সোনার: ডুবোজাহাজ চালনা আর যুদ্ধে যার নেই কোনো বিকল্প!

ভিডিও কিংবা সিনেমায় অনেকেই রাডার ব্যবহার করতে দেখছেন। সবুজ রঙের একটি ডিসপ্লে যেখানে শত্রুপক্ষের অবস্থান দেখা যায়। বিভিন্ন যুদ্ধ জাহাজে, ছোট বড় বিভিন্ন আকারের যুদ্ধবিমান আর নানা ডুবোজাহাজে এটা দেখা যায়। মনিটর আর সেগুলোর প্রদর্শিত বস্তুগুলোর অবস্থানের পদ্ধতি অনেকাংশে এক হলেও এদের মধ্যে রয়েছে ভিন্নতা। বিমান আর যুদ্ধজাহাজে রাডার ব্যবহার করা হলেও ডুবোজাহাজের ব্যবহৃত হয় সোনার টেকনোলজি। চলুন জেনে নেওয়া যাক সোনার সম্পর্কে কিছু কথা।

{ "slotId": "2452885053", "unitType": "in-article" }

রাডারের ইতিহাস আর কাজের সম্পর্কে জানতে চাইলে পড়ে নিতে পারেন এই আর্টিকেলটি

Source: bas.ac

এক পলকে সোনারের ইতিহাস

প্রতিটি প্রযুক্তি আবিষ্কারের পেছনে রয়েছে অসংখ্য মানুষের কার্যক্রম আর অক্লান্ত পরিশ্রম। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন প্রতিভাবান ব্যক্তির পর্যবেক্ষণ আর প্রচেষ্টার পর মাঝেমধ্যে নতুন কোনো প্রযুক্তির দেখা মেলে। তেমনি এক প্রযুক্তি হচ্ছে সোনার।

১৪৯০ সালের ঘটনা। ইটালির দার্শনিক, বিজ্ঞানী, গণিতবিদ বিখ্যাত লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি প্রমান করেন ডলফিন, বাদুড় শব্দ তরঙ্গের ব্যবহার লাখো লাখো বছর ধরে করে আসছে। ডলফিন সমুদ্রে শব্দ তরঙ্গ ব্যবহার করে যোগাযোগ করছে যেমন, তেমনি বাদুড় কোনো বস্তুর অবস্থায় বের করতে ব্যবহার করে যাচ্ছে। তিনি দেখিয়েছিলেন যে, পানির মধ্যে একটি টিউব রাখলে সেখানে তরঙ্গ অনুভব করা যায়। ফলাফল স্বরূপ শব্দের উৎস আর বস্তুর অবস্থান বের করা সম্ভব।

{ "slotId": "", "unitType": "in-article", "pubId": "pub-6767816662210766" }

১৪৯০ সনে লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি বিষয়টি উল্লেখ করলেও এর ব্যবহার ঊনবিংশ শতাব্দীর আগে শুরু হয়নি। প্রথমে ব্যবহারটা শুরু হয়, আন্ডার-ওয়াটার বেল ব্যবহারের মাধ্যমে। যেটা কিনা লাইট হাউজ থেকে বিপদ সংকেত দিতে ব্যবহার করা হতো। শব্দ তরঙ্গের মাধ্যমে এরিয়াল নেভিগেশনের প্রথম উল্লেখযোগ্য কাজ ছিলো ১৯১২ সালের টাইটেনিক জাহাজের খোঁজ মিলাতে।

বিশ্বের সর্বপ্রথম ইকো রেঞ্জিং ডিজাভাইসের নকশা করেন ইংরেজ মেটেরোলজিস্ট লুইস ফ্রাই রিচার্ডসন। টাইটেনিক ডোবার কয়েক মাস পর তিনি সোনারের নকশা ব্রিটিশ পেটেন্ট অফিসে জমা দেন। তার একবছর পর, জার্মান পদার্থবিজ্ঞানী আলেকজান্ডার বেহেম ইকো সাউন্ডারের ডিজাইন পেটেন্ট করেন।

HMS H4 Brindisi (1916); Source: MilitarySource

কানাডিয়ান ইঞ্জিনিয়ার রেগনালড ফেসেন্ডেন ১৯১২ সনে ডুবোজাহাজের একটি গবেষণায় যুক্ত ছিলেন। তিনি বোস্টনের সাবমেরিন কোম্পানীতে বোস্টন হার্ভারে একই বছরে সিগনালের উপর পরীক্ষা চালানো শুরু করেন। পরবর্তীতে দুই বছর পরে ১৯১৪ সালে তিনি মায়ামির ইউ এস রেভিনিউয়ের (বর্তমানে কোস্টগার্ড হিসাবে পরিচিত) সাথে আরেকটি পরীক্ষা চালান। সে পরীক্ষার রেগনালড ফেসেন্ডেন শব্দ তরঙ্গ ব্যবহার করে তিন কিলোমিটার দূরের একটি বরফখন্ড ডিটেক্ট করতে সক্ষম হন। রেগনালড তার তৈরি ফেসেন্ডেন অসিলোস্কোপ নিয়ে পরবর্তীতে আরো গবেষণা চালাতে থাকেন। ১৯১৫ সালে প্রথম ফেসেন্ডেন অসিলোস্কোপ ডুবোজাহাজে ব্যবহার হয়। যেটা কিনা ব্রিটিশ এইচ ক্লাস সাবমেরিন ব্যবহার করা হয়েছিলো। ব্রিটিশ রয়াল নেভি এই ডুবোজাহাজটি তৈরি করেছিলো।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় এর চাহিদা বেড়ে যায়। কারণ ডুবোজাহাজে সাউন্ড নেভিগেশনের ব্যবহার যুদ্ধের মোড় ঘুরাতে পারবে সেটা বুঝতে কারো দেরি হয়নি। পরবর্তীতে বিভিন্ন গবেষণায় পর ফরাসি পদার্থববিদ পল লাগেনভিন, রাশিয়ান ইমেগ্রেন্ট ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার কন্সটাটাইনের সাথে তৈরি করেন হাইড্রোফোন। যেটা কিনা একটি আন্ডারওয়াটার লিসেনিং ডিভাইস। তারা এ কাজে প্রথমে ব্যবহার করেছিলেন পিজো ইলেক্ট্রো এবং ম্যাগনেটো স্ট্যাটিক ট্রানসডিউসার। পরবর্তীতে ব্যবহার করেন ইলেক্ট্রো স্ট্যাটিক ট্রানসডিউসার যেটা তাদের ভবিষ্যত প্রজেক্টে ব্যবহার করা হয়। তবে পূর্ণাঙ্গ সোনারের দেখা মিলে ১৯৩০ সনে আমেরিকান ইঞ্জিনিয়ারদের হাত ধরে।

সোনার আসলে কী?

SONAR পূর্ন নাম হচ্ছে SOund Navigation And Ranging। যেখানে রাডারের পূর্ন নাম RAdio Navigation And Ranging। যেখানে রাডার শর্ট রেডিও ওয়েভ ব্যবহার করে নেভিগেশনের কাজ সম্পাদনা করে থাকে, সেখানে সোনার ব্যবহার করে সাউন্ড। সোনার যদিও নেভিগেশনের উদ্যেশ্যে তৈরি করা হয়া হয়েছিলো তবে শুধু নেভিগেশনের কাজের মধ্যেই এটি সীমাবদ্ধ নয়। পানির নিচে যোগাযোগ করতেও সোনার ব্যবহার করা হয়।

Source: Magazish

সোনারের মধ্যে দুই ধরনের টেকনোলজির ব্যবহার করা হয়েছে। একটি হচ্ছে প্যাসিভ। প্যাসিভ সোনারের বিষয়টি খুব সাধারণ। শত্রু পক্ষের ডুবোজাহাজের বা কোন বস্তুর তৈরিকৃত শব্দ/তরঙ্গ রিসিভ করে লোকেশন ডিটেক্ট করে। আর একটিভ সোনারের ক্ষেত্রে টার্গেটের উদ্যেশ্য ব্যবহারকারী সাউন্ড পালস বা ইকো প্রেরণ করে।

সোনার যদিও পানির তলদেশের যোগাযোগ আর নেভিগেশনের কাজে ব্যবহার হয়, তবে সাধারণ বাতাসেও এই নেভিগেশন পদ্ধতি কাজ করে। সোডার নামে বাতাসে কাজ করা এই সোনারের নামকরণ করা হয়েছে।

Source: fao

যদিও সোনারের মধ্যে দুটো ভাগ রয়েছে, তবে কিছু বেসিক অংশ দুই ধরনের সোনারের মধ্যে পাওয়া যায়। সেগুলো হচ্ছে :

১. ট্রান্সডিউসার: পানির নিচের বিভিন্ন তরঙ্গের তারতম্য এই অংশটি ডিটেক্ট করে থাকে।

{ "slotId": "2452885053", "unitType": "in-article" }

২ : রিসিভার: ট্রান্সডিউসারের ডিটেক্ট করা তরঙ্গ সরাসরি রিসিভার পাঠানোর হয়। সাথে সাথে রিসিভার সেই তরঙ্গটিতে ফিল্টারিং এবং এমপ্লিফাই করে পূর্নাঙ্গ রুপ দিয়ে থাকে।

৩. ডিসপ্লে: রিসিভার থেকে পাওয়া তথ্য অপারেটরের বোঝার সুবিধার্থে মনিটরে প্রদর্শিত হয়। বিভিন্ন আকৃতি আর বিভিন্ন রঙের মাল্টিকালার ডিসপ্লে বর্তমানে রাডারে ব্যবহার করা হয়।

একটিভ সোনারে আরো যে কয়েকটি অংশ বেশি থাকে সেগুলো হচ্ছে ট্রান্সমিটার ও সিগনাল পাঠানোর জন্য আলাদা আরেকটি ট্রান্সডিউসার।

{ "slotId": "2452885053", "unitType": "in-article" }

কেন রাডার ব্যবহার করা হয় না ?

আলোর গতি সবথেকে বেশি। রেডিও ওয়েভ ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক বর্নালীর একটি অংশ যেটা কিনা আলোও বটে তাই রেডিও ওয়েভ আলোর গতিতে চলে। রেডিও ওয়েভের তুলনায় সাউন্ড এত ধীরগতির হওয়া সত্ত্বেও পানির নিচে কেন রাডারের বিকল্পে সোনার ব্যবহার করতে হয় সেই প্রশ্ন যে কারো মনেই উঠতে পারে।

Source: Subnautica

তার কারণ হচ্ছে রাডারের পানি ভেদ করার ক্ষমতা। যখন পানির মধ্যে বেশ খানিকটা দূরত্বে রাডার সিগনাল প্রেরণ করা হয়, রাডারে মাইক্রো ওয়েভ ব্যবহারের কারণে তার বেশিরভাগই পানিতে শুষে নেয়। ফলে বেশি দূরত্বে রাডার ব্যবহার যায় না। এছাড়া যুদ্ধ ক্ষেত্রে রাডার জ্যামিং করা গেলেও সোনার জ্যামিংয়ের কোনো বাস্তবিক ব্যবহার নেই। এছাড়া ইঞ্জিনের শব্দ কেউ তো ঢাকা দিতে পারবে না। আর পানিতে শব্দের প্রবাহের গতি বাতাসের থেকে বেশি হওয়ায় প্রায় সাথে সাথে সোনারে টার্গেট ডিটেক্ট করতে পারে। ফলে এন্টি সাবমেরিন যুদ্ধে সোনারের বিকল্প কিছু হতে পারে না।

বর্তমানে সোনারের ব্যবহার শুধু মিলিটারি ক্ষেত্রেই ব্যবহার করা হয় না। বিভিন্ন গবেষণায় সমুদ্রের তলদেশ ম্যাপিং করতেও সোনার ব্যবহার করা হয়ে থাকে।

{ "slotId": "2452885053", "unitType": "in-article" }

তথ্যসূত্র :

  • SONAR Power! by Scott R Garrigus
  • Sonar for Practising Engineers by Ashley David Waite
  • The sonar of dolphins by Whitlow Au
  • Principles of Sonar Performance Modelling by Michael Ainslie

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *