বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের দেশে একটি বিশাল স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয়েছে। বাংলাদেশ এখন ইতিহাসের সাক্ষী। ছোটো একটি দেশ কিভাবে নিজেদের স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ করলো সেই গল্প হবে দেশে দেশে। এর মাধ্যমে উন্নত দেশের সাথে প্রতিযোগিতায় করবে বাংলাদেশ। এমন হাজারো জল্পনা-কল্পনা আজ প্রতিটি বাঙ্গালির চোখে। নিঃসন্দেহে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের দেশ আজ স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথে হাঁটা শুরু করেছে।
যোগাযোগের ক্ষেত্রে স্যাটেলাইট ব্যবহার করে জীবনযাত্রাকে আরো বেশি সহজ এবং দ্রুত গতি সম্পন্ন করা। স্যাটেলাইট দ্বারা যোগাযোগের মধ্যে রয়েছে ভিডিও, ফ্যাক্স, ইন্টারনেট, রেডিও ইত্যাদি। স্যাটেলাইট যোগাযোগের মাধ্যমে অনেক দূরবর্তী স্থানে ও যোগাযোগ স্থাপন করা সম্ভব, একই সাথে যেসব পরিস্থিতিতে অন্য কোনো মাধ্যমে যোগাযোগ স্থাপন করা কঠিন অথবা অসম্ভব এরকম যেকোনো নেতিবাচক পরিস্থিতিতে সহজেই স্যাটেলাইটের মাধ্যমে যোগাযোগ স্থাপন করা যাবে।
সকল জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে অবশেষে যুক্তরাস্ট্রের ফ্লোরিডাতে অবস্থিত নাসার কেনেডি স্পেস সেন্টার থেকে উৎক্ষেপিত হলো বাংলাদেশের প্রথম কৃত্রিম উপগ্রহ বঙ্গবন্ধু -১। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ স্থাপনের মাধ্যমে বাংলাদেশে অন্যান্য উন্নত দেশের সাথে উন্নয়নের দিকে আরও একধাপ এগিয়ে যাবার স্বপ্ন দেখে এবং এই কৃত্রিম উপগ্রহ দিয়ে বাংলাদেশ জাতি হিসেবে অনন্যভাবে নিজস্ব পরিচিতি পাবে পৃথিবীর বুকে। স্যাটেলাইটের সকল সুযোগ সুবিধা বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ দ্বারা পূরণ করা সম্ভব।
বঙ্গবন্ধু -১ স্যাটেলাইট বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন রেগুলেটরি কমিশন (BTRC) এর ‘বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ প্রজেক্ট’ এর আওতাধীন ছিলো। এই পুরো প্রজেক্টের কারিগরি সহযোগিতায় ছিলো স্পেস পার্টনারশিপ ইন্টারন্যাশনাল (SPI)। স্যাটেলাইটটি তৈরির দায়িত্বে ছিলো থেলস এলেনিয়া (Thales Alenia)। এটি ফ্রান্সে অবস্থিত ফ্রান্স-ইতালিয়ান একটি মহাকাশযান প্রস্তুতকারী সংস্থা। সফলভাবে উৎক্ষেপণের পরে এখন স্যাটেলাইটটির পর্যবেক্ষণ এবং পরিচালনার দায়িত্বে থাকবে বাংলাদেশ কমিউনিকেশন স্যাটেলাইট কোম্পানি লিমিটেড (BCSCL)।
আপনি জেনে অবাক হবেন শুধু আমাদের নিজস্ব স্যাটেলাইট না থাকার কারণে বাংলাদেশে প্রতিবছর স্যাটেলাইটের সুযোগ সুবিধা ভোগের জন্য বাৎসরিক খরচ ছিলো১৪ মিলিয়ন ডলার। কিন্তু বর্তমানে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট ১ এর জন্য আমাদের দেশ এই অতিরিক্ত খরচ থেকে রক্ষা পেতে যাচ্ছে। বঙ্গবন্ধু-১ বাংলাদেশের প্রথম কৃত্রিম ভূ-স্থির উপগ্রহ; সহজ কথায় কৃত্রিম উপগ্রহ। এখন বাংলাদেশের মানুষও নিঃসন্দেহে অন্যান্য দেশের সামনে প্রযুক্তিগত দিক দিয়ে নিজেদের যোগ্য প্রমাণে পিছিয়ে নেই।
সরকারি মতে, প্রাইভেট টিভি চ্যানেল চালক এবং ডিরেক্ট টু হোম (DTH) ক্যাবল সেবাপ্রদানকারী হতে যাচ্ছে স্যাটেলাইটের অন্যতম প্রধান ভোক্তা। এছাড়াও আবহাওয়া বিভাগ এবং প্রতিরক্ষা বাহিনী ও স্যাটালাইট দ্বারা উপকৃত হতে যাচ্ছে। অত্যন্ত চমৎকার একটি বিষয় হচ্ছে, এই বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ যেকোনো বড় প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন টর্নেডো অথবা সাইক্লোনের সময়ও বিচ্ছিন্ন নিরবিচ্ছিন্ন যোগাযোগ স্থাপনে সহায়তা করবে। টেলিমেডিসিন, ইরানি ই-লার্নিং এবং DTH সার্ভিসের জন্য এই উপগ্রহটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। এছাড়া বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট জনসংখ্যার ঘনত্ব নির্ণয় করতেও বেশ কাজে লাগানো যাবে।
বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট ১১৯.১ ডিগ্রি পূর্ব থেকে নিয়ন্ত্রণ করবে বাংলাদেশ। যেখান থেকে সার্কভুক্ত দেশগুলোর পাশাপাশি ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন, মায়ানমার, কিরগিজস্তান, উজবেকিস্তান, তুর্কিস্তান, কাজাখস্তান এবং তাজিকিস্তানের কিছু অংশ এই স্যাটেলাইটের সুযোগ-সুবিধা ভোগ করতে পারবে। প্রায় ৩৫০০ কিলোগ্রাম ভরের এই কৃত্রিম উপগ্রহটিতে সর্বমোট ৪০টি ট্রান্সপন্ডার ব্যান্ড রয়েছে, যার মধ্যে ২৬টি কিউ ব্যান্ড এবং ১৪টি সি ব্যান্ড ট্রান্সপন্ডার রয়েছে (ব্যান্ড ট্রান্সপন্ডারঃ স্যাটেলাইট যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত কম্পাঙ্ক পরিচালক, প্রেরণ এবং গ্রহণকারী যন্ত্র)। একেক্টি ট্রান্সপন্ডার ৩৬ মেগাহার্জের সমান।
তবে স্যাটেলাইটটির একটি সীমাবদ্ধতা হলো এর কার্যক্ষমতা থাকবে মাত্র ১৫ বছর এবং পুরো এই সময় ধরে স্যাটেলাইটটি নির্বিঘ্নে আমাদের সেবা দিয়ে যেতে সক্ষম। স্যাটেলাইট প্রকল্পটি বাস্তবায়নে খরচ হয়েছে প্রায় দুই হাজার ৭৬৫ কোটি কোটি টাকা। যার অর্ধেক সরকারি তহবিল এবং বাকি অর্ধেক বিভিন্ন বিদেশী সংস্থা হতে প্রাপ্ত। বাংলাদেশের স্যাটেলাইট চ্যানেলগুলোর দর্শকদের একটি বিশাল অংশ রয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে এবং আশা করা হচ্ছে , মধ্যপ্রাচ্যের এই দেশগুলো বাংলাদেশের স্যাটেলাইট এর প্রধান বাণিজ্যিক ব্যবহারকারী হবে। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ এর প্রধান কন্সট্রাকটর হিসেবে কাজ করছে স্পার্সো (SPARSO)।
দ্রুতগতি সম্পন্ন সম্প্রচারমাধ্যম
DTH সার্ভিস সাধারণত পৃথিবীর বিনোদনের জগতে ঢোকার অন্যতম দ্রুত এবং সহজ মাধ্যম। বর্তমানে দুটি কোম্পানির বাংলাদেশ সরকারের থেকে লাইসেন্স নিয়েছে; Beximco এবং Buyer Media limited. বঙ্গবন্ধু-১ সম্পূর্ণভাবে সচল হবার পর এর মাধ্যমে বাংলাদেশ ভারত, শ্রীলংকা এবং আফগানিস্তানের সাথে স্যাটেলাইটের মাধ্যমে যোগাযোগ স্থাপন করতে পারবে। এতদিন এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে শুধুমাত্র ভারতের নিজস্ব স্যাটেলাইট ছিল এবং বঙ্গবন্ধু-১ কৃত্রিম উপগ্রহটি উৎক্ষেপণের ফলে ভারতের পর এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে।
এছাড়াও বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট ভিডিও বার্তা সংযোগ বিভাগের কাজটিও খুব দ্রুত গতিতে সম্পন্ন করতে সহায়তা করবে। সম্প্রচারকারীরা তাদের বিষয়বস্তুগুলো খুব দ্রুত এবং সহজে ক্যাবল নেটওয়ার্কের মাধ্যমে সম্প্রচার করতে সক্ষম হবে। এছাড়া বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের VAST প্রাইভেট নেটওয়ার্ক রয়েছে যার সাথে সংযুক্ত থাকবে ভয়েস, ডাটা, ভিডিও, ব্যাংকিং ইন্টারনেট সার্ভিস এবং নানান কর্পোরেট অফিস ইত্যাদি।
এছাড়া বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের অন্যান্য সুবিধাগুলো হলো যদি বড় কোনো দুর্যোগের সম্মুখীন হয় দেশ; সে সময়ে সকল টেলিকমিনেকেশন বন্ধ হয়ে যেতে পারে কিন্তু স্যাটেলাইট নেটওয়ার্কের মাধ্যমে নিরবিচ্ছিন্ন টেলিকমিউনিকেশন ব্যবস্থা এবং সংযোগ স্থাপন করা সম্ভব। এছাড়াও দূরবর্তী এলাকাগুলো যেমন উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষেরা ইন্টারনেটের খুব ভাল এবং দ্রুত সংযোগ ব্যবস্থা উপভোগ করতে পারবেন। নিঃসন্দেহে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট বাংলাদেশকে খুব শীঘ্রই একটি উন্নত দেশে পরিণত হতে সাহায্য করবে।