উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার পরপরই শিক্ষার্থীরা নির্দিষ্ট বিষয়ে ভর্তি হয়ে নিজেদের ক্যারিয়ারের দিকে পা বাড়ায়। বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তির পরপরই যেই বিষয়ে ভর্তি হই সাধারণত সেই বিষয়েই আমাদের ক্যারিয়ার গড়ে ওঠে। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সময় শিক্ষার্থীদের সাবজেক্ট চয়েজ নিয়ে বেশ দুশ্চিন্তায় থাকতে দেখা যায়। কোন বিষয়ে পড়ে বেশি টাকা উপার্জন করা সম্ভব ? এই প্রশ্নটি বেশিরভাগ শিক্ষার্থীরই মূখ্য প্রশ্ন হয়ে দাঁড়ায় তখন। নানান জন নানান দৃষ্টিকোণ থেকে এই প্রশ্নের উত্তর দিয়ে থাকেন। কেউ বলেন মেডিকেল, কেউ বলেন IBA, একেক জনের একেক অভিমত।
কিন্তু সম্প্রতিকালে বৃটেনের একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান অনুসন্ধানের পর এই প্রশ্নটির উত্তর একটি পরিসংখ্যানের মাধ্যমে প্রকাশ করেছেন। পরিসংখ্যানটিতে বিভিন্ন বিষয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের গড় সম্পদের পরিমাণ তুলে ধরা হয়েছে।
এখন প্রশ্ন হল কোন পেশার মানুষ সবচেয়ে সম্পদশালী?
গবেষকদের উত্তর – ইঞ্জিনিয়ারদের! হ্যাঁ, প্রকৌশলীরাই পৃথিবীর বেশিরভাগ অর্থের মালিক।
সম্পদশালী ইঞ্জিনিয়ারদের বেশিরভাগই আবার প্রযুক্তির সাথে যুক্ত। পরিসংখ্যান বলছে, বিলিওনিয়ারদের মধ্যে যাদের ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রী আছে তাদের গড় সম্পদের পরিমাণ ২৬.৭৭ বিলিয়ন ডলার। যা অন্যান্য ডিগ্রীধারীদের তুলনায় সর্বোচ্চ! বর্তমানে পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি আমাজনের প্রতিষ্ঠাতা জেফ বেজোস যিনি একজন কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার, মেক্সিকান টেলিকম ব্যবসায়ী কার্লোস স্লিম যার সম্পদের পরিমাণ ৬৪.৩ বিলিয়ন ডলার, তিনি ছিলেন একজন সিভিল ইঞ্জিনিয়ার, গুগলের সহ-প্রতিষ্ঠাতা লরি পেইজ ছিলেন একজন কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার।
তালিকায় ২য় অবস্থানে আছেন যাদের কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রী নেই। এরা অনেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হননি কিংবা ভর্তি হলেও কোনো ডিগ্রী অর্জন করতে পারেননি। পরিসংখ্যান মতে, বিলিওনিয়ারদের মধ্যে যাদের কোনো ডিগ্রী নেই তাদের গড় সম্পদের পরিমাণ ২৪ বিলিয়ন ডলার। এই তালিকায় আছেন মাইক্রোসফটের প্রতিষ্ঠাতা বিল গেটস (হার্ভার্ডের ড্রপ আউট), ফেসবুকের প্রতিষ্ঠাতা মার্ক জাকারবার্গ (তিনিও হার্ভার্ডের ড্রপ আউট), স্ন্যাপচ্যাটের প্রতিষ্ঠাতা ইভান স্পিজেল (স্টেমফোর্ডের ড্রপ আউট), স্টিভ জবস (তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে পা দেননি) – এরকম আরো অনেক বিখ্যাত বিলিওনিয়ার আছেন এ তালিকায়।
তালিকায় তৃতীয় অবস্থানে আছেন বিজনেস স্টাডিজ ডিগ্রী ধারীরা। পরিসংখ্যান মতে, বিলিওনিয়ারদের মধ্যে যারা বিজনেস স্টাডিজে ডিগ্রীধারী তাদের সম্পদের গড় পরিমাণ ২২.৫ বিলিয়ন ডলার। বিখ্যাত ইনভেস্টর ওয়ারেন বাফেট বিজনেস স্টাডিজে ডিগ্রীধারী ছিলেন।
তালিকায় এরপরই আছে আর্টস, অর্থনীতি, ম্যাথ প্রভৃতি সাবজেক্টে ডিগ্রীধারীরা।
ফোর্বসের হিসাবে বর্তমানে পৃথিবীতে বিলিওনিয়ার আছেন সর্বমোট ২,০৪৩ জন। সবচেয়ে বেশী বিলিওনিয়ার আছে যুক্তরাষ্ট্রে মোট ৫৬৫ জন, চীনে আছে ৩১৯ জন, জার্মানীতে ১১৯ জন, ভারতে ১০১ জন। তবে মহাদেশ হিসেবে এশিয়াই এগিয়ে আছে। এশিয়াতে সর্বমোট বিলিওনিয়ারের সংখ্যা ৭১৯ জন, উত্তর আমেরিকাতে আছে ৬৩১ জন আর ইউরোপে ৫৫৯ জন। বাংলাদেশের ৪-৫ জন বিলিওনিয়ার আছেন, যদিও ফোর্বস লিস্টে তাদের নাম নেই তাদের মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য মূসা বিন শমসের (প্রায় ১২ বিলিয়ন ডলারের মালিক), বেক্সিমকো গ্রুপের চেয়ারম্যান সালমান এফ রহমান( সাড়ে পাঁচ বিলিয়ন ডলারের মালিক), বসুন্ধরা গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা আহমেদ আকবর সোবহান (তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজনেস স্টাডিজে স্নাতক ডিগ্রী সম্পন্ন করেছিলেন)।
পৃথিবীর অন্যান্য দেশের ইঞ্জিনিয়ারদের অবস্থা বেশ উন্নত হলেও আমাদের দেশের ইঞ্জিনিয়ারদের অবস্থা খুব একটা সুবিধাজনক অবস্থানে নেই। এর কারণ আমাদের দেশে মানসম্মত শিক্ষাদানকারী ইঞ্জিনিয়ারিং প্রতিষ্ঠান হাতে গোনা দু-একটি মাত্র। তাছাড়া আমাদের দেশের আইটি সেক্টর এবং অন্যান্য ভারী শিল্প-কারখানাসমূহ এখনো ভালোভাবে গড়ে উঠেনি। খুব অল্প পরিমাণে থাকলেও সেগুলোতে অল্প সংখ্যক ইঞ্জিনিয়ারই নিয়োগ পাচ্ছেন এবং তাদের বেতন স্কেলও অন্যান্য দেশের ইঞ্জিনিয়ারদের তুলনায় বেশ কম। এই সমস্ত কারণে দেশের মেধাবী ইঞ্জিনিয়াররা এখন বিদেশে পাড়ি জমাতে বাধ্য হচ্ছেন।
ফোর্বসের টপ ৪০০ বিলিওনিয়ারের মধ্যে ৬৩ জনই আছেন যাদের শুধুমাত্র হাইস্কুল পর্যন্ত পড়েছেন। ৩৫ জন আছেন যাদের আইন বিষয়ক ডিগ্রী আছে, ২৯ জনের বিজ্ঞানে মাস্টার্স ডিগ্রী আছে, ২১ জন পিএইচডি ডিগ্রী (জেমস সিমনস উল্লেখ্যযোগ্য) আছে এবং মাত্র পাঁচ জনের মেডিকেল সাইন্সের (থমাস ফ্রিস্ট, ফিলিপ ফ্রস্ট উল্লেখ্যযোগ্য) উপর ডিগ্রী আছে।
যদি টপ ১০০ বিলিওনিয়ারের হিসাব করি তাহলে দেখা যায়, তাদের মধ্যে ২২ জনই ইঞ্জিনিয়ার এবং বিজনেস স্টাডিজের ১৬ জন।
কেন বিলিওনিয়ারদের অধিকাংশই ইঞ্জিনিয়ার?
বিলিওনিয়ারদের পরিসংখ্যানে সবদিক দিয়েই এগিয়ে আছেন ইঞ্জিনিয়াররা। তাহলে প্রশ্ন হলো কেন ইঞ্জিনিয়াররাই অন্যান্য পেশার মানুষ হতে বেশি সম্পদশালী?
এর কারণ ইঞ্জিনিয়াররা ইঞ্জিনিয়ারিং পেশা ছাড়াও যেকোনো ফিল্ডে সহজেই নিজেদের মানিয়ে নিতে পারেন যা অন্যান্য বিভাগের ছাত্রদের মধ্যে তেমন একটা দেখা যায় না। এছাড়া মোটামুটি সব দেশের মেধাবীরাই পেশা হিসেবে ইঞ্জিনিয়ারিংকে বেছে নেওয়ার কারণে বিলিওনিয়ারদের মধ্যে অধিকাংশই ইঞ্জিনিয়ারদেরকেই দেখা যায়।
বর্তমানে আমাদের দেশের ইঞ্জিনিয়াররাও সব ধরণের পেশাতেই জড়িয়ে পড়ছেন। বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোতে আপনি প্রচুর ইঞ্জিনিয়ার দেখতে পাবেন। সারা বিশ্বের উদ্যোক্তাদের মধ্যে অধিকাংশরই ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রীধারীদেরকেই দেখা যায়।
বর্তমান পৃথিবীতে যে সেক্টরটি সবচেয়ে এগিয়ে যাচ্ছে সেটি হল আইটি সেক্টর। পৃথিবীর সব দেশই আইটি সেক্টরে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। আইটি সেক্টরে ইঞ্জিনিয়াররাই সবচেয়ে বেশি প্রবেশ করছে। শতকরা ১৯% বিলিওনিয়ার আইটি সেক্টরে যুক্ত আছেন। আর আইটি সেক্টরের সাথে যুক্ত বিলিওনিয়াররা অন্যান্য সেক্টর হতে দ্রুত বিলিওনিয়ার হতে পেরেছেন।
সম্প্রতি কানাডারও একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান অনুসন্ধান চালিয়ে বিভিন্ন পেশার মানুষের আয়ের উপর একটি জরিপ তুলে ধরেন। জরিপটি পনের হাজারেরও বেশি মানুষের উপর চালানো হয় এবং তাদের বিগত বিশ বছরের (১৯৯১ সাল হতে ২০১০ সাল পর্যন্ত) গড় আয়ের পরিমাণ তুলে ধরা হয়। সেই জরিপে দেখা যায় বিগত বিশ বছরে অন্যান্য যেকোনো পেশার চাইতে ইঞ্জিনিয়ারদের আয়ের পরিমাণ সর্বোচ্চ যা প্রায় ১.৮৫ মিলিয়ন ডলার।