‘ব্যস্ততা‘ শব্দটি আমাদের জীবনের সাথে দিনদিন ওৎপ্রোতোভাবে জড়িয়ে যাচ্ছে। সেই সাথে এটি হয়ে উঠেছে আমাদের নিত্যসঙ্গী। আর এই ব্যস্ততার সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়ে চলেছে হতাশা, মানসিক চাপ, পারিবারিক কলহ ইত্যাদি। যেটা আমরা অনেকেই সহজে মেনে নিতে পারি না। যার ফলে সৃষ্টি হয় নানা সমস্যা এবং কোনো কিছুই ঠিকভাবে হয়ে ওঠে না।
বিশেষ করে কর্মক্ষেত্রে মানসিক চাপ নিয়ে কাজ করার মানসিকতা অনেকেরই থাকে না। তাছাড়া কর্মক্ষেত্রে অতিরিক্ত মানসিক চাপ কর্মীর উৎপাদনশীলতা এবং কর্মক্ষমতাতেও বাঁধা সৃষ্টি করতে পারে। তাই বলাই বাহুল্য, কর্মক্ষেত্রে পরিপূর্ণ মনোযোগ দিয়ে কাজ করার জন্য আমাদের প্রয়োজন মানসিক সুস্থতা। সেজন্যই মানসিকভাবে সুস্থ থাকতে হলে আমাদের নানা কাজের মধ্যেও থাকতে হবে চাপমুক্ত।
কর্মক্ষেত্রে মানসিক চাপ বেশী হয় কখন?
চাপ সবসময় খারাপ হয় না। কর্মক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় কিছু চাপ মানুষকে মনযোগ বৃদ্ধি, অলসতা কাটানো এবং কর্মক্ষেত্রের নতুন চ্যালেঞ্জগুলো পূরণ করতে সহায়তা করে। সাধারণত প্রতিষ্ঠানে কর্মরত একজন ব্যক্তি যদি সামান্য পরিমাণ চাপের মধ্যে না থাকে তাহলে সে তার ভুলগুলো প্রতিরোধ করতে পারবে না৷
কর্মক্ষেত্রে অতিরিক্ত কাজের চাপ; Source: News18 Bangla
কিন্তু সমস্যাটা হয় তখনি, যখন নিজের কর্মক্ষেত্রটিকে প্রায়শই একটি মানসিক বেলন কোস্টারের মত মনে হয়। দীর্ঘ কর্ম দিবস, দীর্ঘ কর্ম ঘন্টা, সংকটপূর্ণ সময়সীমা এবং ক্রমবর্ধমান চাহিদাগুলো পূরণ করতে গিয়ে একটা মানুষের মানসিক চিন্তাশক্তিতে অনেক বেশি প্রভাব পড়ে৷ যা চাপ মোকাবেলা করার ক্ষমতাকে অতিক্রম করে। ফলে তখন সৃষ্টি হয় অতিরিক্ত মানসিক চাপ।
কর্মক্ষেত্রে চাপের সাধারণ কারণসমূহ
কর্মক্ষেত্রে বিভিন্ন কারণে মানসিক চাপ সৃষ্টি হতে পারে। তবে ‘আমেরিকান সাইকোলজিক্যাল অ্যাসোসিয়াশনে’র এক গবেষণায় দেখা গেছে নির্দিষ্ট কয়েকটি কারণে মানুষ কর্মক্ষেত্রে মানসিক চাপ অনুভব করে, নিজেকে অসুখী ভাবে। যেমন:
- কম বেতন।
- অতিরিক্ত কাজের চাপ।
- মনের মতো কাজ না পাওয়া।
- সামাজিক নিরাপত্তার অভাব।
- কাজ সম্পর্কিত যেকোনো সিদ্ধান্ত না নেওয়ার ক্ষমতা।
- চাহিদা আর পাওয়ার মধ্যে পার্থক্য।
- কর্মী না থাকার কারণে ওভারটাইম করা।
- সবসময় সর্বোত্তম মাত্রায় কাজ করার চাপ।
কর্মক্ষেত্রে মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রনের নিয়মাবলি
১. নিয়মিত ব্যায়াম করুন
ব্যায়াম মানুষের শারীরিক ফিটনেসের পাশাপাশি মানসিক চাপও নিয়ন্ত্রণ করে। আর তাই কর্মক্ষেত্রে মানসিক চাপ সামলাতে অবশ্যই প্রতিদিন ব্যায়াম করার অভ্যাস করুন৷ এক গবেষণায় দেখা গেছে, ‘নিয়মিত শরীরচর্চা মানসিকতার পরিবর্তন ঘটায়।’
প্রতিদিন ব্যায়াম করুন; Source: Healthline
তাই নিয়মিত ব্যায়ামের ফলে মানুষের চিন্তাশক্তি, মানসিক স্থিতিশীলতা, সময়ানুবর্তীতা এবং একাগ্রতা ইত্যাদি অনেকাংশে বেড়ে যায়। তাছাড়া মানসিক চাপ কমাতে মেডিটেশনের উপকারিতা সম্পর্কে কমবেশি আমরা সবাই জানি৷ সুতরাং কর্মক্ষেত্রে মানসিক চাপ কমানোর একটি সহজ নিয়ম হলো শারীরিক ব্যায়াম।
“শারীরিক ফিটনেস শুধুমাত্র একটি স্বাস্থ্যকর শরীরের গুরুত্বপূর্ণ চাবিই নয়, বরং এটি গতিশীল এবং সৃজনশীল বুদ্ধিজীবী কার্যকলাপেরও একটি ভিত্তি।” – জন এফ কেনেডি
২. নিজের জন্য ছুটি নিন
কোনো একটা কাজ টানা করতে থাকলে একঘেয়েমি আসাটাই স্বাভাবিক। একেক জনের কাছে এই একঘেয়েমিটা একেক সময় অনুভূত হয়। তাই আপনি নিজের সময় অনু্যায়ী প্রতিষ্ঠানের নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে ছুটি নিন কিছুদিন পরপর। নিজেকে সময় দিন, নিজের পরিবারের সাথে সময় কাটান এবং পারলে প্রকৃতির সান্নিধ্যে ঘুরে আসুন কিছুসময়।
এতে করে মানসিক চাপ অনেকটা কমে যাবে। আবার নতুন উদ্যমে কাজ শুরু করার মানসিকতা তৈরি হবে। তাছাড়া প্রতিদিন নিজের জন্য অল্প কিছু সময় ব্যয় করুন। সেই সময়টায় শুধু নিজের শখের কাজগুলো করার চেষ্টা করুন।
৩. ‘না’ বলতে শিখুন
শুনতে অবাক লাগলেও এমন অনেক মানুষ আছে যারা কাউকে ‘না’ বলতে পারে না। এই ধরণের মানুষগুলো সকলের অনেক পছন্দের হলেও, এই স্বভাবটা তাদের নিজেদের জন্য অনেক বড় ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তাই আপনি কী পেতে চান, আপনি কতটুকু পারবেন, আপনার ক্ষমতা কতটুকু এবং আপনার কোথায় সময় দেওয়া বেশি জরুরী এই সিদ্ধান্তগুলো সম্পর্কে সচেতন হওয়া খুব জরুরি।
না বলতে শিখুন; Source: yellow.com.mt
সেইসাথে প্রয়োজন অনুযায়ী ‘না’ বলতে পারাটা সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। এমনকি আপনার বসও যদি আপনাকে অযথা বেশি কাজ চাপিয়ে দেয়, সেক্ষেত্রেও না বলাটা শিখতে হবে। কেননা অযৌক্তিকভাবে বেশি কাজ করতে গেলে আপনি মানসিক চাপে থাকবেন। ফলে কাজটা সুন্দরভাবে করা সম্ভব হবে না।
৪. নিখুঁত হওয়া বন্ধ করুন
অনেকের একটা অভ্যাস আছে যে, সে যাই করবে তা পরিপূর্ণভাবে সঠিক হতে হবে। আর যদি কোনো কারণে সামান্য এদিক সেদিক হয়, তাহলে সে তা নিখুঁত করার জন্য উঠে পড়ে লাগবে। কিন্তু এই অভ্যাসটা মানসিক চাপ সৃষ্টিতে গভীরভাবে প্রভাব ফেলে। কেননা এই চাপটা সে নিজেই নিজেকে দিয়ে থাকে।
অর্থাৎ যারা সবসময় সব কাজে নিখুঁত হওয়ার চেষ্টা করে, তারা সবসময় একটা চাপের মধ্যে থাকে। তারা যে কাজে যায়, সে কাজেই খুঁতখুঁতে ভাব তৈরি হয়। তাই সব কাজে নিখুঁত হওয়ার চিন্তাভাবনা থেকে আজই বেরিয়ে আসুন। যে কাজটি করবেন সে কাজে নিজের সর্বোচ্চটা দিয়ে ভালো করার চেষ্টা করুন। যাতে পরবর্তীতে আর কোনো সমস্যা সৃষ্টি না হয়।
৫. পর্যাপ্ত পরিমাণ ঘুম
বর্তমানে বেশিরভাগ মানুষের মধ্যে না ঘুমিয়ে থাকার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু ‘ঘুম’ থেকে ভালো Stress Looser আর কিছু হতে পারে না। অপর্যাপ্ত ঘুম মানুষের দৈনন্দিন কাজকর্মের পাশাপাশি কর্মক্ষেত্রেও নানান সমস্যার সৃষ্টি করে।
পর্যাপ্ত পরিমাণ ঘুমান; Source: Numo Acupuncture
যেমন কর্মক্ষেত্রে উৎপাদনশীলতা, সৃজনশীলতা, সমস্যার সমাধান দক্ষতা এবং কাজে মনযোগ দেওয়ার ক্ষমতা ইত্যাদি সবকাজে ব্যাঘাত ঘটে। তাই সারাদিনের কর্মব্যস্ততা শেষে রাতে ঠিক ৭-৮ ঘন্টা ঘুমানো উচিত। তাছাড়া মনকে প্রফুল্ল রাখতে পর্যাপ্ত পরিমাণ ঘুমানো উচিত। কারণ পর্যাপ্ত পরিমাণ ঘুম হলে মানসিক চাপের মাত্রা উল্লেখযোগ্য হারে কমে যায়।
Featured Image Source: Goalcast.com