অফিস একটি রাষ্ট্রের মত, আর সেখানকার কর্মীরা রাষ্ট্রের রাজনৈতিক কর্মীদের মত। রাষ্ট্র পরিচালনায় যেমন রাজনীতি থাকে তেমনি অফিসের কার্যক্রমেও রাজনীতি থাকে। রাষ্ট্রের রাজনীতি রাষ্ট্র পরিচালনা নিয়ে আর অফিসের রাজনীতি অফিস পরিচালনা নিয়ে। রাষ্ট্রীয় রাজনীতিতে ক্ষমতায় আসতে রাজনৈতিক দূরদর্শিতার যেমন কোনো কাঠামোবদ্ধ নিয়ম থাকে না, তেমনি অফিস পলিটিক্সে জিততেও কোনো কাঠামোবদ্ধ পদ্ধতি থাকে না।
অফিস পরিচালনার স্বাভাবিক নিয়ম নীতির বাইরে বিশেষ কিছু দক্ষতার প্রয়োজন হয়। নিজের অবস্থান ধরে রাখতে এবং উন্নতি করতে যারা সেটা করতে পারেন তারাই শীর্ষে আরোহণ করেন। যারা পারেন না তারা বছরের পর বছর একই অবস্থানে ঘুরপাক খেতে থাকেন।
আধুনিক বিশ্বের একজন কর্মজীবি হিসেবে আপনাকে অফিস পলিটিক্স বুঝতেই হবে। ইতিপূর্বে একটি নিবন্ধ আমি অফিস পলিটিক্স নিয়ে আলোচনা করেছি। আজকের নিবন্ধ এ বিষয়ে আরো কয়েকটি আচরণ নিয়ে আলোচনা করব। এই আচরণগুলো চর্চা করলে আপনি খুব সহজেই কর্মক্ষেত্রেই রাজনীতি নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারবেন এবং সকল বাধা অতিক্রম করে সাফল্য ছিনিয়ে আনতে পারবেন।
১. পক্ষ অবলম্বন করবেন না
অফিস পলিটিক্সের অন্যতম একটি প্রধান নিয়ামক মতপার্থক্য। কর্মীদের পরস্পরের মধ্যে মতপার্থক্য, মতভেদ থাকবেই। কিন্তু কেউ কেউ অন্যের মতকে গুরুত্ব না দিয়ে নিজের মত প্রতিষ্ঠা করতে চায়, অথবা কোনো একটি অর্জন নিজের বলে দাবি করতে চায়। এমন পরিস্থিতিতে মতপার্থক্য, মতভেদ বা বিবাদের সৃষ্টি হয়। পরস্পরের মধ্যে মতভেদ সৃষ্টি হলে একে অপরকে আটকে দেয়ার চেষ্টা করে।
আপনি প্রায়শই আপনার কাছাকাছি কর্মীদের কোনো একটি প্রকল্পের বিষয়ে বাদানুবাদে জড়িয়ে পড়তে দেখবেন, পরস্পরকে দোষারোপ করতে দেখবেন, অথবা কোনো কাজের কৃতিত্ব দাবি করতে দেখবেন। এমন পরিস্থিতি আপনার সম্মুখে সৃষ্টি হলে আপনার করণীয় কী হবে? একই প্রকল্পের তারা পরস্পর ভিন্নমত পোষণ করবে এবং প্রত্যেকেই কাজের কৃতিত্ব দাবী করবে, এমন অবস্থায় আপনি কী সিদ্ধান্ত নিবেন?
এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হলে আপনি কোনো পক্ষকে গুরুত্ব না দিয়ে প্রতিষ্ঠান স্বার্থ এবং লক্ষ্যের দিকে মনোযোগ দিন। উভয়ের মধ্যে সাধারণ যোগাযোগের পরিবেশ সৃষ্টি করুন। ভূলেও কোনো একটি পক্ষ অবলম্বন করবেন না। উভয়ের বক্তব্য শুনুন এবং বিচার-বিশ্লেষণ করে উভয়ের বক্তব্যের সমন্বয় করে তৃতীয় একটি মতামত উপস্থাপন করুন। এমনভাবে বিষয়টি সমাধান করুন যেন কেউ নিজেকে বঞ্চিত মনে না করে।
পক্ষ অবলম্বন না করে আপনি বরং সমস্যাটি সমাধানের কিছু উপায় বাতলে দিন। কিছু নির্দেশনা এবং নিয়ম-নীতি তাদের সামনে স্পষ্ট করে তুলে ধরুন। উভয়পক্ষের মনে বিশ্বাস স্থাপন করতে হবে যে, কাজটি সৃজনশীল এবং সব মতামতই গুরুত্বপূর্ণ। তবে সবার মতামতের ভিত্তিতে অবশ্যই প্রতিষ্ঠানের স্বার্থেই সম্মিলিত সিদ্ধান্ত নিতে হবেভ
২. কোনো কিছু ব্যক্তিগতভাবে গ্রহণ করবেন না
কাজ করতে গিয়ে কখনো কখনো আপনি অন্য কোনো সহকর্মীর উপর ক্ষেপে যেতে পারেন, বা অন্য কেউ আপনার উপর চড়াও হতে পারে। এটা হতেই পারে! এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হলে আপনার মনে হবে সেই ব্যক্তিকে আপনি শিক্ষা দিতে চান! না, এই কাজটি কখনোই করবেন না।
মানুষ সুখে থাকার মুহূর্ত ভুলে যায়, কিন্তু কারো দ্বারা অপমানিত বা প্রত্যাখ্যাত হলে তা কখনোই ভুলতে চায় না। আপনি যদি যুক্তি তর্কে জিতেও যান তবুও এই প্রবণতা থেকে বের হয়ে আসুন। যে সহকর্মীর সাথে আপনার ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব তৈরি হচ্ছে তাকে আপনার একদিন প্রয়োজন হবে। তার সাথেই মিলেমিশে আপনাকে কাজ করতে হবে। সুতরাং কোনো বিষয়ে মতপার্থক্য বা বৈপরীত্য ব্যক্তিগতভাবে গ্রহণ করবেন না।
অফিস পলিটিক্স জয় করার জন্য আপনি বরং বন্ধুত্বের নেটওয়ার্ক গড়ে তুলতে পারেন। অফিসের মধ্যেই আপনার বন্ধুর সংখ্যা বাড়াতে পারেন। যে কোনো সংকট উত্তরণে সহকর্মীদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করুন। কর্মক্ষেত্রে ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব পরস্পরের মধ্যে কেবল খারাপ সম্পর্ক সৃষ্টি করে।
এমনকি আপনি যদি একজন সেরা কর্মী হয়ে থাকেন তবুও আপনাকে কর্মক্ষেত্রের রাজনীতি মোকাবেলা করতে হবে। আপনার অবস্থান এবং আপনার বসের অবস্থানের মধ্যে অফিশিয়াল যে দূরত্ব তা বজায় রাখুন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সেরা কর্মী হলে আপনাকে আরো বেশি রাজনীতির সম্মুখীন হতে হবে এবং সুকৌশলে সবকিছু মোকাবেলা করেই এগিয়ে যেতে হবে।
৩. অন্যকে বোঝানোর আগে নিজে বোঝার চেষ্টা করুন
অফিসে এই কাজটি হরহামেশাই হয়। অন্যকে বোঝার আগে আমরা ভেবে নিই আমাকে সে বুঝবে। ভুল বোঝাবুঝির সূত্রপাত হয় এখান থেকেই, আর এখান থেকেই শুরু হয় রাজনীতি। আমরা নিজেরা বোঝার চেষ্টা করি না, অথচ অন্যকে বোঝানোর চেষ্টা করি। বিচক্ষণ ঊর্ধ্বতনরা এই প্রবৃত্তি দমন করতে জানেন।
অন্যকে বুঝতে চাওয়া অনেকটা নিজেই হেরে যাওয়ার শামিল! সবকিছুতেই জিতে যাওয়ার প্রবৃত্তি থেকে মানুষ এই অভ্যাস আয়ত্ত করেছে। আপনার অবস্থান থেকে মনে হয় আপনি যা বলছেন বা করছেন তা সঠিক, কিন্তু অন্যের দৃষ্টিতে তা সম্পূর্ণ ভুল বলে মনে হয়। আমরা নিজের চোখ দিয়ে সব কিছু দেখি আর অন্যদের বোঝানোর চেষ্টা করি। কখনও অন্যের চোখ দিয়ে দেখার চেষ্টা করি না। এই প্রবণতা থেকে বের হওয়া প্রয়োজন।
অন্যকে না বুঝে যদি ক্রমাগত তাকে বোঝানোর চেষ্টা করেন তাহলে আপনার শত্রু বাড়তেই থাকবে, আর এক অমীমাংসীত রাজনৈতিক অবস্থার সৃষ্টি হবে। কিন্তু উন্মুক্ত যোগাযোগ এবং আলোচনার মাধ্যমে অন্যকে বোঝার চেষ্টা করলে এই সমস্যা খুব সহজেই সমাধান করা যায়।
৪. একা জিতে যাওয়ার প্রবণতা ত্যাগ করুন
শিশুকাল থেকে চারদিকের পরিবেশ আমাদের জিতে যাওয়া শেখায়। স্কুল, কলেজ, পরিবার, পরিবেশ-প্রতিবেশ সবাই আমাদের শেখায় জীবন যুদ্ধে জিততে হবে এবং সবকিছুকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যেতে হবে। সব সময় আমাদের জিতে যাওয়ার শিক্ষা দেয়া হয়। আমরা ভেবে নিই নিজে জিতে যাওয়ার অর্থ হলো অন্য কেউ হেরে যাওয়া। একই কারণে অন্য কেউকে জিতে যেতে দেখলে আমরা তা পছন্দ করি না। কেননা অন্যভাবে তা নিজের পরাজয় নিশ্চিত করে।
কিন্তু কর্মক্ষেত্র কোনো দৌড় প্রতিযোগিতা নয়। অন্যান্য প্রতিযোগিতা আর কর্মক্ষেত্র এক নয়।
কর্মক্ষেত্রে কিভাবে আমরা উভয় জিতে যেতে পারি সেই পন্থা অবলম্বন করতে হবে। সেই কৌশল আমাদের রপ্ত করতে হবে। তার জন্য সর্বপ্রথম আপনাকে অন্যের দৃষ্টিকোণ বুঝতে হবে এবং তার জায়গায় আপনি থাকলে কী কী করতেন তা ভাবতে হবে। এরপর নিজের অবস্থান স্পষ্ট করতে হবে। যে কোন সমস্যায় উভয় পক্ষের কাছে গ্রহণযোগ্য এবং কল্যাণকর সমাধান খুঁজে বের করতে হবে। এমন উপায় অবলম্বন করতে হবে যাতে উভাই পক্ষ সম্মানিত হয় এবং ঘটনার সাথে সম্পর্কিত সবাই কৃতজ্ঞ থাকে।
অন্যকে হারিয়ে দেওয়ার প্রবণতা যদি আপনি কর্মক্ষেত্রেও বাস্তবায়ন করতে চান তবে অচিরেই আপনি বন্ধু শুন্য হয়ে যাবেন। কর্মক্ষেত্রে আপনাকে সহযোগিতা করার মতো কাউকে খুঁজে পাবেন না। সুতরাং শুধু নিজে জিতে যাওয়া নয়, সব পক্ষকে নিয়ে এগিয়ে যেতে পারলেই তা দীর্ঘমেয়াদে বিজয় নিশ্চিত করে।
অফিস পলিটিক্সে কেবল পরস্পর বিরোধিতা নয়, একসাথে সহ-অবস্থান করেও সকলে এগিয়ে যাওয়া যায়, সাফল্য ছিনিয়ে আনা যায়।