“শিক্ষাই জাতির মেরুদন্ড” মূল্যবান এই বাক্যটির বিপরীতে কথা বলা নিছক বোকামি কিংবা বেয়াদবিও বটে। কিন্তু যেই দেশে বা জাতিতে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা পৃথিবী বিখ্যাত সেখানে ‘শিক্ষাই জাতির মেরুদন্ড’ নামক বাক্যটির সত্যতা কতটুকু, তা না হয় পাঠকদের উপরেই ছেড়ে দিলাম। বিষয়টি মূলত এরকম, শক্ত এবং মজবুত মেরুদন্ড আছে কিন্তু ভার বহন করার ইচ্ছাশক্তি কিংবা সামর্থ্য নাই। কথাগুলো অগোছালো মনে হলেও চলুন বিষয়টিকে পরিমার্জিত আকারে বোঝার চেষ্টা করি। মূলত বাক্যটি হওয়া উচিত ছিল “সৃজনশীল এবং গঠনমূলক শিক্ষাই জাতির মেরুদন্ড”।
কেননা আশেপাশে চারদিকে খেয়াল করলে দেখবেন একটি মানুষ শিক্ষিত না হয়ে যদি শুধুমাত্র সৃজনশীল হয়, তাহলে তিনি কখনো বেকারত্বের অভিশাপ নিয়ে বেঁচে থাকেন না। আর কেউ যদি সৃজনশীলতা আর শিক্ষার মেলবন্ধন ঘটাতে পারেন তাহলে ইতিবাচকভাবে ভয়ানক কিছু ঘটলেও ঘটতে পারে। এর ফলশ্রুতিতে আমরা পেতে পারি অ্যামাজন, ফেসবুক, গুগলের মতো মাল্টিট্রিলিয়ন ডলারের কোম্পানি। অর্থাৎ “সৃজনশীল এবং গঠনমূলক শিক্ষার অভাব বেকারত্বের প্রধাণ অন্তরায়”।
প্রশ্ন আসতে পারে, তাহলে সৃজনশীল এবং গঠনমূলক শিক্ষা অর্জনে আমরা কী কী ভূমিকা পালন করতে পারি? বিষয়টিকে এককথায় বললে, আমাদের পরিবেশে পরিবর্তন আনতে হবে ব্যাপক আকারে এবং এটি বাস্তবায়ন করতে হবে আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম তথা শিশু কিশোরদের উপর। এক্ষেত্রে পরিবেশ কতটা গুরুত্বপূর্ণ এর কয়েকটি বাস্তব উদাহরণ দেখে আসি চলুন, আপনার মায়ের হাতের মসলা যুক্ত রান্না এবং আফ্রিকার একটি ছেলের মায়ের মসলাহীন রান্না উভয়ই দুই ছেলের কাছে অনেক সুস্বাদু।
কিন্তু কোনো কারণে যদি আপনি আফ্রিকান মায়ের রান্না বা ঐ ছেলেটি আপনার মায়ের রান্না খায় তাহলে সুস্বাদুর বিষয়টি নিমিষেই পালিয়ে যাবে অনেক দূরে। এবার আমাদের তথাকথিত সুন্দরীদের সাথে যদি আফ্রিকান সুন্দরীদের তুলনা করেন তাহলে নিঃসন্দেহে আপনার হৃদয় নামক যন্ত্রে নেমে আসবে গভীর ছায়া।
উদাহরণ দুইটির মাধ্যমে বুঝতেই পারছেন পরিবেশ আমাদের জিহব্বার স্বাদ থেকে পছন্দ পর্যন্ত সব কিছুর পরিবর্তন ঘটাতে সক্ষম। মূলত বায়ালোজিক্যালি এটি প্রমাণিত যে, জন্মগতভাবে আমরা অল্প কিছু প্রোগ্রাম নিয়ে পৃথিবীতে আসি আর মানুষিক বিকাশের সবকিছু যেমন, ভালো লাগা, পছন্দ, রুচি ইত্যাদি সবই পরিবশে থেকে পাওয়া। তাই শিশু কিশোরদের সৃজনশীল এবং গঠনমূলক শিক্ষাসহ উন্নত মানুষিক বিকাশের জন্য সুষ্ঠ এবং সুন্দর পরিবেশর ভূমিকা অপরিসীম।
নেতিবাচক পরিবেশে বড় হোক প্রতিটি শিশু
প্রত্যেক শিশু কিশোরদের জন্য জন্মের প্রথম ৬ বছর অত্যান্ত গুরুত্বপূর্ণ। মূলত শিশু কিশোরদের ভালো লাগা, পছন্দ, রুচি ইত্যাদি মানুষিক বিকাশের প্রায় সবকিছু একটি শিশু প্রথম ছয় বছরে পরিবেশ থেকে অর্জন করে। এজন্যই পিতামাতাদের উচিত জন্মের প্রথম ছয় বছর সন্তানদের প্রতি সম্পূর্ণ আলাদা প্রস্তুতির ব্যবস্থা করা। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে নেতিবাচক পরিবেশে শিশুদের বড় করা খুবই কঠিন একটি কাজ। এজন্য প্রতিটি অভিভাবক বা বাবা-মাকে শিশুর জন্মের প্রথম ছয় বছর এমন একটি পরিবেশ সৃষ্টির মাধ্যমে বড় করতে হয়ে যাতে সেখানে কোনো প্রকার ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি না থাকে। আধুনিক বিশ্বের এই সময়ে আমাদের প্রাণের শিশুদের জন্য পরিবেশ পরিবর্তন করার ছোট তবে জটিল এই কাজটি করতে পারলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে শিশু কিশোররা এগিয়ে যাবে পরবর্তী চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় কয়েক ধাপ উপরে।
ভবিষ্যতের প্রতিচ্ছবি তুলে ধরুন
বর্তমানে আমরা যারা ক্যারিয়ার নিয়ে সচেতন তারা একটু খেয়াল করলে দেখবেন একটি জিনিসে বা বিষয়ের উপর আমাদের বেশিদিন ধর্য থাকে না বা কারো কারো তো নির্দিষ্ট্য কোনো গোল বা উদ্দেশ্য থাকে না। কি ভয়ানক! আপনারা যারা এই পরিস্থিতির মধ্যে আছেন তাদের উদ্দেশ্যে একটি পরিসংখ্যান শেয়ার করি। বাংলাদেশে প্রতিবছর উচ্চ পদস্থ থেকে নিম্ন পদস্থ সরকারি চাকরি পান এমন মানুষের সংখ্যা প্রায় ২ লক্ষ্য আর অন্যদিকে প্রতিবছর শ্রম-বাজারে যুক্ত হচ্ছে প্রায় ২২ লক্ষ্য শিক্ষিত নাগরিক।
কিন্তু কখনো কি ভেবে দেখেছেন, বেশিদিন ধৈর্য ধরে কোনো কাজে লেগে না থাকা কিংবা গোল বা উদ্দেশ্যে না থাকা বা ক্যারিয়ারে ফোকাস না থাকার মূল কারণ আসলে কথায়? মূলত এর প্রধান কারণ ছোটবেলা থেকে পারিপার্শ্বিক বিভিন্ন চাপে আমরা আমাদের পছন্দের জিনিসগুলো যেমন করতে পারি না ঠিক অন্যভাবে চিন্তা করলে আমাদের নির্দিষ্ট গঠনমূলক কোনো উদ্দেশ্য থাকে না। এজন্যই অভিবাবকদের চেষ্টা করতে হবে ছোটবেলা থেকেই সন্তানদের মাঝে বিভিন্নরকম ভবিষ্যতের প্রতিচ্ছবি তুলে ধরার। যাতে পরবর্তীতে তারা বাস্তবতার সাথে ভারসাম্য রক্ষার মাধ্যমে অসাধারণ একটি ক্যারিয়ার বেছে নিতে পারে।
সৃজনশীলতার প্রতি গুরুত্ব দিন
শিশুকিশোরদের সৃজনশীলতা প্রয়োগের অন্যতম মাধ্যম আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো। মজার বিষয় এক্ষেত্রে বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। কারণ আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় সৃজনশীলতার প্রভাব খুবই কম। তাই একজন বুদ্ধিমান অভিবাবক হিসাবে সন্তানদের সৃজনশীল করে গড়ে তোলার পুরো দায়িত্ব এই মুহুর্তে আপনার নিজের উপর নেওয়া উত্তম।
আচ্ছা এই বলুন তো, কেন আমরা এই গুরুদায়িত্বটা নিজে থেকে নিব? আপনাদের বুঝতে যাদের সমস্যা হচ্ছে তাদের উদ্দেশ্য বলছি, গত ১৩ জুলাই গণিত অলিম্পিয়াডে (আইএমও) চট্টগ্রামের ক্যান্টনমেন্ট ইংলিশ স্কুল ও কলেজের ছাত্র আহমেদ জাওয়াদ চৌধুরীর সর্বপ্রথম স্বর্ণপদক জয়ের গল্পটা ভুলে যাননি নিশ্চয়ই। আপনি কি জানেন? কলেজ পড়ুয়া স্বর্ণজয়ী মেধাবী সৃজনশীল এই শিক্ষার্থীটি প্রাইমারি তথা প্রাথমিক পর্যায় থেকে গণিত অলিম্পিয়াডের সাথে যুক্ত।
স্বর্ণপদক জয়ের উদাহরণটি দেওয়ার একমাত্র উদ্দেশ্য, একটি শিশুকে ছোটবেলা থেকে নানারকম ইতিবাচক সৃজনশীলতায় বড় করলে এরকম স্বর্ণজয়ের স্বপ্ন যেকোনো বাবা-মা দেখতে পারেন, এতে কোনো সন্দেহ নাই। আর প্রযুক্তির কল্যাণে আপনার সন্তানকে বিভিন্ন সৃজনশীল বিষয়বস্তুর সাথে পরিচয় করা তো এখন অনেক সহজ হয়ে গেছে। এজন্য আপনার সন্তানকে সঠিক পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে পছন্দের বিষয়ের উপর গঠনমূলক সৃজনশীল শিক্ষাদানে উদ্বুদ্ধ করতে পারলেই সৃজনশীলতার পরিপূর্ণ একটি ইকোসিস্টেম তৈরি হয়ে যাবে।