আমাদের নিত্যদিনের কর্মকান্ডে জড়িয়ে রয়েছে মোবাইল ফোন। এক বছরের শিশু থেকে ৮০ বছর বয়স্ক, কেউ এই প্রযুক্তি ব্যবহার থেকে পিছিয়ে নেই। মোবাইলে ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, ইউটিউব এ আমরা প্রতিদিন ঘন্টার পর ঘন্টার সময় পার করছি। হাজার হাজার মাইল দূরে থাকা পরিবারের সদস্য আর বন্ধুদের সাথে এক নিমিষে যোগাযোগের জন্য মোবাইলের নেই কোনো বিকল্প। তবে এর ক্ষতিকারক দিকটি নিয়ে আমরা কতটা ভাবি?
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ২০১৪ সালের রিপোর্ট বলা হয়েছিলো, বর্তমানে প্রায় ৬.৯ বিলিয়ন মোবাইল ফোন ব্যবহার করা হচ্ছে। এছাড়া ইলেক্ট্রনিক বিভিন্ন যন্ত্রপাতি কম্পিউটারসহ আরো অনেক যন্ত্রপাতি তো রয়েছেই। যেসব থেকে ছড়ানো রেডিয়েশন বা তেজস্ক্রিয়তা অনেকের দুশ্চিন্তার কারণ। আধুনিক বিশ্বে মোবাইলের এত বেশি ব্যবহার নিয়ে গতবছর ক্যালিফোর্নিয়ার স্বাস্থ্য সংস্থা বলেছিলো, “মোবাইল ফোন নিয়ে আমাদের দুশ্চিন্তা করা উচিত। এটা বিপদজনক”। সাথে সাথে একই বছরের ডিসেম্বর মাসে তারা সাধারণ জনগণের স্বাস্থ্য সচেতনতার জন্য একটি গাইডলাইনও প্রকাশ করে।
হতে পারে মোবাইলেই আপনি এই আর্টিকেলটি পড়ছেন আর দুঃশ্চিন্তা করছেন এর ক্ষতিকারক প্রভাব নিয়ে। হতে পারে আপনার প্রিয়জন আপনার পাশে বসেই মোবাইল ব্যবহার করছে। মোবাইল বিপদজনক কি না সেটা বোঝার জন্য আপনাকে জানতে হবে মোবাইল কিভাবে কাজ করে।
সাধারণত লো-পাওয়ার রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি মোবাইলের নেটওয়ার্কিংয়ের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়। যা থেকে দুর্বল ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক রেডিয়েশন ছড়ায়। আমাদের মধ্যে একটি ধারণা প্রচলিত রয়েছে যে, রেডিয়েশন মানেই বিপদজনক। আলফা, গামা-রে ছাড়াও আয়োনাইজিং এবং নন – আয়োনাইজিং হিসেবেও রেডিয়েশনকে ভাগ করা হয়। আয়োনাইজিং রেডিয়েশন সাধারণত মানব শরীরের জন্য বিপদজনক ধরা হলেও স্বল্প শক্তিশালী আয়োনাইজিং রেডিয়েশন আমাদের নিত্যদিনের কাজেও ব্যবহার করা হয়। যেমন এক্স রে। তবে অধিক সময় আয়োনাইজ রেডিয়েশনে থাকলে শারীরিক ক্ষতির সম্ভবনা থাকে যার কারনে ডাক্তারা এক্সরে পরীক্ষার ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধান রাখেন। মোবাইল ফোনে সাধারণত লো পাওয়ার নন আয়োনাইজ রেডিয়েশন সিগনাল ব্যবহার করা হয়। যেই সিগনাল মানব শরীরের ডিএনএ পরিবর্তন বা কোনরুপ ক্ষতি করে এর প্রমান এখনো পাওয়া যায়নি।
মোবাইল রেডিয়েশন ইদুরের শরীরের কোন পরিবর্তন ঘটায় কিনা সেটা জানতে অসংখ্য পরীক্ষা সম্পাদিত হয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন গবেষণায়গারে। আমেরিকান ন্যাশনাল ক্যান্সার ইন্সটিটিউট, ফুড এন্ড ড্রাগ অ্যাডমিনেস্ট্রেশন মোবাইলের রেডিয়েশন নিয়ে অসংখ্য পরীক্ষা চালালেও সাম্প্রতিক রিপোর্টগুলোতে বিপদজনক কিছু পাওয়া যায়নি। ২০১১ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা গণমাধ্যমের এক বিবৃতি বলে, “মোবাইল রেডিয়েশনের কারণে ইঁদুরের হৃদপিন্ডে টিউমার কোষের দেখা পাওয়া গিয়েছে।”
এ ব্যাপারে ফুড এন্ড ড্রাগ অ্যাডমিনেসট্রেশনের জন বুচার বলেছিলেন, “ইঁদুরের হৃদপিন্ডে মোবাইল রেডিয়েশনের কারণে টিউমারের বিরল নার্ভ টিস্যুর সন্ধান পাওয়া গিয়েছে তার মানে এই নয় যে, মানবসমাজের দুঃশ্চিন্তাগ্রস্থ হওয়া দরকার।”
পরবর্তীতে এফডিএ প্রায় ২৫ মিলিয়ন ডলার খরচ করে একটি প্রজেক্ট দাঁড় করায়। সেখানে ২জি থেকে ৫জি নেটওয়ার্কে বিভিন্ন বয়সী, নানান জাতের ইঁদুরের উপর পরীক্ষা চালানো হয়। গবেষকরা ইঁদুরগুলোকে প্রতিদিন ৯ ঘন্টা করে দুই বছর মোবাইলের রেডিয়েশনে রাখেন। এরপর সেগুলোকে পরীক্ষা করার পর কোনো ধরনের ক্যান্সার বা টিউমারের কোষের দেখা মেলেনি। তবে ইঁদুরগুলোকে যখন মোবাইলের রেডিয়েশনের সংস্পর্শে আনা হয়ছিলো তখন হার্টবিটের সামান্য পরিবর্তন লক্ষিত হয়েছিলো। উল্লেখ্য, ইঁদুরের জীবনের দুইবছর স্বাভাবিক মানুষের জীবনের ৭০ বছরের সমান ধরা হয়।
“মোবাইলের রেডিয়েশনের দ্বিগুণ, তিনগুন করেও পরীক্ষা চালানো হয়েছে। তবে কোনো ক্যান্সার বা টিউমারের লক্ষণ দেখা যায়নি।” গণমাধ্যমের এফডিএর বিবৃতি। গবেষণার ব্যাপারে জন বুচার আরো উল্লেখ করেছিলেন, “আমরা গবেষণায় যে পরিমাণ রেডিয়েশন ব্যবহার করেছি সেটা থেকে আমাদের নিত্যদিনের ব্যবহৃত মোবাইলের রেডিয়েশন অনেক অনেক অনেক কম।”
এছাড়া বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গবেষণাপত্রের উপর এফডিএ গবেষকরা বিস্তারিত ঘেঁটে জানায়, “বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গবেষকেরা বলা চলে ইঁদুরগুলোকে রেডিয়েশনের মাঝে ডুবিয়ে রেখেছিলো।” তারা সেলফোন থেকে পাওয়া রেডিয়েশন থেকে অনেক শক্তিশালী আয়োনাইজিং রেডিয়েশন ব্যবহার করেছে যেটা এমন ফলাফলের কারণ। “আমি এখনো কানে আমার সেলফোন ধরে রেখেছি। আমেরিকান ক্যান্সার সোস্যাইটির প্রধান ওটিস ব্রাউলি বিভিন্ন সাম্প্রতিক রিপোর্ট পড়ার পর মন্তব্য করেন। “যদিও ইঁদুরের উপর পরীক্ষা আর মানুষের নিত্যদিনের মোবাইলের ব্যবহার এই দুটিও মধ্যে পার্থক্য রয়েছে।”
এখনো মোবাইলের নিত্যদিনের ব্যবহারে কোনো বিপদের আভাষ পাওয়া যায়নি। তারপরও যদি আপনি নিজের ও পরিবারের জন্য দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে থাকেন তাহলে ক্যালিফোর্নিয়ার সাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইনটি ব্যবহার করতে পারেন।
১. সেলফোনে শরীর থেকে দূরে রাখুন। ফোনে কথা বলার হ্যান্ডসেট ব্যবহার করুন। হাতে বা পকেটে বহন না করে ব্যাকপ্যাক, পার্স অথবা ফোন হোল্ডারের মধ্যে ফোন রাখুন।
২. দুর্বল নেটওয়ার্কের সময় মোবাইল বন্ধ রাখুন। কারণ সেলফোনের রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি এনার্জি এক দাগ, দুই দাগ নেটওয়ার্কের সময় বেশি ব্যবহার করে।
৩. সরাসরি ভিডিও স্ট্রিম না করে ডাউনলোড করে এয়ারপ্লেন মুডে ভিডিও দেখতে পারেন।
৪. বিছানা বা আপনার মাথা কাছাকাছি ফোন রেখে ঘুমানো যাবে না।
৫. কথার সময় ছাড়া অন্যান্য সময়ে হেডসেট খুলে রাখুন।
আমাদের নিত্যদিনের সকল কাজের ক্ষেত্রে জড়িয়ে রয়েছে প্রযুক্তি। আর সেসবের মধ্যে মোবাইল ফোন সবার উপরে অবস্থান করছে। সাম্প্রতিক পরীক্ষা এর ব্যবহারের নিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চিত করলেও, এই যন্ত্রণাটি আমাদের করছে অসামাজিক আর প্রযুক্তিকেন্দ্রীক। তাই আমাদের উচিত এই যন্ত্রটি হাত থেকে নামিয়ে পরিবার, পরিবেশ আর সমাজের উপর যত্নশীল হওয়া।
সোর্স :
- MNN
- Theverge
- Learningenglish
- Integrativenutrition
- Commonsensemedia
- Times
- Commonsensemedia