স্টেল্থ টেকনোলজি: রাডারের চোখ ফাঁকি দেওয়া যখন গুরুত্বপূর্ণ

Source: Defencyclopedia

রাডারের চোখ যুদ্ধক্ষেত্রে কতটা কার্যকরী সেটা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের যোদ্ধারা ভালোভাবেই অবগত হয়েছিলো। নিজেদের ক্ষেত্রে রাডার যেমন যুদ্ধে সফলতা এনে দিয়েছে তেমনি শত্রুপক্ষের হাতে একই প্রযুক্তি থাকার অনেক যুদ্ধে পরাজিত হতে হয়েছে। রাডারের চোখ ফাঁকি দেওয়া যখন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে তখন বিভিন্ন দেশের বিজ্ঞানীরা এই প্রযুক্তির উন্নয়নে লেগে পড়েছিলো। আর এই স্টেল্থ টেকনোলজি নিয়েই আমাদের আজকের এই ফিচার।

ইতিহাস

যুদ্ধক্ষেত্রে শত্রুপক্ষ হতে নিজেদের গোপন রাখার প্রচেষ্টা মানুষের বহু আগে থেকে। নিজেদের যুদ্ধজাহাজ, বিমান, ডুবোজাহাজের অবস্থান গোপন রাখার জন্য প্রতিটি দেশেই বিভিন্ন পন্থা অবলম্বন করেছিলো। মিলিটারি ক্যামোফ্লাশ থেকে ব্যবহার করা হয়েছে রাডার শোষণকারী উপাদান। পূর্ণাঙ্গ আধুনিক স্টেল্থ টেকনোলজির দেখা ১৯৫৮ সনে আমেরিকার হাত ধরে মিললেও বিশ্বের প্রায় সকল দেশেই এই বিষয়ে গবেষণা করেছে।

স্টেল্থ টেকনোলজির শুরুটা হয় প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকে। জার্মান গবেষকরা নিজেদের বিমানের অবস্থান অদৃশ্য করার উদ্যেশ্য সেলুলোস অ্যাসেটেট ব্যবহার করে। যেটা কিনা একধরনের স্বচ্ছ ধরনের উপাদান। তবে যখন ফোকার ই – ৩, আলবাট্রস সি.আই বাইপ্লেনে সেলুলোস অ্যাসেটেট ব্যবহার করা হয় তখন এর সুফল পাওয়া যায়নি। কারন বিমানকে অদৃশ্য রাখার পরিবর্তে উল্টো সূর্যের আলোয় বেশি স্পষ্ট করে তুলছিলো এই উপাদান।

Albatros C.I
Source: Wiki

পরবর্তী ১৯১৬ সালে ব্রিটিশ ইঞ্জিনিয়াররা ছোট আকৃতির এসএস ক্লাসের এয়ারশিপ তৈরি করেন। উদ্দেশ্য ছিলো ওয়েস্টার্ন ফন্টে জার্মান সিমান্তে পর্যবেক্ষণ করা। এয়ারশিপটি নিজেকে শত্রুপক্ষ হতে অদৃশ্য রাখতে সক্ষম হলেও জার্মানদের বিষয়ে তেমন গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সংগ্রহে সহায়তা করতে পারেনি।তাই প্রজেক্টটি ভবিষ্যতের মুখ দেখেনি।

SS class airship
Source: Wiki

অন্যদিকে জার্মান বিজ্ঞানীরাও কম যান না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তারা তৈরি করে ইউ-৪৮০ মডেলের ডুবোজাহাজ। এনাকোয়িক টাইলস দিয়ে পুরো ডুবোজাহাজটিকে মুড়ে দেওয়া হয়েছিলো। ফলে ডুবোজাহাটি সোনার ফাঁকি দেওয়ার সক্ষমতা অর্জন করে।

আর এদিকে আমেরিকান বিজ্ঞানীরা স্নায়ুযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে তৈরি করে লকহিড ইউ – ২ (ড্রাগন লেডি নামেও পরিচিত) স্পাই বিমান। তবে আশানুরূপ ফলাফল না পাওয়ায় ১৯৫৮ সালে আমেরিকান সিআইএ এই বিষয়ে নতুন করে গবেষণার অনুরোধ করে। পরবর্তীতে লকহিড কোম্পানি নির্মাণ করে  এ – ১২ মডেলের বিমানটি। যেটা কিনা টপ সিক্রেট ব্লাকবার্ড প্রজেক্টের অংশ ছিলো।

৭০ থেকে ৮০ হাজার উচ্চতায় এই বিমান শব্দের থেকে ৩.২ গুন দ্রুত চলতে পারতো। যেটা কিনা রাডার ফাকি দেওয়ার কাজে সহায়তা করে। এছাড়া এই বিমানে রাডার শোষণকারী রঙ ব্যবহার করা হয়েছিলো। যেটার সর্বপ্রথম দেখা মিলেছিলো ১৯৬০ সালে ইউএসএএফের মাধ্যমে। তাদের তৈরি রাগান কিউ – ২ সি ফায়ারবি ড্রোনের এই রঙের ব্যবহার প্রথম ব্যবহার করে। যেটা কি না রাডার ফাঁকি দিতে সক্ষম হয়েছিলো। তাই এই প্রযুক্তি ব্লাকবার্ড প্রজেক্টে ব্যবহার করা হয়।

A-12
Source: Wiki

এরপর রাডার ফাকি দেওয়ার উদ্যেশ্যে যুদ্ধজাহাজ আর বিমানের আকৃতিতে পরিবর্তন হতে থাকে। ব্যবহার করা হয় আরো শক্তিশালী রাডারের তরঙ্গ শোষনকারী উপাদান। আর এই দুই ধরনের প্রযুক্তির মিশ্রণ ঘটিয়ে ১৯৮৯ সনে বিশ্বের সর্বপ্রথম পূর্ণাঙ্গ স্টেল্থ বোমারু বিমান নর্থরপ বি – ২ স্পিরিট তৈরি করা হয়।

যেভাবে কাজ করে

স্টেল্থ টেকনোলজি কিভাবে কাজ করে সেটা বুঝতে হলে আমাদের জানতে হবে রাডার কিভাবে কাজ করে। রাডার এন্টেনার সাহায্যে চারদিকে রেডিও ওয়েব প্রেরণ করে। যখন সেই ওয়েব কোনো বস্তুতে গিয়ে বাধাগ্রস্ত হয় তখন সেটা প্রতিফলিত হয়ে ফিরে আসে। আর সেই প্রতিফলিত ওয়েব রাডারের এন্টেনা গ্রহণ করে ডিসপ্লেতে বস্তুর অবস্থান দেখায়। এখন যদি এমন ব্যবস্থা করা করা যে বস্তুতে রাডারের ওয়েব বাধাগ্রস্ত হওয়ার পর সেটা প্রতিফলিত হয়ে ফিরে আসবে না, তাহলেই রাডার ফাঁকি দেওয়া সম্ভব। আর এই লক্ষ্য দুইভাবে পূরণ করা সম্ভব।

Source: Defencyclopedia

প্রথমত বস্তুর গঠনগত পরিবর্তন করে। আর এই উদ্যেশ্যে বিমানের গঠন এমনভাবে করা হয় যে রেডিও ওয়েব যখন সেখানে বাধাগ্রস্ত হবে তখন সেটা ভিন্ন ভিন্ন দিকে চলে যাবে। ছবিতে দেখুন, যখন রাডারের ওয়েব বিমানে গিয়ে বাধাগ্রস্ত হয়েছে তখন সেগুলোর প্রায় সবই প্রতিফলিত হয়ে ভিন্ন ভিন্ন দিকে চলে যাচ্ছে। হ্যাঁ, এটা ঠিক যে কিছুটা পরিমাণ রেডিও ওয়েব ঠিকই রাডারের দিকে প্রতিফলিত হবে। কারণ ডিজাইন যতই ভালো হোকনা কেন রাডারের সাপেক্ষে বিমানের অবস্থানের কারন এটা হবেই। এই সমস্যার সমাধান করা হয়েছে, দ্বিতীয় পদ্ধতি রাডার সিগনাল শোষক উপাদান দিয়ে।

কাউন্টার টেকনোলজি

রাডার ফাঁকি দিতে স্টেল্থ টেকনোলজি ব্যবহার করা হলো। পরিবর্তন আনা হলে বিমান আর জাহাজের গঠনে। ব্যবহার করা হলো রাডার শোষক উপাদান। তবে কথা হচ্ছে শত্রুপক্ষরা যদি এই টেকনোলজি ব্যবহার করে আক্রমণ করে তাহলে সেটা কি ঠেকানো যাবে? হ্যাঁ যাবে। স্টেল্থ টেকনোলজি আবিষ্কারের পরে এর কাউন্টার টেকনোলজি বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেছেন। কয়েকভাবে স্টেল্থ টেকনোলজির প্রতিকার করা হয়।

১. লো ফ্রিকোয়েন্সি রাডার

অনেক দূরের যুদ্ধজাহাজ বা বিমানের অবস্থান সাথে সাথে পাওয়ার জন্য রাডারে উচ্চ ফ্রিকোয়েন্সি ব্যবহার করা হয়। যার ফলে অবকাঠামোগত পরিবর্তন নিয়ে আসলে রাডার ফাঁকি দেওয়া সম্ভব হয়। তবে যদি নিম্ন ফ্রিকোয়েন্সি ব্যবহার করা হয় তাহলে এই সমস্যার প্রতিকার পাওয়া সম্ভব। তবে লো ফ্রিকোয়েন্সিতে রেডিও স্টেশন থেকে শুরু হয়ে অনেক কাজেই ব্যবহার করা হয়। তাই রাডারের জন্য এটা ব্যবহার করা সমস্যা হয়ে দাড়িয়েছে। তাছাড়া নিম্ন ফ্রিকোয়েন্সির ব্যবহার করলে নিখুঁতভাবে অবস্থান পাওয়াও কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।

২. একাধিক ইমিটার

(ট্রান্সমিটার) ব্যবহার করলে রাডার ফাঁকি দেওয়া কঠিন হয়ে ওঠে।

৩. বায়ুমন্ডলে যখন কোন বস্তু বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি তখন স্লিরেন ইফেক্ট সৃষ্টি হয়। আর স্লিরেন ফটোগ্রাফির মাধ্যমে তখন জাহাজ / বিমানের অবস্থান নির্ণয় করা সম্ভব হয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *