অপেক্ষা মানুষের জীবনের অতি গুরুত্বপূর্ণ এক অনুসঙ্গ। দৈনন্দিন জীবনে নানা কারণে আমাদের অপেক্ষা করতে হয়। কিছু অপেক্ষা জীবনব্যাপী। যেমন দীর্ঘদিন পর মায়ের কাছে সন্তানের ফিরে আসার অপেক্ষা। কিছু অপেক্ষা তাৎক্ষণিক এবং মধুর। যেমন কাউকে ভালোবাসি বলার পর তার উত্তর শোনার অপেক্ষা। আবার কিছু অপেক্ষা দুঃসহ। যেমন ব্যাকুল স্ত্রীর যুদ্ধে যাওয়া স্বামীর ফিরে আবার অপেক্ষা। এসব অপেক্ষা একান্ত অনুভূতির সাথে সম্পর্কিত।
কিন্তু দৈনন্দিন জীবনে এমন কিছু অপেক্ষা আছে যা কোন বিশেষ অনুভূতি বহন করে না, বিশেষ কোন প্রাপ্তিও ঘটায় না, কেবল সময় ধ্বংস করে। আজ বলবো দৈনন্দিন জীবনে যাপন করা এমন ৫টি বিরক্তিকর অপেক্ষার কথা এবং একই সাথে জানাবো কেবল একটি পছন্দের বই সাথে রেখে আলাদা করে কোন সময় নষ্ট না করে বই পড়া এবং এমন বিরক্তিকর অপেক্ষা মধুর করে তোলা যায় কিভাবে।
ট্রাফিক জ্যাম ছাড়ার অপেক্ষা
ঢাকা শহরের বাসিন্দাদের জন্য ট্রাফিক জ্যাম এক দৈনন্দির ভোগান্তির কারণ। ২০১৭ সালের জুলাইয়ে বিশ্বব্যাংকের একটি গবেষণা প্রতিবেদনের উদ্ধৃতি দিয়ে দৈনিক প্রথম আলো জানায়, যানজটের কারণে ঢাকায় প্রতিদিন ৩২ লাখ কর্মঘন্টা নষ্ট হয়। যার কারণে বছরে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা আর্থিক ক্ষতি হয়। নিশ্চয়ই প্রতিদিন নষ্ট হওয়া এই ৩২ লাখ কর্মঘন্টার মধ্যে আপনারও কয়েক ঘন্টা আছে।
কার্যত যানজটে গাড়ির মধ্যে বসে থাকার সময় আমরা বিশেষ কোনো কাজ করি না। আবার পছন্দের কোনো বই পড়তে বাড়িতে আলাদা করে সময় বের করি। এখন থেকে বই পড়ার জন্য আলাদা করা সময়টুকু যানজটের মধ্যে ফেলে দিন। তাহলে আর যানজটে আটকে থাকার সময়টা মোটেও নষ্ট হবে না। প্রথম প্রথম কিছুটা অপ্রস্তুত লাগবে, কিন্তু কয়েক দিন চেষ্টা করলে অভ্যস্ত হয়ে যাবেন। তাছাড়া বাইরে চলার সময় হাতে একটা বই অন্যের চোখে আপনাকে আরও ব্যক্তিত্ববান করে তুলবে।
ট্রেনের অপেক্ষা
রেলস্টেশনের ওয়েটিং রুমে বসে ট্রেনের জন্য অপেক্ষা, এই ব্যাপারটার মধ্যে একটা শৈল্পিক ভাব আছে। কেননা অসংখ্য কালজয়ী গল্প, উপন্যাস, সিনেমায় ‘রেলস্টেশনে অপেক্ষা’ একটি অতি পরিচিত দৃশ্য! তাছাড়া আমাদের দেশে ট্রেনের সিডিউল বিপর্যয় একটা নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। ৮টার ট্রেন ১২টায় আসারও নজির আছে। তবুও ট্রেনে আমাদের চলতেই হয়। কেননা ট্রেন যাত্রা অধিক নিরাপদ ও সুলভ।
সুতরাং ট্রেনের জন্য অপেক্ষার এই সময়টা মধুর করে তোলা যায় প্রিয় কোন লেখকের সৃষ্টির মাঝে ডুব দিয়ে। তবে রেলস্টেশনে নিশ্চয় অর্থনীতির বই খুলে বসার পরামর্শ দিব না। তাতে হিতে বিপরীত হতে পারে; মুগ্ধতার বদলে জটিল অর্থনীতি আপনাকে বিরক্ত করে তুলতে পারে। আমি পরামর্শ দিব বহুবছর আগে লেখা কোন পুরনো বই খুলে বসুন, অথবা কোন রহস্য বা ভৌতিক উপন্যাস, ভ্রমণ কাহিনীও হতে পারে। আমি নিশ্চিত বলতে পারি ট্রেনের অপেক্ষা আপনার মধুময় হতে বাধ্য।
অফিসিয়াল সাক্ষাতের অপেক্ষা
কিছু মানুষের কাজই নতুন নতুন মানুষের সাথে সাক্ষাৎ করা। আমি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের জনসংযোগ কর্মী বা প্রতিনিধিদের কথা বলছি। সারাদিনে তাদের কাজ থাকে বিভিন্ন অফিস পরিদর্শন করে সেই প্রতিষ্ঠান প্রধান বা ঊর্ধ্বতন দায়িত্বপ্রাপ্তদের সাথে সাক্ষাত করে নিজের প্রতিষ্ঠানের পণ্য পরিচিত করানো বা ব্র্যান্ডিং করা। এক্ষেত্রে অনেক অফিসে গিয়ে কর্মকর্তাদের সাথে সাক্ষাৎ করতে অপেক্ষা করতে হয়। এই অপেক্ষার সময়ের অপচয় রোধ করা যায় শুধু সাথে একটা বই রেখে। তবে এক্ষেত্রে কোন গল্প বা উপন্যাস নয়, প্রবন্ধ নিবন্ধের বই রাখা যেতে পারে। কেননা গল্পের খুব রোমাঞ্চকর জায়গায় পৌঁছা মাত্রই যদি সাক্ষাতের ডাক পড়ে তাহলে মনে বিরক্তি আসতে পারে, অথবা আসল কাজের গুরুত্ব কমে যেতে পারে।
সুস্থতার অপেক্ষা
জীবনে কখনো অসুস্থ হয়নি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে না। সাধারণ সর্দি কাশি থেকে শুরু করে প্রাণঘাতী ব্যাধি আমাদের অজানতেই বাসা বাঁধে শরীরে। আবার কখনো হঠাৎ ঘটে যাওয়া কোন দুর্ঘটনায় অসুস্থ হয়ে পড়ি আমরা। এই অসুস্থতা কখনো কখনো হাসপাতালের বিছানা পর্যন্ত টেনে নিয়ে যায় আমাদের। হাসপাতালে থাকাকালীন যদি আপনার জ্ঞান থাকে এবং সবার সাথে স্বাভাবিক কথাবার্তা চালিয়ে যেতে পারেন, তবে ডাক্তারের অনুমতি নিয়ে ‘বই পড়া’ হতে পারে একঘেয়েমিতা কাটানোর সর্বোত্তম মাধ্যম। কেননা দীর্ঘদিন হাসপাতালে থাকলে একসময় তাকে সার্বক্ষণিক সঙ্গ দেওয়াও অনেক ক্ষেত্রে আপনজনদের জন্য অসম্ভব হয়ে পড়ে।
আবার বাড়িতে আসার পরও যদি কিছুদিনের জন্য ডাক্তার বিশ্রাম নিতে বলেন তাহলেও বই হতে পারে আপনার নিত্য সঙ্গী। তবে এসময় ইতিবাচক, সুন্দর এবং অনুপ্রেরণামূলক বই পড়াই বেশি উত্তম। তাহলে শরীরিক সুস্থতার পাশাপাশি মানসিক শক্তিও বাড়বে।
সাক্ষাতের অপেক্ষা
শুধু চাকরির প্রয়োজনে অফিসিয়াল সাক্ষাৎ নয়, কখনো কখনো ব্যক্তিগত প্রয়োজনেও কারো সাথে সাক্ষাৎ করতে হতে পারে। বিশেষ কোন দিনে বিশেষ কারো সাথে সাক্ষাতের দিন ঠিক হয়েছে। কিন্তু হতেই পারে তিনি আসতে কোনো কারণে দেরি করছেন। এ অবস্থায় আপনি যদি তার আসার অপেক্ষায় কেবল বসে থাকেন, তাহলে আপনি বিরক্ত লাগতে পারে। সাক্ষাতের পর তার সাথে পূর্ণ উদ্যমে হাসি মুখে কথা বলার ভাব নাও থাকতে পারে। কিন্তু আপনি যদি এই অপেক্ষা করার সময়টা পছন্দের কোন লেখকের বই পড়ে কাটান তাহলে আপনার মনেই হবে না আপনি এত দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করছেন। সুতরাং কথা বলার উৎসহ, উদ্যম হারানোর কোন প্রশ্নেই ওঠে না।March