ক্রমবর্ধমান বিশ্বায়নের এই যুগে মানুষ নিজের দেশের গন্ডি পেরিয়ে ছুটছে দেশান্তরে। শিক্ষালাভ, কর্মসুত্র কিংবা উন্নত জীবনযাপনের আশায় বিদেশ বিভূঁইয়ে মাথা গোঁজা মানুষগুলো শুধু নিজের দেশের মাটিই ছেড়ে আসে না, বেরিয়ে আসে নিজের ‘কমফোর্ট জোন’ থেকে। সম্পূর্ণ নিজের ব্যক্তিত্বের জোরে জায়গা করে নিতে হয় নতুন পরিবেশে। সমাজবিজ্ঞানীদের বেশ আকর্ষণের বিষয় এই প্রবাসী কিংবা অভিবাসীদের মনস্তত্ত্ব। বিশেষজ্ঞরা বলেন, প্রবাসজীবনের অভিজ্ঞতা মানুষের মধ্যে সৃজনশীলতা যেমন বাড়াতে সাহায্য করে, তেমনি সাহায্য করে নিজেকে সঠিকভাবে জানতে চিনতে; এতে কমে আসে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মধ্যকার দূরত্বও। আজ আলোচনা করা যাক প্রবাসজীবনে নিজেকে জানাশোনার সেই ব্যাপারগুলো নিয়ে।
১. নিজের সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা
দেশের বাইরে গেলে নিজের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার একান্তই আপনার। যেকোনো পরিস্থিতি কিভাবে সামাল দিচ্ছেন সেটাই দেবে আপনার ব্যক্তিত্বের পরিচয়। চেনা গন্ডির বাইরে, পরিচিতদের চোরা চোখ এড়িয়ে আপনার প্রতিটি আচরণের চিনতে পারবেন নিজেকে।
আপনি কে, কী আপনার লক্ষ্য আর কেমন মানুষ আপনি তার স্বরুপ উন্মোচিত হবে আপনার মাধ্যমেই। সম্প্রতি ২৯৬ জনের উপর করা অনলাইন জরিপের অর্ধাংশ, যারা প্রবাসী তাদের প্রায় শতভাগ এই বিষয়ে একমত যে, তারা নিজেদের সম্পর্কে ভালোভাবে জানে। অর্থাৎ স্থানীয়দের তুলনায় নানা ঘাত প্রতিঘাত মোকাবিলা করে প্রবাসীরা চিনতে পেরেছেন নিজেকে, নিজের আশা আকাংক্ষা, সীমাবদ্ধতা ও সামর্থের জায়গাটা।
২. বিশ্বাসের প্রতিফলন ঘটানোর সুযোগ
দেশে চেনাশোনা মানুষদের আচরণ ও কাজের চেনা ছক থেকে সহজে বেরোতে পারি না আমরা। লোকলজ্জা ও সুযোগের অভাবে বাধ্য হয়ে অনুসরণ করতে হয় কত শত প্রথা। কিন্তু দেশ থেকে বেরোলে নিজের বিশ্বাস থেকে, রুচি থেকে ও ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দ অনুযায়ী চলার সুযোগ হয়।
সেক্ষেত্রে ব্যক্তিত্ব সুনির্মানে এক বিরাট সুযোগ এনে দেয় একাকী এই প্রবাস জীবন। ভীনদেশীদের সাথে আপনার আচরণ ও কর্মক্ষেত্রে আপনার অবস্থান- সবকিছুই আপনি গড়ে নিতে পারেন নিজের মতোন, যা হয়তো এতদিনে আপনার আচরণ থেকে আলাদাও হতে পারে। বিশ্বখ্যাত একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের জরিপে দেখা গেছে, প্রবাসে আসা এক বিরাট অংশের জীবনধারায় পরিবর্তন আসে নিজের বিশ্বাস ও অভিরুচি অনুসারে চলার সুযোগ পেয়ে।
৩. দেশের বাইরের সময়গুলো গুরুত্বপূর্ণ
কোন দেশে থাকা হচ্ছে সেটার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, কতটা সময় আপনি দেশের বাইরে কাটাচ্ছেন। দেশে থাকতে আপনার চেনা গন্ডিতে হয়তো অনেককিছু আপনাকে না করলেও চলতো। কিন্তু প্রবাসে আপনার নিজের পেছনে ব্যয় করতে হয় পুরোটা সময়। নিজের ‘জুতো সেলাই থেকে চন্ডিপাঠ’ নিজেকে করতে হয়। এসময় নিজেকে চিনতে পারা যায় সহজে।
যেমন যিনি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকতে ভালবাসেন, তাকে অবশ্যই কিছু সময় রোজ দিতেই হবে নিজের আবাস ও কর্মস্থল পরিষ্কারের পেছনে। যিনি পড়তে ভালোবাসেন, তিনি নিশ্চিত নতুন দেশে গিয়ে ছুটে যাবেন বইয়ের দোকানগুলোতে। কোন দেশে থাকছেন সেটা গুরুত্বপূর্ণ না এক্ষেত্রে, প্রকৃতিপাগল মানুষ ভারতে থাকলেও যেমন ছুটবেন বন বা পাহাড়ের দিকে, তেমনি আমেরিকাতেও নব্য প্রবাসী ঠিক খুঁজে নেবেন তার পছন্দের অরণ্যানী।
৪. অন্যদের মতো করে নিজেকে নিয়ে চিন্তা করা
আপনি নিজেকে চিনেছেন ভাল কথা, নিজের দোষ যেমন ধরতে পেরেছেন, গুণগুলোও বুঝেছেন প্রবাসে এসে। এই চিন্তাটা কি স্রেফ বেকার মনের ভাবনা? না। আপনি নিজেকে যেমন দেখবেন, ঠিক অন্যরাও হয়তো সেভাবে ভাববে আপনাকে। ধরুন আপনি নতুন দেশের নতুন কর্মক্ষেত্রে ঢুকলেন আপনার দেশজ পোষাকে, কার আপনি মনে করেন আপনার উচিত আপনার দেশের প্রতিনিধি হিসেবে নিজেকে উপস্থাপন করা।
আপনার সহকর্মীরাও ঠিক বুঝে নেবেন, তাদের নতুন বন্ধুটি তার দেশের প্রতিনিধিত্ব বেশ আড়ম্বরেই করছেন। এভাবে আপনার চিন্তার আর বিশ্বাসের প্রতিফলন যখন আপনার কাজে ফুটবে, তখন আপনই যেমন বুঝতে পেরেছেন নিজেকে, সহকর্মীরাও আপনাকে সেভাবে বুঝতে পারবে।
৫. ক্যারিয়ার ও ভবিষ্যৎ নিয়ে আরেকবার ভাবার সুযোগ
ধরুন আপনি দেশ থেকে পছন্দের একটি বিষয়ে দক্ষতা নিয়েই কাজে এসেছেন, কিন্তু বিদেশে আরো ভালো সুযোগ থাকলেও আপনার মন যেন উড়ুউড়ু। কেননা আপনার মনের গভীরের কোনো কাঙ্ক্ষিত বিষয় ডানা মেলে দিয়েছে এই দূর প্রবাসে সুযোগের বিশাল আকাশ পেয়ে। রান্নাটা ধরুন আপনার শখ।
এদিকে আপনি একটু ঘরকুনোও বটে, সঙ্গ ও কাজের চাপ বিশেষ নিতে পারেন না। বাঁচার তাগিদে বিদেশে একটা কাজ করতে করতে মনে হলো, ঐ কাজ ছেড়ে যদি রান্নাটাকেই পেশা হিসেবে নিতে পারি মন্দ হয় না। এভাবে প্রবাসে এসে যখন নিজের সক্ষমতা ও আগ্রহের ব্যাপারগুলো স্পষ্ট হবে, আর সংশ্লিষ্ট বিষয়ের সুযোগও হাতছানি দেবে, তখন ভাবতেই পারেন ভবিষ্যৎ নিয়ে নতুন করে।
৬. চাঁদেরও কলঙ্কের মতো নিজেকে বুঝতে পারারও কিছু কুফল আছে
আপনি পড়াশুনা হোক বা কাজের সূত্রে হোক একরকম জীবনযাত্রা ছেড়ে এসেছেন। কিন্তু ছাড়তে পেরেছিলেন কি আপনার এতদিনের ধ্যান- ধারণা বা বিশ্বাস? শারীরিক সক্ষমতা কিংবা মানসিক চাহিদা, ইচ্ছা- অনিচ্ছা বা রুচিবোধ। আপনি প্রবাসে এসে যদি একবার বুঝে যান, এই জিনিসটা আপনার ‘Cup Of Tea’ না, আপনার ঐ কাজটায় আর মন আসবে না।
ধরুন, নতুন দেশের সংস্কৃতিতে আপনি তাল মেলাতে পারছেন না, কঠোর নিয়মকানুন মানায় আপনি অভ্যস্ত না, কিন্তু এদেশে নিয়মের বিরুদ্ধে গেলেই শাস্তি। এরকম পরিস্থিতে আপনি ভুলে যাবেন ‘তাল মিলিয়ে চলা’ বলে একটা কথা আছে। তখন মনে হবে, এটা আমার দ্বারা হয় না, ঐটা আমার দ্বারা হবেনা ইত্যাদি। এভাবে কাজেরও যেমন ক্ষতি, তেমনি নতুন কিছুর আনন্দ থেকেও হবেন বঞ্চিত।