প্রযুক্তি তথা ইন্টারনেটের ব্যবহার আমাদের দৈনন্দিন জীবনের প্রতিটি কাজের গতিকে এতটাই বাড়িয়ে দিয়েছে যা ভাষায় প্রকাশ করার মতো না। তবে প্রযুক্তিগত উন্নতির এই অগ্রযাত্রার অন্তরালে লুকিয়ে আছে ভয়ানক কিছু বিপদ যা আপনার আমার জীবনের গতিকে বাঁধা কিংবা নষ্ট করে দিতে পারে নিমিশেই। মুলত ভয়ানক এই বিপদগুলোকে প্রযুক্তির ভাষায় বলা হয় হ্যাকিং তথা ডিজিটাল চুরি। আর এই কাজগুলোর যারা করে তাদেরকে বলা হয় হ্যাকার বা ডিজিটাল চোর। একটি কথা না বললেই নয় এই ডিজিটাল চোর তথা হ্যাকারদের আবার বিভিন্ন ধরন আছে। এরমধ্যে কিছু ডিজিটাল চোর আছে যারা নিয়মনীতি মেনে চুরি করে, এদের আবার বলা হয় ভালো চোর বা ইথিক্যাল হ্যাকার।
মূলত সাড়া অনলাইন দুনিয়ায় এরকম অসংখ্য হ্যাকার ওঁত পেতে বসে আছে প্রযুক্তিগতভাবেই আপনাকে বিপদে ফেলার জন্য। তাই আসুন কিছু প্রযুক্তিগত সচেতনতা দেখে নেই যা আমাদের ডিজিটাল চুরি বা হ্যাকিং থেকে রক্ষা করবে।
অনলাইনে তথ্য আদান প্রদানে সচেতন হোন
প্রতিনিয়ত ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ওয়েবসাইট স্বাচ্ছন্দে ব্যবহারের জন্য ব্যক্তিগত একাউন্ট খুলতে হয়। একাউন্ট খোলার সময় আমাদের ব্যক্তিগত সকল তথ্য যেমন জন্মতারিখ, জাতীয় পরিচয় পত্র নম্বর, ব্যাংক একাউন্ট ইত্যাদি ইচ্ছায় কিংবা অনিচ্ছায় দিতে বাধ্য হই। এছাড়াও আপনার মোবাইল, ডেক্সটপ কিংবা ল্যাপটপটি ইন্টারনেট সংযোগের আওতায় আসা মাত্রই আপনার ব্যবহারিত আইপি এড্রেসটির মাধ্যমে খুব সহজেই বুঝা যায় আপনার লোকেশন তথা অবস্থান।
ইন্টারনেটের সচেতন ব্যবহারকারীরা কয়েকদিন আগে অনলাইন দুনিয়ায় তোলপাড় হওয়া ‘ক্যামব্রিজ এনালাইটিকা’ নামক ফেসবুকের সবচেয়ে বড় ডেটা চুরির ঘটনাটি এতদিনে ভুলেননি নিশ্চয়ই। তাই ব্যক্তিগত তথ্য আদান প্রদনে সচেতন হওয়া খুবেই জরুরী তা না হলে বিপদে পড়তে পারেন যেকোনো মূহুর্তে।
ইন্টারনেট কুকি থেকে সাবধান
এই কুকিজ (Cookies) কিন্তু মোটেও বিস্কুট জাতীয় খাদ্য বিষয়ক কোনো পণ্য না। কম্পিউটারের পরিভাষায় একে কয়েকটি নামে অভিহিত করা হয় যেমন, ওয়েব কুকি, ইন্টারনেট কুকি, ব্রাউজার কুকি এবং সাধারণভাবে একে কুকি বলা হয়। কম্পিউটার তথা ইন্টারনেটের সাথে এই কুকির সম্পর্ক কোথায়? এক কথায় যদি বলি – কুকি ছোট ছোট তথ্য সম্বলিত কিছু ডাটা যা নির্দিষ্ট ওয়েবসাইট থেকে এসে আপনার ব্যবহৃত ব্রাউজারে সংরক্ষিত থাকে।
খেয়াল করলে দেখবেন, আপনার ব্রাউজারের মাধ্যমে আপনার ব্যক্তিগত তথ্য দিয়ে একবার ফেসবুকে লগইন করলে পরবর্তীতে আর একই তথ্য দিয়ে লগইন করতে হয় না। এখানে মূলত প্রথমবার লগইন করার সাথে সাথেই নির্ধারিত ওয়েবসাইট থেকে কিছু ডাটা স্বয়ংক্রিয়ভাবে আপনার ব্রাউজারের নির্দিষ্ট একটি জায়গায় সংরক্ষিত থাকে ফলে পুনরায় ঐ ওয়েবসাইটে বারবার একই তথ্য দিয়ে লগইনের ঝামেলা করতে হয় না। এছাড়াও ব্রাউজারের গতি বৃদ্ধিতেও ইন্টারনেট কুকি ব্যবহার করা হয়।
এবার আসি মূল কথায়, মূলত আধুনিক চোর তথা হ্যাকারা আপনার ব্রাউজারের কুকি হ্যাক করে ফলতে পারে বিপদে কারণ এই কুকি নামক ছোট ছোট তথ্যবহুল ডাটাগুলোতে থাকে ব্যক্তিগত নানা তথ্য। তাই নিয়মিত ব্রাউজার থেকে কুকি ক্লিয়ার অথবা ডিলিট করুন অনলাইন দুনিয়ায় নিজেকে রক্ষা করার জন্য।
প্রযুক্তিগত সচেতনতা বৃদ্ধি করুন
অনলাইন ব্যবস্থাপনায় নিরাপদে থাকার জন্য সচেতনতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পূর্বে বলেছিলাম, অনলাইনে একাউন্ট খোলার সময় বিভিন্ন তথ্য বা ডাটা আমাদের প্রদান করতে হয় এবং আপনার ব্যক্তিগত ডেটাগুলোকে সংরক্ষণ তথা হ্যাক হওয়া থেকে প্রতিহত করার জন্য প্রত্যেক প্রযুক্তিগত প্রতিষ্ঠানের কিছু নীতিমালা থাকে। বর্তমান আধুনিক প্রযুক্তির এ যুগে আপনার ডাটাগুলোকে সংরক্ষণ করার জন্য ডাটা এনক্রিপশন এবং মেশিন লার্নিংয়ের মতো উচ্চ মানের পদ্ধতি ব্যবহারের করে বড় বড় প্রতিষ্ঠানগুলো। মজার বিষয় হচ্ছে, এত উচ্চ মানের পদ্ধতি ব্যবহার করলেও আপনার অসচেতনতার কারণে বিপদে পড়তে পারেন যেকোন মূহুর্তে।
সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারে সচেতন হোন
আমরা যারা ফেসবুকে সময় কাটাতে পছন্দ করি তারা একটু মনোযোগের সাথে খেয়াল করলে দেখবেন ফেসবুক কতৃপক্ষ আপনি যা যা পছন্দ করেন ঠিক সেরকমেই বিজ্ঞাপন আপনার নিজস্ব ফেসবুক প্রোফাইলে দেখাচ্ছে। প্রশ্ন আসতে ফেসবুকের মতো এতো বড় সোশ্যাল একটি ওয়েবসাইট এসব কেন করছে? ভুলে যাবেন না ফেসবুক শুধুমাত্র সোশ্যাল মিডিয়া নয় বর্তমানে এটি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ডিজিটাল মার্কেট প্লেস।
মূলত ফেসবুকের মতো প্রযুক্তিগত বড় প্রতিষ্ঠানগুলো আপনার সকল ডাটা বিশ্লেষণ করে দেখে আপনি কি পছন্দ করেন এবং কোন কোন জায়গাগুলোতে বেশি সময় কাটান। এ সবকিছু বিশ্লেষণ করে আপনার পছন্দমতো বিজ্ঞাপনগুলো আপনার সামনে উপস্থাপন করে যাতে আপনি আরো আকৃষ্ট হোন।
তবে পুরো এই প্রক্রিয়াটা চলে সম্পৃর্ণ স্বয়ংক্রিয়ভাবে নির্দিষ্ট এলগরিদমের মাধ্যমে। সুতরাং বুঝতেই পারছেন, এসব বড় বড় প্রতিষ্ঠানের জন্য ব্যবহারকারী হিসাবে আপনি তথা আপনার ডাটাগুলো কত গুরুত্বপূর্ণ এবং আপনাকে ব্যবহার করেই এসব বড় বড় প্রযুক্তিক প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতিবছর আয় করছে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারেরও বেশি যা হয়তো আমাদের ধারণার বাইরে।
থার্ড পার্টি সফটওয়্যার ব্যবহারে সতর্কতা অবলম্বন করুন
থার্ড পার্টি অ্যাপস বা সফটওয়্যার সম্পর্কে আলোচনার পূর্বে এটি সম্পর্কে ধারণা থাকা গুরুত্বপূর্ণ। এককথায় বললে – আপনার মুঠোফোন বা ব্যক্তিগত কম্পিউটারে বিল্ডইন তথা আগে থেকে তৈরিকৃত সফটওয়্যার ছাড়া যতো সফটওয়্যার আছে সবগুলোই থার্ড পার্টি সফটওয়্যার। কি? কঠিন মনে হচ্ছে! আচ্ছা, তাহলে আরো সহজ করে বলি। মূলত অ্যান্ড্রয়েড অ্যাপস স্টোর বা অ্যাপল অ্যাপস স্টোরে যত অ্যাপস বা সফটওয়্যার পাওয়া যায় সবই থার্ড পার্টি অ্যাপস। যেমন ফেসবুক, টুইটার, ফায়ার ফক্স ইত্যাদি সবই থার্ড পার্টি সফটওয়্যার।
আবার কিছুকিছু থার্ড পার্টি সফটওয়্যার আছে যেগুলোর স্বাচ্ছন্দে ব্যবহার করতে অন্য থার্ড পার্টি অ্যাপসের সাহায্য লাগে। যেমন বর্তমান সময়ে বেশ কিছু সফটওয়্যার বা টুলস পাবেন যেখানে লগইন করতে আপনার ফেসবুক অথবা টুইটার প্রোফাইলটির প্রয়োজন। মূলত এখানেও আপনাকে সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে কারণ বেশকিছু নকল থার্ড পার্টি অ্যাপস আছে যার মাধ্যমে আপনি পড়তে পারেন চরম বিপদে। তাই এ থেকে বাঁচার সবচেয়ে ভালো উপায় হচ্ছে সফটওয়্যারটি মুঠোফোন বা ব্যক্তিগত কম্পিউটারে ইন্সটল করার সময় খেয়াল রাখবেন নির্দিষ্ট টুলসটি সম্পূর্ণ নিরাপদ কিনা!
আধুনিক প্রযুক্তির উন্নতির ফলে পুরো পৃথিবী যেমন চলে এসেছে আপনার হাতের মুঠোয় ঠিক তেমনি আপনার পছন্দ, ভালো লাগা, ঘৃণা। এককথায় ব্যক্তিত্ব চলে এসেছে কিছু মানুষ বা প্রতিষ্ঠানের হাতের মুঠোয় যা হয়তো আপনি জেনেও না জানার ভান করে বসে আছেন। তাই নিজের ব্যক্তিত্বকে জলানজলি না দিয়ে প্রযুক্তিগত সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে ডিজিটাল চুরির হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করুন।
Featured Image: pexels