বর্তমানে একটা কথা প্রচলিত আছে, “পৃথিবীতে এখন এমন একটিই জায়গা আছে যেটা এই মুহূর্তে সিলিকন ভ্যালির মতো হওয়ার চেষ্টা করছে না, আর সেটা হচ্ছে সিলিকন ভ্যালি।”
“সিলিকন“ শব্দটি কোথাও শুনলে এর সাথে যে শব্দগুলো চট করে মাথায় আসে সেগুলো বিভিন্ন ধরণের সেমিকন্ডাক্টর ডিভাইসের সাথে সম্পৃক্ত, যেমন- ডায়োড, ট্রানজিষ্টর। কিন্তু ভ্যালি? সিলিকন ভ্যালি কি তাহলে সেমিকন্ডাক্টর ডিভাইসের কোনো শহর?
কেমন সায়েন্স ফিকশন গল্পের মতো শোনাচ্ছে, তাই না? অনেকটা তাই বলা চলে। না, এটা কোনো গল্পের শহর নয়। কিন্তু সাই-ফাই অনেক গল্পের বাস্তব প্রতিচ্ছবি বলাই যেতে পারে একে। সিলিকন ভ্যালি সেমিকন্ডাক্টর ডিভাইসের শহর না হলেও সিলিকন ভ্যালি হচ্ছে সেমিকন্ডাক্টর ডিভাইস তৈরির শহর। হাই টেক প্রতিষ্ঠান গুলোর স্বর্গভূমি। সাধারণত যে কোনো প্রতিষ্ঠানকে আলাদা একটা প্রাণ বলে ধরে নেওয়া হয় বই খাতার হিসেবে। এমনকি মানুষের মতো প্রতিটা প্রতিষ্ঠানেরও সমাজের প্রতি কিছু দায়িত্ব-কর্তব্য থাকে। সে হিসেবে সিলিকন ভ্যালি হচ্ছে প্রযুক্তি থেকে জন্ম নেয়া প্রাণগুলো নিয়ে গড়ে উঠা শহর। যেখানে গুগল, ফেইসবুক, লিংকডিন, টুইটার, উবার, ইউটিউব, ইয়াহু, অ্যাপেল, ইন্টেল, আসুস, নাসার মতো একেকটা প্রাণের সৃষ্টি ও বেড়ে ওঠা।
অবস্থান
উত্তর ক্যালিফোর্নিয়ার সান ফ্রান্সিস্কোর দক্ষিন উপকূলীয় এলাকা জুড়ে সিলিকন ভ্যালি গড়ে উঠেছে। যা এখন তথ্য ও প্রযুক্তি, উদ্ভাবন এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের গ্লোবাল সেন্টারে পরিণত হয়েছে।
সানজোস হচ্ছে ভ্যালির সবচেয়ে বড়, ক্যালিফোর্নিয়ার ৩য় বৃহত্তম এবং আমেরিকার বড় শহর গুলোর মধ্যে ১০ম। সিলিকন ভ্যালির অন্য বড় শহর গুলো হচ্ছে পালোআলটো, সান্তাক্লেয়ার, মাউন্টেইন ভিউ এবং সানিভেল। সানজোস মেট্রোপলিটন হচ্ছে পৃথিবীর সর্বোচ্চ জিডিপি উপার্জনকারী অঞ্চল।
সিলিকন ভ্যালির ইতিহাস ও যাদের হাত ধরে সিলিকন ভ্যালির পথ চলা শুরু
১৮০০ শতকের শেষের দিকে সানফ্রান্সিস্কো পোর্ট টেলিগ্রাফ ও রেডিও ইন্ডাস্ট্রির জন্মভূমি হিসেবে সিলিকন ভ্যালির পথ চলা শুরু। ১৯৩৯ সালে আমেস রিসার্চ সেন্টার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে এটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির আবাসভূমি হিসেবে অধিষ্ঠিত হয়। এ সময়েই উইলিয়াম হাওলেট এবং ডাভ প্যাকার্ড হাওলেট প্যাকার্ড প্রতিষ্ঠিত করেন, যার কাজ ছিল অসিলোস্কোপ তৈরি করা।
তারপর ১৯৪০ সালে উইলিয়াম সক্লে বেল ল্যাবে নতুনভাবে ট্রানজিষ্টর তৈরি করেন। যেটা বর্তমানে কম্পিউটার প্রসেসর হিসেবে পরিচিত। ১৯৫৬ সালে সক্লে বেল ছেড়ে নিজের “সক্লে সেমিকন্ডাক্টর ল্যাব” প্রতিষ্ঠা করেন ক্যালিফোর্নিয়ার মাউন্টেইন ভিউতে। যেখানে উইলিয়াম সক্লে কিছু স্ট্যানফোর্ড গ্রাজুয়েটদের নিয়োগ করেন।
১৯৫৭ সালে ৮ জন স্ট্যানফোর্ড গ্রাজুয়েট “সক্লে সেমিকন্ডাক্টর ল্যাব” ছেড়ে শারমেন ফেয়ারচাইল্ডের সাথে যোগ দিয়ে ফেয়ারচাইল্ড সেমিকন্ডাক্টর নামের প্রতিষ্ঠানটি প্রতিষ্ঠা করেন। যাদেরকে পরবর্তীতে উইলিয়াম সক্লে “দস্যু আট” হিসেবে অভিহিত করেন।
তারপর এই “দস্যু আট” ফেয়ারচাইল্ডও ছেড়ে দেন এবং গরডান মোর ও রবার্ট নয়চের সাথে নিজের কোম্পানি প্রতিষ্ঠিত করেন ১৯৬৮ সালে যেটা এখন ইন্টেল নামে পরিচিত। পরবর্তীতে এই আট দস্যু এএমডি (AMD), এনভিডিয়া (Nvidia) এবং ভেনচুরি ফান্ড প্রতিষ্ঠিত করতে সাহায্য করেন।
১৯৬৯ সালে স্ট্যানফোর্ড রিসার্চ ইন্সটিটিউট আরপানেট (ARPANET) এর সাথে যোগ দেয়। আরপানেট হচ্ছে একটি সরকারী প্রোজেক্ট, যার ফলশ্রুতিতে ইন্টারনেটের উদ্ভাবন ঘটে। ১৯৭০ সালে জোরক্স পালোআলটোতে পার্ক (PARC) ল্যাব প্রতিষ্ঠিত করেন। পার্ক প্রাথমিক গণনার প্রযুক্তি উদ্ভাবন করে। যার মধ্যে ইথারনেট ও গ্রাফিকাল ইউজার ইন্টারফেস অন্যতম। ১৯৭১ সালে সাংবাদিক ডন হফলার ৩ পর্বের একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেন সেমিকন্ডাক্টর ইন্ডাস্ট্রি নিয়ে, যার হেডিং ছিল “সিলিকন ভ্যালি ইউএসএ”। পরবর্তীতে এই নামই পরিচিত হয় বিশ্বব্যাপী তথ্য-প্রযুক্তির স্বর্গ হিসেবে।
১৯৭০ সালে আটারি (Atari), অ্যাপল (Apple) এবং ওরাকল (Oracle) এর মতো প্রতিষ্ঠান গুলোর জন্ম হয়। ইতিহাস বদলে দেয়া ই-বে (eBay), ইয়াহু (Yahoo), ফেসবুক (Facebook), টুইটার (Twitter), উবার (Uber), টেসলা (Tesla), পেপাল (PayPal) এবং গুগল (Google) এর মতো প্রতিষ্ঠানের উদ্ভব হয় ৯০এর দশকে। এই হলো টেক বিশ্বের রূপকথার সেই রাজ্য প্রতিষ্ঠা লাভের বাস্তব ইতিহাস।
সিলিকন ভ্যালির সেরা দশে থাকা প্রতিষ্ঠান সমূহ
বর্তমানে সিলিকন ভ্যালি প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনের জন্মস্থানের প্রতিশব্দ। আধুনিক বিশ্বের প্রাণকেন্দ্রও বলা চলে একে। সংক্ষিপ্তভাবে জেনে নেয়া যাক এর সেরা দশ প্রতিষ্ঠান (মোট সম্পদ ও বাৎসরিক উপার্জনের উপর ভিত্তি করে) সম্পর্কে যারা সিলিকন ভ্যালিকে এনে দিয়েছে সিলিকন ভ্যালির মর্যাদা।
১. অ্যাপল (Apple)
হেডকোয়ার্টার: কুপারটিনো , ক্যালিফোর্নিয়া।
২০০৭ সালে আইফোন বাজারে নিয়ে আসার মাধ্যমে যার সুখ্যাতি অতীতের সব ব্রান্ডের ইতিহাসকে ছাড়িয়ে যায়। এটি মূলত স্মার্টফোন ও গ্যাজেট নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান। যদিও এর যাত্রা শুরু হয় ১৯৭৭ সালে উদ্ভাবনী প্রতিষ্ঠান হিসেবে।
২০১৬ সালে আয় $২০০ বিলিয়ন ছাড়িয়ে যায়।
২. গুগল (Google)
হেডকোয়ার্টার: মাউন্টেন ভিউ , ক্যালিফোর্নিয়া।
পৃথিবীব্যাপী সবচেয়ে জনপ্রিয় সার্চ ইঞ্জিন। ২০১৬তে মোট আয়ের পরিমাণ ছিল $৯০ বিলিয়ন যার মধ্যে লাভের পরিমান $১৯ বিলিয়ন।
৩. ফেসবুক (Facebook)
হেডকোয়ার্টার: মেনলো পার্ক, ক্যালিফোর্নিয়া।
ফেসবুক সম্পর্কে আলাদা করে বলার আর কিছু নেই। সারা পৃথিবীতে ব্যবহারকারীর সংখ্যা ২ বিলিয়ন আর আমাদের দেশেই এর ব্যবহারকারী প্রায় ৭৫ মিলিয়ন।
২০১৬ হিসাব অনুযায়ী লাভের পরিমাণ $২৭ বিলিয়ন ছিল যা প্রতিবছর ৫০% করে বাড়ছে।
৪. ওয়েলস ফারগো (Wells Fargo)
হেডকোয়ার্টার: সান ফ্রান্সিসকো, ক্যালিফোর্নিয়া।
সম্পদের হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের ৩য় বৃহত্তম ব্যাংক। ২০১৬ এর রিপোর্ট অনুযায়ী আয়ের পরিমাণ $৯৪ বিলিয়ন।
৫. ভিসা (Visa)
হেডকোয়ার্টার: সান ফ্রান্সিসকো, ক্যালিফোর্নিয়া।
২০০৮ এ এটি যাত্রা শুরু করে ইউএস ইতিহাসের সবচেয়ে বড় পেমেন্ট সিস্টেম কোম্পানি হিসেবে। ২০০৮ সালেই এর লেনদেন এর পরিমাণ ছিল প্রায় $১৮ বিলিয়ন।
৬. শেভরন (Chevron)
হেডকোয়ার্টার: সান রামন, ক্যালিফোর্নিয়া।
ইউএসএ’র ২য় বৃহত্তর তেল ও গ্যাস উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান যার লোকবল ৫১০০০ চেয়েও বেশি। এটি ২.৬ মিলিওন ব্যারেল তেল উৎপাদন করে প্রতিদিন।
৭. ওরাকল (Oracle)
হেডকোয়ার্টার: রেডউড সিটি, ক্যালিফোর্নিয়া।
ওরাকল ৪৩০০০০ ভোক্তার জন্য ক্লাউড কম্পিউটিং ও কাস্টমার রিলেশনশিপ ম্যানেজমেন্ট সার্ভিস দিয়ে থাকে। ওরাকলের প্রতিষ্ঠাতা লারি এল্লিসন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ধনীদের তালিকায় ৭ম। যার মোট অর্থের পরিমাণ $৬০ বিলিয়ন।
৮.ইন্টেল (Intel)
হেডকোয়ার্টার: সান্তা ক্লেয়ার, ক্যালিফোর্নিয়া।
বিশেষত কম্পিউটারের যন্ত্রাংশ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান। যার মধ্যে মাইক্রোপ্রসেসর, ফ্ল্যাশ মেমোরি ও সিস্টেম ম্যানেজমেন্ট সফটওয়্যার অন্যতম। ২০১৬ তে এর আয় ছিল $৫৯ বিলিয়ন এরও বেশী।
৯. সীসকো সীসটেম (Cisco Systems)
হেডকোয়ার্টার: সান জোস, ক্যালিফোর্নিয়া।
একে নেটওয়ার্কিং এর দৈত্যও বলা হয়ে থাকে। মূলত আইপি নির্ভর প্রডাক্ট গুলো উৎপাদন হয়ে থাকে এখানে। সীসকো সিস্টেম কাজ করে আইটি ও টেলিকমিউনিকেশন এক সুত্রে গাঁথার উদ্দেশ্যে। ২০১৬ তে কোম্পানিটির আয় $৪৯ বিলিয়ন ছাড়িয়ে যায়।
১০. এনভিডিয়া (Nvidia)
হেডকোয়ার্টার: সান্তা ক্লেয়ার, ক্যালিফোর্নিয়া।
3D গ্রাফিক্স প্রসেসর এবং সফটওয়ার প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচিত বিশেষ করে গেমিং এর জন্য। কিন্তু বর্তমানে এটি আরও বড় পরিসরে কাজ শুরু করেছে, যার মধ্যে আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স ও অটোনোমাস ড্রাইভিং অন্যতম। এমআইটি ২০১৭তে একে পৃথিবীর স্মার্টেস্ট কোম্পানি হিসেবে অভিহিত করে।
সিলিকন ভ্যালি হাইটেক জগতের স্বপ্নভূমি। সাই-ফাই গল্পের বাস্তবিক প্রতিচ্ছবি, উদ্ভাবনী চিন্তার মানুষের স্বর্গরাজ্য। ভবিষ্যতের আধুনিক পৃথিবীর প্রকৌশলীদের আবাসস্থল সিলিকন ভ্যালি।
Feature Image: bbc.com