ক্যারিয়ার নির্বাচন যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমন জটিল এবং কঠিন সিদ্ধান্ত। কাঙ্ক্ষিত ক্যারিয়ারের পেছনে সময় এবং শক্তি ব্যয় করার পূর্বে আপনার কর্মজীবনের সাথে জড়িত প্রতিটি বিষয় বিবেচনায় নিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা উচিত। আপনার নির্বাচিত কর্ম আপনার জীবনকে সংজ্ঞায়িত করবে, আপনার পরিচয় নির্ধারণ করবে। সুতরাং এটি আপনার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত।
মেডিকেল ক্ষেত্রে চমৎকার কর্মজীবন বেছে নেয়ার সুযোগ আছে, আছে অর্থনৈতিক নিরাপত্তা। কিন্তু এই স্বাস্থ্যসেবা খাতে ক্যারিয়ার নির্বাচনের ক্ষেত্রে আপনি খুব হালকাভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন না। এটি একটি বিশেষ ধরনের ক্যারিয়ার, যা আপনার দৈনন্দিন জীবনে ব্যাপক পরিবর্তন আনবে। তাই সিদ্ধান্ত গ্রহণের পূর্বেই আপনাকে নিশ্চিত করতে হবে দৈনন্দিন জীবনধারার এমন অসংখ্য পরিবর্তন আপনি মেনে নিতে প্রস্তুত।
এই নিবন্ধে এমন কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আলোচনা করার চেষ্টা করবো, যা চিকিৎসা সেবা খাতে ক্যারিয়ার নির্বাচনের পূর্বে প্রত্যেক শিক্ষার্থীর গভীরভাবে বিবেচনা করা উচিত।
১. প্রেরণা
নির্দিষ্ট কর্মজীবন বেছে নেওয়ার পেছনে প্রত্যেকেরই কোনো না কোনো কারণ থাকে। আপনার ক্ষেত্রে যে কারণগুলো আছে তার সবই আপনার প্রেরণার উৎস। সুতরাং কোনো কাজকে নিজের পেশা হিসেবে নির্বাচন করার পূর্বে সেই নির্বাচন করার সুনির্দিষ্ট কারণ নিশ্চিত করা জরুরি। স্বাস্থ্য সেবা খাতে বেশ কিছু সুবিধা আছে। যেমন অর্থনৈতিক নিরাপত্তা, সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা এবং ক্ষমতা। নানান কারণে মানুষ স্বাস্থ্যসেবা খাতে ক্যারিয়ার গড়তে আগ্রহী হয়; অন্যদের সাহায্য করতে আগ্রহী অনেক কোমলমতি শিক্ষার্থী স্বাস্থ্যসেবা খাতে নিজের ক্যারিয়ার গড়তে চায়!
তবে আপনাকে নিশ্চিত করতে হবে যে, স্বাস্থ্যসেবা খাতে ক্যারিয়ার গড়তে আপনার উৎসাহ আছে এবং অবশ্যই তাৎপর্যপূর্ণ কিছু কারণও আছে। কেননা এই ক্ষেত্রে কর্মজীবন নির্বাচন করলে নিজের কর্মের কাছে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকতে হয়। এ ক্ষেত্রে কঠোর পরিশ্রম সহ নির্দিষ্ট কর্মঘন্টা না থাকার বিষয়টি আপনাকে শুরুতেই মেনে নিতে হবে। সুতরাং এই সকল প্রতিশ্রুতি পূরণের জন্য যদি আপনার যথেষ্ট মানসিক দৃঢ়তা এবং প্রেরণা থাকে তবেই আপনি স্বাস্থ্যসেবা খাতে ক্যারিয়ার গড়তে পারেন।
২. বিভিন্ন ধরনের চাকরি
মেডিকেল ক্যারিয়ারের প্রসঙ্গ এলে সামনে অনেকগুলো পথ উন্মুক্ত হয়ে যায়। কেননা এই চিকিৎসা সেবা খাতে অনেকগুলো আলাদা আলাদা কর্মক্ষেত্র রয়েছে। যেমন আপনি চাইলে ডাক্তার, নার্স, চিকিৎসা সহকারী, সার্জন ইত্যাদি নানান পরিচয় থেকে পছন্দনীয় একটি বেছে নিয়ে চিকিৎসা সেবা খাতে প্রবেশ করতে পারেন।
তবে এই প্রত্যেকটি ক্ষেত্রের জন্য আপনাকে আলাদা আলাদাভাবে চিন্তা ও গবেষণা করতে হবে এবং সিদ্ধান্ত নিতে হবে। চিকিৎসা সেবা খাতের এই ভিন্ন ভিন্ন ক্ষেত্রের জন্য নিতে হয় আলাদা আলাদা প্রশিক্ষণ। প্রত্যেকটি ক্ষেত্রের রয়েছে আলাদা আলাদা কাজ এবং কাজের ধরন বুঝে সম্মানী; চিকিৎসকের বেতন, নার্সের বেতন, চিকিৎসা সহকারীর বেতন সবই আলাদা। সুতরাং এর কোনো একটি ক্ষেত্রে প্রবেশের আগে আপনাকে নিজের সঠিক পথ চিনে নিতে হবে।
৩. ক্রমাগত শিক্ষার প্রস্তুতি
অন্যান্য ক্ষেত্রের মতো স্বাস্থ্যসেবা খাতে সম্পূর্ণ শিক্ষা জীবন শেষ করে কর্মজীবনে প্রবেশের সুযোগ নেই। তাই এই ক্ষেত্রে কোনোমতে নকল করে পাস করে এসে সফল হওয়া সম্ভব না, অন্য কথায় বলা যায়, তত্ত্বীয় ক্লাসের চেয়ে এখানে ব্যবহারিক ক্লাস বেশি। আপনাকে সবসময়ই সত্যিকারের হাসপাতালে রোগীদের সেবা করার মধ্য দিয়ে প্রশিক্ষণ নিতে হবে এবং ক্রমাগত নতুন নতুন বিষয় শিখতে হবে। এই ক্ষেত্রে কোনো তথ্যই একবার মুখস্ত করে পরীক্ষার খাতায় লিখে দেয়ার মত নয়, শিক্ষা জীবনের সকল শিক্ষা সম্পূর্ণ মাথায় রাখতে হয়।
সুতরাং চিকিৎসা সেবা খাতে প্রবেশের পূর্বে আপনাকে নিশ্চিত করতে হবে ক্রমাগত শিক্ষালাভ এবং সার্বক্ষণিক চর্চার মধ্যে থাকার শারীরিক ও মানসিক সক্ষমতা আপনার আছে।
৪. ব্যক্তিগত শক্তি ও দক্ষতা
আপনার শারীরিক, মানসিক শক্তি ও দক্ষতা এই ক্ষেত্রে আপনার সাফল্য নিশ্চিত করবে। আপনাকে সবসময় বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যক্তির সাথে মুখোমুখি যোগাযোগ করতে হবে এবং আপনার কাজ হবে সম্পূর্ণরূপে ব্যবহারিক। আরও মনে রাখা প্রয়োজন, বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষকে আপনার বুঝতে হবে; আপনাকে প্রতিদিন প্রচুর রোগী এবং তাদের অভিভাবকদের সাথে যোগাযোগ করতে হবে, তাদের কথা শুনতে হবে এবং তার ভিত্তিতে সেবা দিতে হবে।
তাই এক্ষেত্রে ব্যক্তিগত এবং সামাজিক দক্ষতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। একই সাথে থাকতে হবে প্রখর যোগাযোগ দক্ষতা। সার্বক্ষণিকভাবে সহযোগিতার ভিত্তিতে একটি দলের হয়ে কাজ করার মানসিকতা থাকতে হবে। সুতরাং এইসব যোগাযোগ দক্ষতা যদি আপনার থাকে তাহলে চিকিৎসা সেবা খাতে আপনি ক্যারিয়ার গড়তে পারেন।
৫. কাজের পরিবেশ
এক্ষেত্রে কাজের পরিবেশ সবসময়ই নিজের অনুকূলে থাকে না। তবে কিছু মৌলিক বিষয় বিবেচনা করলে সহজে নিজের পছন্দমত পরিবেশ বেছে নেওয়া যেতে পারে। যেমন হাসপাতালের ঠাণ্ডা পরিবেশে যদি আপনি অভ্যস্ত না থাকেন, তাহলে আপনাকে একজন সার্জন বা নার্স হওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। আপনি যদি শিশুদের পছন্দ করেন এবং শিশুদের নিয়ে থাকতে ভালোবাসেন তাহলে আপনি শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ হতে পারেন।
তবে এই সবগুলো ক্ষেত্রের জন্যই আপনার চমৎকার সামাজিক দক্ষতা থাকতে হবে। যদি আপনার ভাল সামাজিক দক্ষতা না থাকে তবে সার্বক্ষণিকভাবে আপনি ল্যাবে কাজ নিতে পারেন। এর যেকোনো একটি পরিবেশ বেছে নিয়ে নিশ্চিত করুন যে, আপনি চাপমুক্ত হয়ে স্বস্তিতে কাজ করছে। কেননা চিকিৎসা সেবা খাতে চাপমুক্ত হয়ে স্থির মস্তিষ্কে কাজ করা খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
৬. পারিবারিক এবং ব্যক্তিগত জীবনের উপর প্রভাব
আপনার নির্বাচন করা পেশা আপনার সম্পূর্ণ মনোযোগের দাবি রাখে। তাই আপনার নির্বাচন করা পেশা আপনার ব্যক্তি এবং পারিবারিক জীবনে প্রভাব ফেলবে কিনা বা কতটা প্রভাব ফেলবে তা বিবেচনা করা জরুরি। বলা হয়ে থাকে, ডাক্তার আর পুলিশের কোনো নির্দিষ্ট কর্মঘণ্টা নেই। চিকিৎসা সেবা খাতে প্রবেশ করলে অবশ্যই আপনার পারিবারিক এবং ব্যক্তি জীবন, কর্মজীবন দ্বারা প্রভাবিত হবে।
সুতরাং আপনাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে আপনি এই দুই জীবনের সমন্বয় কিভাবে করবেন অথবা আপনি আদৌ সমন্বয় করতে প্রস্তুত কিনা! যদি চিকিৎসা সেবা খাতে প্রবেশের কারণে পারিবারিক এবং ব্যক্তিজীবনে সৃষ্টি হওয়া সকল প্রভাব মেনে নিতে প্রস্তুত থাকেন তাহলে আপনি এক্ষেত্রে প্রবেশ করতে পারেন।
উপরে আলোচিত বিষয়গুলো নিয়ে যদি আপনি নিশ্চিত থাকেন তবেই আপনার চিকিৎসা সেবা খাতে প্রবেশের সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত।