শুধু হলিউড, বলিউডের সিনেমা নয়, সারাবিশ্বের যেকোনো যুদ্ধের মুভিতে আপনি রাডারের দেখা পাবেন। সবুজ রঙের একটি ডিসপ্লে, যেখানে চারপাশের অবস্থিত বস্তু, শত্রুপক্ষের জাহাজ অথবা আবহাওয়ার পরিস্থিতি দেখা যায়। বাস্তবিক জীবনে রাডার কতখানি গুরুত্বপূর্ণ তার সম্পর্কে একটি উদাহরণ উল্লেখ করা যেতে পারে। ধরুন, আপনাকে বিশাল বিশাল দালান ভর্তি শহরের মাঝে কুয়াশা ভরা গভীর রাতে একটি জাম্বো জেট বিমান নিয়ে শর্ট স্ট্রিপ রানওয়েতে ল্যান্ড করতে হবে। আপনি কিভাবে নিশ্চিতভাবে বলতে পারবেন অথবা কোনভাবে আশা করতে পারবেন যে, নিরাপদে ল্যান্ড করা সম্ভব?
বলা যায় অসম্ভব একটি কাজ। তবে রাডার ব্যবহারের ফলে বর্তমানে বিমানের পাইলটরা এমন পরিস্থিতিতে কোনো সমস্যা অনুভব করেন না। রাডারের পুরোদস্তুর শুরু হয়েছিলো ডেভলপমেন্ট দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে। শত্রুপক্ষের বিমান সনাক্তকরণ আর রাতের অন্ধকারে আক্রমণের জন্য এর কোনো বিকল্প ছিলো না। বর্তমানে পুলিশ বাহিনী রাডারের ব্যবহার করে স্পিড ডিটেক্টর গান থেকে শুরু করে আবহাওয়ার অবস্থাও জানতে পারে।
ইতিহাস
রাডার কিভাবে কাজ করে তার পূর্বে ছোট্ট করে জেনে নেওয়া যাক এর ইতিহাস। রাডার নিয়ে প্রথম গবেষণা করেন জার্মান বিজ্ঞানী হেনরিচ হার্টস। ১৮৮৬ সালে হেনরিচ দেখান, রেডিও ওয়েব নিরেট বস্তু হতে প্রতিফলন করে। এরপর অসংখ্য বিজ্ঞানীর বিভিন্ন গবেষণায় পর ১৯০৪ সালে জার্মান ইনভেন্টর ক্রিস্টিয়ান হলসমায়ার রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি সাহায্যে দূরবর্তী বস্তু চিহ্নিত করা সম্ভব, এটা প্রমাণ করেন। তিনি এ কাজে ব্যবহার করেছিলেন সাধারন এক ট্রান্সমিটার। যা কুয়াশায় আচ্ছন্ন জাহাজের অবস্থান বের করতে সক্ষম ছিলো।
যদিও জাহাজের অবস্থান বেশি দূরে ছিলো না। তবে তিনি হাল ছাড়েননি। একই বছরের সেপ্টেম্বরে তিনি রাডারের সম্পূর্ণ ডিজাইন পেটেন্ট করেন। যার নাম দেওয়া হয়েছিলো টেলিমোবিলোস্কোপ। স্পার্ক গ্যাপের সাহায্যে তিনি ৫০ সে.মি রেডিও পালস সিগনাল তৈরি করে এই রাডার কাজ করতো। তবে জার্মান মিলিটারির অফিসিয়াল পরীক্ষায় এই প্রজেক্ট পাস করতে পারেনি।
১৯২২ সালে ইউনাইটেড স্টেট নেভির গবেষক এ. হ্যট টেলর আর লিও সি. ইয়ং পটোমাক নদীর দুইপ্রান্তে ট্রান্সমিটার আর রিসিভার বসান। তারা আবিষ্কার করেন যখন কোনো জাহাজ নদী পারাপার করে তখন এর সিগনালের পরিবর্তন ঘটে। টেলর এই বিষয়টি রিপোর্ট করেন, আর অনুরোধ করেন বিষয়টি খতিয়ে দেখতে।
তিনি রিপোর্টে উল্লেখ করেছিলেন, এই প্রযুক্তি বৈরি আবহাওয়ায় এবং যুদ্ধক্ষেত্রে কাজে দিবে। তবে সাথে সাথেই নেভি এই প্রজেক্টটি নিয়ে কাজ শুরু করেনি। দীর্ঘ ৮ বছর পর, বিমানের ক্ষেত্রেও যখন নেভাল রিসার্চ সেন্টারের বিজ্ঞানী লওরেন্স এ. হেল্যান্ড একই বিষয় পর্যবেক্ষণ করে রিপোর্ট করলেন তখন প্রাতিষ্ঠানিকভাবে এর কাজ শুরু হয়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার পূর্বে প্রায় সকল দেশই গোপনে রাডার টেকনোলজির উপর গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছিলো। জাপান, ইতালি, জার্মানি, ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং নেদারল্যান্ডের হাত ধরেই মূলত আধুনিক রাডারের উৎপত্তি ঘটে। তবে পিছিয়ে ছিলো না হাঙ্গেরি, কানাডা, সাউথ আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া অথবা নিউজিল্যান্ড। রাডারের ব্যাপক উৎপাদন সর্বপ্রথম সোভিয়েত ইউনিয়নে শুরু হয়। লেলিনগ্রেদ ইলেক্ট্রোফিজিক্যাল ইন্সটিটিউটটের বিজ্ঞানী পি. কে. ওশেপেকভ ১৯৩৪ সালে, তার তৈরি রাডার দিয়ে ৩ কিলোমিটার দূরের বিমান ডিটেক্ট বা সনাক্ত করতে সক্ষম হন।
তার এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে একই বছরে RUS – 1 ব্যাপকভাবে উৎপাদন করা হয়ে। RUS – 2 এর দেখা মিলেছিলো ১৯৩৯ সালে ওশেপেকভেরই হাত ধরে। তবে এরপর ভিন্ন একটি কারণে ওশেপেকভ গ্রেফতার হওয়ায় রাডারের উন্নয়ন প্রায় বন্ধই হয়ে গিয়েছিলো। প্রথম এয়ারবর্ন রাডার ‘জেনেসিস ২’ তৈরি হয়েছিলো এই সোভিয়েত ইউনিয়নেই। যেটা ব্যবহার হয়ছিলো পেতলাকভ পি-টু ডবল ইঞ্চিন বিমানে। পি-টু মূলত একটি হালকা ধরনের বোম্বার বিমান।
রাডার কি আর কিভাবেই বা কাজ করে
ইতিহাস তো অনেক জানা হলো। এবার রাডার সম্পর্কে কিছু তথ্য জেনে নেওয়া যাক। RADAR এর সম্পূর্ণ রুপ হচ্ছে Radio Detection And Ranging। যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনী সর্বপ্রথম ১৯৪০ সালে এই শব্দটি ব্যবহার করে।
রাডার কী অথবা কিভাবে কাজ করে এটা বুঝতে হলে আমাদের সর্বপ্রথম বুঝতে হবে আমরা কিভাবে চোখে দেখতে পাই। আমরা যখন কোনো বস্তুর দিকে তাকাই, তখন সূর্য বা অন্য কোন সোর্স থেকে আসা আলো সেই বস্তুতে প্রতিফলিত হয়ে আমাদের চোখে এসে পৌছায়। যার ফলাফল স্বরুপ আমরা বস্তুটিকে দেখতে পাই। আমরা জানি সকল প্রকার আলোই তরঙ্গের একটি রুপ। যখন সূর্যের আলো অথবা অন্ধকারে টর্চের আলো তরঙ্গরুপে কোনো বস্তুর উপর প্রতিফলিত হয়ে আমাদের চোখে পৌঁছায় তখন আমরা শুধু বস্তুটিকেই দেখি না, সাথে সাথে তার অবস্থান এবং দূরত্ব মাপতে সক্ষম হই। রাডারও তরঙ্গের এই একই পদ্ধতি ব্যবহার করে।
জাহাজ বা বিমানে অথবা ভূমি যেখানেই রাডার বসানো হোকনা কেন এর কিছু বেসিক যন্ত্রপাতির প্রয়োজন হয়।
১. ম্যাগনেট্রন
যে যন্ত্রটি রেডিও ওয়েভ তৈরি করে। রেডিও ওয়েভ আর আলো দুটোই ইলেকট্রো ম্যাগনেটিক বর্ণালীর একটি অংশ। তার মানে দাঁড়ায় বৈদ্যুতিক আর চৌম্বকীয় তরঙ্গের মাধ্যমে তাদের তৈরি করা সম্ভব। আরো সহজভাবে বললে, মাইক্রোওয়েভ ওভেনের মতো ম্যাগনেট্রন মাইক্রোওয়েভ তৈরি করে। পার্থক্যটা হচ্ছে এটা অনেক শক্তিশালী, যার কারণে বহু মাইলে দূরে পাঠানো সম্ভব হয়।
২. ট্রান্সমিটার
যে অংশটি ম্যাগনেট্রনে তৈরিকৃত রেডিও সিগনাল প্রেরণ করে। সিগনাল পাঠানোর কাজটি মূলত এন্টেনা করে থাকে।
৩. রিসিভার
প্রতিফলিত সিগনাল যে অংশটি গ্রহণ করে। ট্রান্সমিটার থেকে পাঠানো রেডিও বিমের গতি আলোর গতির সমান। যেহেতু আলো এবং রেডিও ওয়েভ মূলত একই জিনিস। তাই যদি কোন জেট বিমান ৫ হাজার কিলোমিটার বেগেও উড়তে থাকে এরপরও রেডিও সিগানাল বিমানে প্রতিফলিত হয়ে ফিরে আসতে কোন সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় না। ট্রান্সমিটারে যে এন্টেনা সংযুক্ত সেই একই এন্টেনা রিসিভারে সাথে যুক্ত থাকে। ডুপলেক্সারের সাহায্যে এন্টেনা ট্রান্সমিশন ও রিসিভিং উভয় কাজেই ব্যবহৃত হয়।
৪. ডিসপ্লে
অপারেটর সহজে বোঝার জন্য যেখানে রিসিভারের তথ্য দেখানো হয়।
রাডারের বর্তমান ব্যবহার
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় শুধুমাত্র যুদ্ধের কাজে রাডার ব্যবহার করা হলেও এখন এর ব্যবহারের পরিসর অনেক বৃদ্ধি হয়েছে। এখন বিশ্বের সকল এয়ারপোর্টের গ্রাউন্ড স্টেশনে রাডার ব্যবহার হয়। যাত্রীদের নিরাপত্তার খাতিরে সকল ধরনের বিমানে রাডারের ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এছাড়া সমুদ্রে শুধু মিলিটারী নয়, সাধারণ যাত্রীবাহী যাহাজেও রাডার ব্যবহৃত হচ্ছে।
মিসাইল ডিটেকশন, শত্রুপক্ষের জাহাজ অথবা বিমান আক্রমণের আগাম পেতে সকল দেশেই অসংখ্য রাডার স্টেশন ব্যবহার করছে। রাডারের অনেক সুবিধা থাকলেও এর কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। যেমন, পানির নিচে বিশেষত সাবমেরিনে রাডার কোনে কাজ আসে না। তাই সেখানে রাডারের বিকল্পে তৈরি করা হয়েছে সোনার ডিটেকশন সিস্টেম। তবে সোনার নিয়ে কথা হবে অন্যদিন আরেক ফিচারে।
Source:
- Radar Handbook by Merrill Skolnik
- Introduction to Airborne Radarby George W. Stimson
- Principles of Modern Radar: Basic Principles
- Instruments of Darkness: The History of Electronic Warfare by Alfred Price
- Britain’s Shield: Radar and the Defeat of the Luftwaffe by David Zimmerman
- Building Radar: Forging Britain’s Early-warning Chain, 1935-45 by Colin Dobinson