বলা হয় মানব সভ্যতা আজ থেকে প্রায় ছয় হাজার বছর আগে মেসোপটেমিয়ান অঞ্চল থেকে শুরু হয়। কিন্তু সেই বহুকাল আগের কথা জানার আজ আর কোনো উপায় নেই। সরাসরি কোনো উপায় নেই তারা কী ভাবতো, কী করতো সেসব জানার। কিন্তু উৎসুক মানুষেরা বসে নেই কখনোই। প্রযুক্তির ব্যবহার তো আছেই তাছাড়া মাটি খুঁড়ে, পানি সেঁচে তারা প্রাচীন পৃথিবীর ধ্বংসাবশেষ খুঁজেই ছাড়বে। সেই হাজার বছর আগে হয়তো ছিলো না এখনকার মতো প্রযুক্তির উৎকর্ষতা। তবুও বহু পুরনো স্থাপনা ও স্থানবিশেষ আজও সাক্ষ্য দেয় অত্যন্ত চমৎকার স্থাপত্যশৈলীর ও যোগান দেয় আশ্চর্যজনক সব তথ্য। ইতিহাসের পাতায় কিংবা নানান উপকথায় পাওয়া সেই স্থান ও স্থাপনাগুলোর মধ্যে বিশেষজ্ঞেরা কয়েকটিকে সেই সময়কার আশ্চর্যজনক স্থাপনা বলে বিবেচনা করেন। কোনোটি অক্ষত, কোনোটি ভগ্নপ্রায়, আবার কোনোটি বা শুধু রয়েছে বইয়ের পাতায়ই। জানুন প্রাচীন পৃথিবীর এমন সপ্তাশ্চর্য সম্পর্কে।
১. মিশরের পিরামিড
মরুভূমির দেশ মিশরেই গড়ে উঠেছিল এক উন্নততর সভ্যতা। প্রাচীন মিশরে ফারাও রাজবংশের রাজারা যেসময় রাজত্ব করতেন সেসময়ে মিশরের মানুষেরা বেশ কিছু অদ্ভুত বিষয়ে বিশ্বাস করত। তাদের বিশ্বাস ছিল—মৃত্যুর পর তাদের মৃতদেহ যদি অক্ষত অবস্থায় সংরক্ষণ করা হয়, তাহলে তারা পরলোকে অনন্ত শান্তির জীবন যাপন করতে পারবে। এজন্য তারা বিশেষ করে মিশরের ফারাও সম্রাট ও ধনাঢ্য ব্যক্তিরা মৃত্যুর পর তাদের দেহকে অমর করার লক্ষ্যে মমি করে রাখতো। এই মমিকে আবার রাখা হতো পিরামিডের গোপন কুঠুরীতে, অনেক অনেক ধন-রত্নের সাথে। প্রায় চার হাজার বছর আগে নির্মিত মিশরের সেসব পিরামিড এখনো অক্ষত আছে। সবচেয়ে উচু পিরামিড হল খুফুর পিরামিড, যা প্রায় ১৩ একর জায়গাজুড়ে বিস্তৃত।
২. ব্যাবিলনের শূন্য উদ্যান
যেকোনো বাগানে গিয়ে বিভিন্ন রঙের ফুল, প্রজাপতি এসব দেখতে কার না ভালো লাগে! আর বাগানটি যদি হয় মাটি থেকে উঁচুতে, অনেকটা উপরে, তাহলে তো কথাই নেই! এরকমই একটি বাগান হলো ব্যাবিলনের শূন্য উদ্যান। আমরা সবাই জানি ইরাক দেশটির অধিকাংশ জুড়েই রয়েছে মরুভূমি। অনেক দিন আগে এই দেশেই ব্যাবিলন নামে একটি শহর ছিল। এ শহরটি গড়ে উঠেছিল ইউফ্রেটিস নদীর তীরে। এই বাগানটি অনেক আগেই ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। কয়েক বছর আগে কিছু বিজ্ঞানী ব্যাবিলনের এই উদ্যানটির কিছু ভাঙা দেয়াল খুঁজে পেয়েছেন বলে দাবি করেছেন।
৩. আর্টেমিসের মন্দির
প্রাচীন যুগে গ্রিস এবং রোমের অধিবাসীরা বিভিন্ন দেবদেবীর পূজা করতো। প্রাচীন গ্রিসের এক দেবীর নাম ছিল আর্টেমিস। রোমানরা আবার তাকে বলতো দেবী ডায়ানা। দেবী আর্টেমিস বা ডায়ানা ছিলেন শিকারের দেবী। সেই যুগে বেশিরভাগ মানুষ শিকার করেই জীবিকা নির্বাহ করত বলে দেবী আর্টেমিসের গুরুত্ব ছিল অনেক। এজন্যই গ্রিকরা খ্রিস্টপূর্ব ৮০০ অব্দে ইফিসাস নগরীতে দেবী আর্টেমিসের মন্দির নির্মাণ করে। এই ইফিসাস নগরীটি বর্তমানে আমাদের কাছে পরিচিত তুরস্ক হিসেবে। তৈরি হওয়ার পর থেকে বহুবার এই মন্দিরটি ধ্বংস হয়ে যায়।
৪. অলিম্পিয়ার জিউসের মূর্তি
গ্রিকদের প্রধান দেবতার নাম জিউস। তিনি সব দেবদেবীর তুলনায় অনেক বেশি শক্তিশালী। খ্রিস্টপূর্ব ৪৩৫ অব্দে গ্রিকরা অলিম্পিয়া নগরীতে মন্দির নির্মাণ করে সেখানে দেবতা জিউসের একটি বিশাল মূর্তি স্থাপন করে। এটি উচ্চতায় ছিল প্রায় ৪০ ফুট। এই বিশাল মূর্তিটি দেখতেও ছিল অসাধারণ। মূর্তিটির বিশালতা ও সৌন্দর্যের কারণেই এটি প্রাচীন পৃথিবীর আশ্চর্যগুলোর মধ্যে একটি। জিউসের মন্দির তৈরির আরও একটি বিশেষ উদ্দেশ্য ছিল অলিম্পিক। পৃথিবীর বিশাল এই খেলার আসরটিকে দেবতা জিউসের আশীর্বাদপুষ্ট করতেই জিউসের এই বিশাল মূর্তিটি তৈরি করা হয়েছিল। তবে বর্তমানে মূর্তিটির খুব সামান্য অংশই অবশিষ্ট আছে।
৫. হ্যালিকারনেসাসের সমাধি
৬. আলেকজান্দ্রিয়ার বাতিঘর
সমুদ্রে ভেসে বেড়ানো জাহাজগুলোকে বন্দরে ভিড়তে ও রাত্রে চলাচলের জন্য সমুদ্রের তীরে বিশেষ করে বন্দরে বাতিঘর নির্মিত হতো। আমাদের দেশেও বাতিঘর দেখতে পাওয়া যাবে উপকূলবর্তী অঞ্চলগুলোতে। তবে সবচেয়ে প্রাচীন যে বাতিঘরটি বিশ্বজুড়ে বেশ বিখ্যাত ছিলো সেটি হলো আলেকজান্দ্রিয়ার বাতিঘর। মিশরের আলেকজান্দ্রিয়া শহরের নামকরণ করা হয় মহাবীর আলেকজান্ডার উক্ত অঞ্চল দখল করলে। নীল নদের তীরে আলেকজান্দ্রিয়ার ফারোস দ্বীপে অবস্থিত ছিলো সেই বাতিঘরটি।
বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রায় ২৭০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে এটি নির্মাণ করেন সম্রাট দ্বিতীয় টলেমি। প্রায় ৪০০ ফুট উচ্চতার এই বাতিঘরটি নীলনদে ভাসমান জাহাজগুলোকে অন্ধকারে পথ দেখানো ছাড়াও ছিলো স্থাপত্যবিদ্যার এক অপার নিদর্শন। গ্রীক পন্ডিত সস্ট্রাটোস এর নকশা অনুসারে নির্মিত এই স্থাপনাটি বিভিন্ন সময়ের ভূমিকম্প ও ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে ১৩৫০ সালের দিকে পুরোপুরি ধব্বংসপ্রাপ্ত হয়ে পড়ে। ধারণা করা হয়, এটির গঠনে ছিল টলেমি বা আলেকজান্ডারের একটি মূর্তি, যা এখন সুদূর অতীত ও প্রত্নতাত্ত্বিকদের বিতর্কের বিষয়।
৭. রোডসের মূর্তি
রোডসের মূর্তিটির অবস্থান নিয়ে বিতর্ক থাকলেও এর জনপ্রিয়তা নিয়ে দ্বিমত নেই। আটলান্টিকের রোডস দ্বীপ ছিল একসময় সমুদ্রকেন্দ্রিক ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ স্থান। সামুদ্রিক ঝড় থেকে বাঁচতে ও তাদের সূর্যদেবতাকে খুশি রাখতে দেবতা হেলিও’র মূর্তি নির্মাণ করেন তারা। খ্রিষ্টপূর্ব ২৮০ সালের দিকে এটির নির্মাণ কাজ শেষ হয়। মেসিডোনিয়ান সম্রাট আলেকজান্ডার ও আরবরা পরবর্তীতে ঐ অঞ্চল দখল করলে ব্রোঞ্জ নির্মিত এই মূর্তিটি ধ্বংসের মুখে পড়ে নানা কারণে। মূর্তিটিতে সূর্য দেবতা বন্দরের দুই পাশে পা দিয়ে হাতে লন্ঠন নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন, যেন প্রাচীন আমলের এক স্ট্যাচু অব লিবার্টি।