দেশ বিদেশের বহু প্রতিভাধর ব্যক্তি আছেন যারা তাদের কীর্তির জন্য অমর হয়ে থাকবেন। কিন্তু কারো আক্রমণাত্মক লেখনী, আবার কারো বা ব্যক্তিগত জীবনের কুকর্ম সেই সমাজ মেনে নিতে পারেনি। শিল্পের নানান শাখায় প্রভাব রাখলেও আইনের কাছে, রাষ্ট্রের কাছে তারা দোষী হিসেবে শাস্তি হিসেবে পেয়েছিলেন নির্বাসন। আজ জানুন কয়জন বিখ্যাত সাহিত্যিকদের কথা যারা জন্মভূমি থেকে নির্বাসিত হয়েছিলেন।
১. সালমান রুশদি
উপমহাদেশের সবচেয়ে বিতর্কিত লেখক সালমান রুশদির জন্ম দেশ বিভাগের বছর ১৯৪৭ সালেই। ম্যাজিক রিয়েলিজম ও ডার্ক হিউমার তার রচনার বৈশিষ্ট্য। ভারতের মুম্বাইয়ে জন্ম নেওয়া রুশদির মিডনাইটস চিলড্রেন ব্যপকভাবে সমাদৃত ও পুরষ্কৃত হয়। তার চতুর্থ বই দ্য স্যাটানিক ভার্সের ১৯৮৮ সালে প্রকাশ হলে তা ইসলাম অবমাননার দায়ে অভিযুক্ত হয়। ভারতসহ বিভিন্ন মুসলিম দেশে তাকে অবাঞ্চিত ঘোষণা তো করা হয়ই, উপরন্তু তার মৃত্যু পরোয়ানা জারি করে ইরানের ধর্মগুরু।
বেশ কয়েকবার তাকে হত্যার চেষ্টা করা হয়। পরবর্তীতে যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র তাকে নাগরিকত্ব ও আশ্রয় দেয়। সেই ‘৮৮ এর পর থেকে ভারতছাড়া হয়ে প্যারিস, লন্ডন ও আমেরিকাতে নির্বাসনে আছেন ব্রিটেনের ‘নাইটহুড’ পাওয়া এই লেখক।
২. আর্নেস্ট হেমিংওয়ে
নোবেলবিজয়ী আমেরিকান সাহিত্যিক হেমিংওয়ে শুধু লেখনীর জন্যই না, বিখ্যাত তার বৈচিত্র্যময় জীবনের জন্যও। দুইটি বিশ্বযুদ্ধেই সক্রিয় অংশগ্রহণ ছাড়াও বিভিন্ন আন্দলনের সাথে জড়িত ছিলেন তিনি। সাংবাদিক হিসেবে খবর সংগ্রহের কাজে প্যারিস যান এবং স্বেচ্ছা নির্বাসনে ইউরোপে কাটান অনেকগুলো বছর।
যার প্রভাব ছিল তার অসাধারণ লেখনীতে। দক্ষিণ আমেরিকা, আফ্রিকা ও এশিয়াও তিনি কাটিয়েছেন অনেকটা সময়, সাক্ষী বেশ কয়েকটি যুদ্ধের। দেশ, কাল, কাটাতারের বাঁধা ডিঙিয়ে প্রায় প্ররধেক বিশ্ব নির্বাসনেই কাটিয়েছেন ‘ওল্ড ম্যান এন্ড দ্য সি’ খ্যাত লেখক।
৩. অস্কার ওয়াইল্ড
উনবিংশ শতাব্দীর অন্যতম সেরা ইংরেজ লেখক ও নাট্যকার অস্কার ওয়াইল্ড। নাটক, গল্প, উপন্যাস ও কবিতা- সবক্ষেত্রেই সমান দ্যুতি ছড়িয়েছেন লেখনীতে। তার লেখা গল্পগুলোর মতোই নাটকীয় তার জীবন। আয়ারল্যান্ডের উচ্চশিক্ষিত এক পরিবারের সন্তান হিসেবে তিনিও শিক্ষালাভ সম্পন্ন করেন দাপটের সাথে, বেশ কয়েকটি ভাষায় দখলও ছিল তার। সাংবাদিকতা দিয়ে লেখালেখি শুরু করেন, কবিতার দিকে ঝোঁক আসে সেই সময় থেকে।
এরপর থিয়েটারগুলোর সাফল্য দেখে সেদিকেও মন দেন এবং বেশ কয়েকটি সফল নাটক রচনা করেন। জীবনের নানা বাঁক বদলে মিশেছেন বহুস্তরের মানুষের সাথে। তবে জীবনের শেষের দিকে জড়িয়ে যান নানা বিতর্কে। সমকামিতা, ধর্ষণসহ লেখায় অশ্লীলতার অভিযোগ আসে তার নামে। কারাবরণ করতে হয় তাকে। সেখান থেকে বেরিয়ে নাম বদলে চলে যান ফ্রান্সে নির্বাসনে। ৪৬ বছর বয়সে সেখানেই করুণভাবে মারা যান এই লেখক।
৪. ভিক্টর হুগো
পুরো নাম ভিক্টর ম্যারি হুগো, বিশ্বের সর্বাধিক পঠিত বইগুলোর একটি তার রচিত ‘লা মিজারেবল’ । মজার ব্যাপার হলো, নির্বাসনের দিনগুলোতেই লেখা তার এই বিখ্যাত উপন্যাসটি। ফ্রান্সের সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্ম নিলেও সক্রিয়ভাবে রাজনীতিতে যুক্ত হন পরিণত বয়সে। রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে সমর্থন থাকায় সম্রাটের রোষানলে পড়তে হয় হুগোকে। অপরাধের সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদন্ড বাতিলের পক্ষে কথা বলেছিলেন সেই দেড় শতাব্দীর আগে।
মত প্রকাশের স্বাধীনতা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, গণতন্ত্রের পক্ষে কথা বলায় সম্রাট তৃতীয় নেপোলিয়ান তাকে দেশদ্রোহী ঘোষণা করে দেশত্যাগ করতে বাধ্য করেন। পরে বাধ্য হন বেলজিয়ামের ব্রাসেলসে যেতে। সেখানে কয়েক বছর থেকে বাধ্য হন নর্মান্ডি দ্বীপে নির্বাসন নিতে। তবে থেমে থাকেনি তার লেখনী বরং তার বিখ্যাত লেখনীগুলো এসময়েই লেখা।
৫. লর্ড বায়রন
জর্জ গর্ডন বায়রন, ইংরেজি সাহিত্যের কিংবদন্তী কবি। ১৭৮৮ সালে জন্ম নেন এক ধনাঢ্য পরিবারে। মাত্র ৩৬ বছরের জীবনেই তার অসামান্য কীর্তিতে বিশ্বনন্দিত। Don Juan কিংবা Childe Harold’s Plgrimage এর মতো গীতিকবিতা, She walks in Beauty এর মতো কালজয়ী কবিতার জন্য তিনি অমর হয়ে থাকবেন বহুকাল। জীবদ্দশায় যেমন জনপ্রিয় ছিলেন, তেমনি ছিলেন বিতর্কিতও।
সৎ বোনসহ একাধিক নারীর সঙ্গে সম্পর্ক ছাড়াও সমকামিতায় লিপ্ত থাকার অভিযোগ ওঠে তার নামে। সেসময় ব্রিটেনে সমকামিতার শাস্তি ছিল মৃত্যুদন্ড। যার দরুন দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হন বায়রন। ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ভ্রমণকালে সখ্যতা গড়ে ওঠে আরেক বিখ্যাত কবি শেলী ও পার্সির সাথে। অটোমান সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে গ্রিকদের পক্ষে যুদ্ধ করতে নামেন ৩৬ বছর বয়সে এবং ১৮২৪ সালে গ্রিসের মিসোলংগিতেই মৃত্যবরণ করেন।
৬. ভলতেয়ার
সপ্তদশ শতকের শেষদিকে জন্মানো ফ্র্যাংকোইস ম্যারি আরকোইট ছিলেন ফরাসি বিপ্লবের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব। ভলতেয়ার ছদ্মনামেই তিনি অধিক পরিচিত, নামটি তিনি বাস্তিল দূর্গে কারারুদ্ধ অবস্থা থেকে লেখালেখির সময় থেকে ধারণ করেন। তৎকালীন ফ্রান্সে তথা ইউরোপেই চলছিলো গোড়া ক্যাথলিক খ্রিস্টানদের প্রবল আধিপত্য, এমনকি রাজ্যশাসনের ক্ষেত্রেও পেছন থেকে কলকাঠি নাড়তেন তারা। ছিলো না মুক্তচিন্তা, শিক্ষা ও বাকস্বাধীনতা, তার বদলে ছিলো আরোপিত ধর্মীয় অন্ধবিশ্বাস। এক্ষেত্রে ফ্রান্সের দুজন ব্যক্তি তাদের লেখনী দিয়ে সর্বপ্রথম এগিয়ে আসেন জনগণকে উদ্বুদ্ধ করতে।
এদের একজন রুশো, আরেকজন ভলতেয়ার। তৎকালীন ফরাসি রাজা লুই ও চার্চের সমালোচনা করে লেখালেখির অভিযোগে যখন দ্বিতীয়বারের মতো কারারুদ্ধ হলেন, পত্রযোগে ব্রিটেনে যাওয়ার আমন্ত্রণ পান। কারামুক্ত হয়ে চলে যান লন্ডনে। পুরোপুরিভাবে না হলেও ফ্রান্স থেকে ব্রিটেন অনেকটা ধর্মীয় অন্ধবিশ্বাস ও গোঁড়ামিমুক্ত বলে মনে করতেন ভলতেয়ার। প্রায় তিন বছর প্রবাসে নির্বাসিত থেকে কেবল বসে থাকেননি, লিখেছেন অসংখ্য রচনা। পরবর্তীতে ফ্রান্সে যাওয়ার সুযোগ হয় এবং সেখানেই মৃত্যবরণ করেন এই বিখ্যাত দার্শনিক ও লেখক।
৭. দান্তে আলিগিয়েরি
মধ্যযুগের সাহিত্যের সবচেয়ে বিখ্যাত ও গুরুত্বপূর্ণ নাম। অসামান্য সাহিত্যিক কলাকৌশল তো বটেই, তার ডিভাইন কমেডি পরবর্তীতে বহু শিল্পী সাহিত্যিকের কাজের প্রেরণা হয়েছে। ইতালির ফ্লোরেন্সে জন্ম নেওয়া এই মহান ব্যক্তিকেও স্বদেশ ছেড়ে যেতে হয় সম্রাটের রোষানলে পড়ে। তিনি ছিলেন রোম সাম্রাজ্যের পক্ষে, বিপক্ষশক্তি ব্লাক গুয়েলফরা সে যুদ্ধে জিতলে দান্তেকে শহর ছাড়তে হয়। তার বিরুদ্ধে নানান অভিযোগ আনা হয়। জীবন বাঁচাতে চলে যান ইতালির ভেরোনা ও লুকায়। সেখানে গিয়ে লিখেন ডিভাইন কমেডির মতো অসামান্য কীর্তি।