয় যার মধ্যে আট মাস ছিল নির্জন কারাভোগ। সাজা শেষ হওয়ার পর তিনি নতুন করে জীবন শুরু করেন। বর্তমানে তিনি একজন সিকিউরিটি এক্সপার্ট হিসেবে একটি কোম্পানিতে কর্মরত আছেন।
৮. অ্যানোনিমাস
এরা একটি ছদ্মবেশী হ্যাকার গ্রুপ। ভক্তদের কাছে ‘ডিজিটাল রবিনহুড’ নামে এরা পরিচিত। তবে সাধারণ মানুষের কাছে এরা কিছু মুখোশধারী মানুষ হিসেবে বেশি পরিচিত। এই গ্রুপটি তাদের নাম পরিচয় গোপন রেখে হ্যাকিং করতে ভালোবাসে। তারা বিভিন্ন সরকারি, ধর্মীয়, এবং কর্পোরেট ওয়েবসাইটগুলোতে হানা দিয়ে নিজেদের অস্তিত্বের প্রমাণ দেয়।
তাদের মূল লক্ষ্য গুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে এফবিআই, সিআইএ, পে পাল, সনি, মাস্টারকার্ড, ভিসা ইত্যাদি। এছাড়া তারা বিভিন্ন দেশ যেমন ভ্যাটিকান, চীন, ইসরাইল, তিউনেশিয়া, উগান্ডার সরকারি ওয়েবসাইটগুলোকেও নিজেদের লক্ষ্যবস্তু হিসেবে বিবেচনা করে।
৯. অ্যাস্ট্রা
এটি একটি সংস্কৃত শব্দ যা একজন হ্যাকার তার পরিচয় দিতে ব্যবহার করতেন। তিনি তার আসল নাম কখনোই প্রকাশ করেননি। তিনি ছিলেন একজন ৫৮ বছর বয়সী গ্রিক গণিতবিদ। তিনি ফ্রান্সের ডাসল্ট গ্রুপের ওয়েবসাইট হ্যাক করেন।
হ্যাক করার পর তিনি ওয়েবসাইটে থাকা সমস্ত অস্ত্রের ডিজাইন নিজের আয়ত্তে নিয়ে নেন। এরপর টানা পাঁচ বছর ধরে তিনি এই ডিজাইনগুলি বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রায় ২৫০ জন মানুষের কাছে বিক্রি করেন। পরবর্তীতে তিনি পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হন এবং নিজের দোষ স্বীকার করেন। সরকারিভাবে জানা যায়, এই হ্যাকিং এর ফলে ডাসল্ট গ্রুপের ৩৬০ মিলিয়ন ডলার ক্ষতি হয়।
১০. আলবার্ট গঞ্জালেজ
ইন্টারনেট ব্যাংকিং কে যিনি বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়েছেন তার নাম হচ্ছে আলবার্ট গঞ্জালেজ। ডেবিট ও ক্রেডিট কার্ডের তথ্য চুরি করা ছিল তার কাছে বাঁ হাতের খেলার মত।
দুই বছরে তিনি প্রায় ১৭০ মিলিয়ন ক্রেডিট কার্ডের তথ্য চুরি করেন যা ছিল মানবজাতির ইতিহাসে সর্বোচ্চ ক্রেডিট কার্ড চুরির ঘটনা। ক্রেডিট কার্ডের তথ্য চুরির মাধ্যমে তিনি প্রায় ১০০ কোটি ডলার হাতিয়ে নিয়েছিলেন। পুলিশের হাতে ধরা পড়ার পর তাকে ২০ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়।