ধীরে ধীরে শেষ হয়ে যাচ্ছেন আপনি এবং হয়তো টেরও পাচ্ছেন না! কারণ- আপনার কমফোর্ট জোন (চির চেনা গণ্ডী)। আপনার জীবনের স্বপ্ন আকাঙ্ক্ষাকে বুঝতে, কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে, সত্যিকারের সুখ খুঁজে পেতে আপনাকে এটা থেকে বেরিয়ে আসতেই হবে। কিন্তু এতে খারাপের কী আছে? স্বস্তিতে থাকাটাই তো সুখে থাকা, তাই না?সেটাই যদি হত! কিন্তু বাস্তবে আপনি যতই আপনার গণ্ডীতে আটকে থাকবেন, সুখ থেকে আপনি ততই দূরে সরে যাবেন। তাহলে আমরা কেন কমফোর্ট জোনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকি?
কারণ কিছু একটা করতে কিছুটা নড়তে হয়, মানে কাজ করতে হয়। এটাই প্রকৃতির নিয়ম। বিজ্ঞানের ভাষায় শক্তি খরচ করা মানেই হচ্ছে কাজ করা। কিন্তু যেহেতু আমরা আমাদের কথা বলছি, এখানে শক্তি খরচ মানে হচ্ছে অনুপ্রাণিত হওয়া। কোনো অনুপ্রেরণা না থাকায় আমরা নিজেদের এমন একটা জায়গায় আটকে রাখি যেখানে আমরা কখনোই পুরোপুরি সুখি হতে পারি না। আমাদের মনে হয়, নিজের গণ্ডীর বাইরে বেরিয়ে আসলে যে কষ্টটুকু সইতে হবে, তার চেয়ে যেখানে আছি সেখানে থাকাটাই বেশি স্বস্তির তা যতই অতৃপ্তিকর হোক না কেন। কিন্তু কমফোর্ট জোন থেকে বের না হয়ে আপনি জীবনের মহামূল্যবান তিনটি উপহার হারাচ্ছেন। “একজন নিরাপত্তার দিকে দৌড়াতে পারে, অথবা উন্নতির দিকে। উন্নতিই বার বার বেছে নেওয়া উচিৎ, ভয়কে বার বার জয় করতে হবে।”
– আব্রাহাম ম্যাসলো
১. এটা আপনাকে বাড়তে দিচ্ছে না
আপনি হয় বড় হচ্ছেন না হয় মারা যাচ্ছেন। শুনতে বাড়াবাড়ি মনে হচ্ছে এবং এটি একটু বাড়াবাড়িই, কিন্তু একে শাব্দিকভাবে নিলে চলবে না। সুখী জীবনের প্রধান শর্তই হচ্ছে উন্নতি, অন্তত আধুনিক মনোবিজ্ঞান সেদিকেই নির্দেশ করে। ‘দ্যা হ্যাপিনেস এডভান্টেজ’ এর লেখক, মনোবিজ্ঞানী শন একর সুখকে সংজ্ঞায়িত করেছেন, “নিজের সম্ভবনার দিকে এগিয়ে যাওয়ার আনন্দ” হিসেবে। এখানে মূল ব্যাপারটা হচ্ছে- এগিয়ে যাওয়া।
বেড়ে ওঠা মানে উন্নতি করা। উন্নতি হচ্ছে পদক্ষেপ নেওয়া। আর এই পদক্ষেপটি হতে হবে নিজের গণ্ডী ভেতর থেকে বেরিয়ে আসার। সুতরাং আপনি যখন আয়েশ করে নিজের গন্ডির ভেতর বসে থাকছেন, আপনি বড় হচ্ছেন না। কারণ আপনি কোনোদিকে আগাচ্ছেন না। বড় হওয়া মানে আমরা এখন যেমন আছি তার চেয়েও ভালো কিছু হওয়া। সেটা হওয়ার একমাত্র রাস্তা হচ্ছে নিজের চেনাজানার বাইরে যা আছে সেটার মুখোমুখি হওয়া। এর জন্য আপনাকে কমফোর্ট জোন থেকে বেরিয়ে আসতেই হবে।
২. এটি আপনাকে নতুন কিছু করতে দিচ্ছে না
সম্ভবত জীবনের সবচেয়ে বড় সংগ্রাম হচ্ছে নিজের তাড়না খুঁজে বের করা এবং সেটাতে দক্ষ হতে উঠে পড়ে লাগা। আমরা এটা যেমন ব্যক্তিগত স্বার্থে করি, তেমনি বৃহত্তর স্বার্থেও করি। আমাদের মধ্যে যারা একটু ভাগ্যবান, তারা অনেক কম বয়সেই বুঝতে পারে তারা কী করতে চায়। তারা মন থেকে জানে যে এটাই তাদের করা প্রয়োজন এবং সেটাতে ভালো করতেই তারা মনোনিবেশ করে, এর প্রতিটা মুহুর্ত উপভোগ করতে করতে। আর আপনি যদি আমার মতো হয়ে থাকেন, তাহলে আপনার সম্ভবত জীবনের ২০-৩০ বছর কেটে গেছে এটা সেটা করতে করতে এবং আপনার একটা আবছা আবছা ধারণা আছে আপনি কী চান। আমাদের বেশির ভাগেরই অনেক সময় লেগে যায় এটা বুঝতে যে আমরা কী ভালোবাসি, আমরা সবচেয়ে বেশি কী চাই এবং এটাই স্বাভাবিক। এই সময়টায় নতুন নতুন কিছু করতে হয় এবং এতে বোঝা যায় আমরা কোনটি ভালোবাসি এবং কোনটি ভালোবাসি না। সমস্যা এখানেই। যতক্ষণ আপনি কমফোর্ট জোনে আছেন, ততক্ষণ আপনি নতুন কিছু করতে পারবেন না (হয়তো খুব চাপে পড়ে দুই একবার করবেন)।এভাবে আপনার জীবনের উপলব্ধির ব্যাপারটা থেমে যাবে, আপনি বুঝতেও পারবেন না আপনার গভীরতম তাড়না কী। এভাবে আপনি সত্যিকার সুখ জিনিসটাও কখনো খুঁজে পাবেন না।
৩. এটি আপনাকে থামিয়ে দেয়
আপনি যদি আপনার গণ্ডীর মধ্যেই রয়ে যান, পরবর্তীতে আরো একটা ব্যাপার আপনার সুখ আর সমৃদ্ধির পথে হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। সেটা হচ্ছে থেমে যাওয়া। যখন আমরা আমাদের গভীরতম তাড়নাকে খুঁজে বের করতে পারি না, একটা পর্যায়ে এসে আমরা ক্লান্ত হয়ে যাই। তখন আমরা আমাদের যা আছে সেটা নিয়েই থিতু হয়ে যাই। এর চেয়ে দুর্ভাগ্যজনক পরিণতি আর হতে পারে না। আমরা তখন আর ঠিক বেঁচে থাকি না। যে জীবনে আমরা সুখি নই, সেই জীবনে আমরা বেঁচেও মরেই থাকি, কোনো ঝুঁকি না নিয়ে। তার চেয়েও বাজে ব্যাপার হচ্ছে, এইসময় যদি আপনার জীবনে কোনো সুযোগ এসেও থাকে, আপনি অবচেতনভাবে হলেও পিছু হটবেন কারণ তখন আপনি আপনার তথাকথিত স্বস্তির বৃত্তের বাইরে আসতে ভয় পাবেন।
মার্টিন লুথার কিং জুনিওর এ সম্পর্কে চমৎকার কথা বলেছেনঃ
“আপনি হয়তো আমার মতই ৩৮। হয়তো একদিন আপনার সামনে একটা বিশাল সম্ভবনা এসে দাঁড়ালো, যার জন্য আপনাকে দাঁড়াতে হবে ন্যায়ের সাথে, রুখে দাঁড়াতে হবে কোনো বিশাল অসংগতির বিরুদ্ধে, সাড়া দিতে হবে কোনো মহান উদ্দেশ্যের টানে এবং আপনি সরে আসবেন কারণ আপনি ভীত। আচ্ছা, তাহলে আপনি হয়তো ৯০ বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকবেন কিন্তু আপনি আসলে মরে গেছেন সেই ৩৮ এ, সেই থেকেই আপনি মৃত যেমনটা আপনি থাকবেন ৯০ বছর বয়সে। আপনার যে শ্বাস প্রশ্বাসের থেমে যাওয়া, সেটা আসলে আপনার আত্মার অকালমৃত্যুরই একটা বিলম্বিত ঘোষণা।”
কিভাবে জিতবেন কমফোর্ট জোনের বিরুদ্ধে?
আপনার কমফোর্ট জোন আপনাকে যেভাবেই আপনাকে নিয়ন্ত্রণ করুক না কেন, ধৈর্যের সাথে সঠিক ভাবে চেষ্টা করলে বেশ সহজেই এর থেকে বেরিয়ে আসার অভ্যাস গড়া যায়। আপনাকে শুধু জানতে হবে সঠিক কৌশল। আমি যখন তরুণ ছিলাম, আমার এক জোড়া পুরনো জুতা ছিল যেটা আমি প্রায়ই পরতাম। সেইগুলা একেবারেই ছিঁড়া আর ফাটা ছিল। মাঝে মাঝে আমার বিশাল বুড়ো আঙ্গুলটা উঁকি মারত যেটা অবধারিত ভাবে অনেকের দৃষ্টি কাড়ত এবং তারা কটাক্ষের চোখে তাকাত আমার দিকে। আমি আসলে এটা ফ্যাশন হিসেবে করতাম না। আমি এটা করতাম কারণ এটা আমাকে অস্বস্তিতে ফেলে দিত। আমি জুতাগুলা যতই পরতাম, ততই আমি অস্বস্তির সাথে সহজ হয়ে উঠতাম। এটা কেন করা লাগবে?
চালটি হচ্ছে নিজের গন্ডির ভেতরে থাকার প্রবণতাকে ধোঁকা দেওয়া, নিজের সীমাবদ্ধতা থেকে বেরিয়ে আসার অভ্যাস করা এবং সুস্থিতভাবে আগানো। এটা আপনার পিছুটান কমিয়ে আনবে। আমাদের সামনে যখন সুযোগ আসে, ভয় আমাদের পিছন থেকে আঁকড়ে ধরে। নিজের গণ্ডী থেকে বেরিয়ে আসার সময় আমরা এটারই মুখোমুখি হই। কিন্তু আপনি যদি প্রথম কদমটা রাখেন, তাহলে পরের কদমটা বাড়িয়ে দেওয়ার প্রবণতাটাও বেড়ে যায়, সেটা আরো বড় কিছু হোক না কেন। পিছুটান কমিয়ে আনা বলতে এটাই বুঝায়। মজার ব্যাপার হচ্ছে, এটা আপনার উদ্দেশ্যের সাথে সম্পর্কিত না হলেও চলে। ছোট কিছু একটা হলেই হবে যেটা আপনাকে তৈরি করবে। যখনই আপনি গন্ডি থেকে বেরিয়ে আসবেন, আপনার আত্মবিশ্বাস তৈরি হবে। এটাই সবচেয়ে বেশি দরকার।
কমফোর্ট জোনকে পরাস্ত করার তিনটি ধাপ
এই তিনটি ছোট ধাপ আপনাকে কমফোর্ট জোন থেকে বেরিয়ে আসার শক্তি জোগাবে, সহজাতভাবে।
১. ফেলে রাখা কাজের তালিকা করুন
যে কাজগুলো না করে ফেলে রেখেছেন সেগুলার একটি তালিকা বানান। ডাক্তারের এপয়েন্টমেন্ট, মেঝে মোছা, অথবা কাউকে কিছু জিগ্যেস জিজ্ঞাসা করা। যাই হোক, ছোট হোক, এমন কিছু যা আপনি কয়েক সপ্তাহ বা তারও বেশি সময় ধরে এড়িয়ে যাচ্ছেন।
২. তালিকা থেকে অন্তত একটা ছোট কাজ করুন
এখনই ছোট একটা কাজ শেষ করুন যেটা আপনি সপ্তাহের পর সপ্তাহ ফেলে রেখেছেন। সেটা মেঝে মোছার মত সাধারণ কাজও হতে পারে, এমন কিছু হলেই হবে যেটা আপনি করতে চাইছেন না এবং ফেলে রেখেছেন (এটি একটি লক্ষণ যে কাজটা আপনার কমফোর্ট জোনের বাইরে)।
৩. এগোতে থাকুন
ছোট একটি কাজ করে এবং কমফোর্ট জোন থেকে খানিকটা বেরিয়ে এসে আপনার সামর্থ্য আর আত্মবিশ্বাস তৈরি হবে আরেকধাপ আগানোর এবং এতে আরো বেরিয়ে আসতে পারবেন কমফোর্ট জোন থেকে। কাজটি শেষ হলে তালিকা থেকে আরেকটি কাজ বেছে নিন। এরকম চালিয়ে যান ততক্ষণ পর্যন্ত যতক্ষণ না আপনার আত্মবিশ্বাস তৈরি হচ্ছে। গণ্ডী থেকে বেরিয়ে আসাটা খানিকটা কঠিন হলেও, যতই এটা করবেন, এটা ততই সহজ হয়ে আসবে (অস্বস্তির সাথে স্বস্তিবোধ করা)। অল্প অল্প করে আগাতে থাকুন, একটা সময় কমফোর্ট জোন থেকে বেরিয়ে আসাটা অভ্যাস হয়ে যাবে। এটাই আমাদের লক্ষ্য। তা আপনার প্রথম কদম কী হতে যাচ্ছে?