গত পর্বের পর এবার আসলাম আরো কয়েকজন জগৎ বিখ্যাত বাঙ্গালি বিজ্ঞানীদের জীবনী ও তাদের গবেষণা কর্ম নিয়ে। দুঃখের বিষয় হলো আমরা বাঙ্গালিরা ইউরোপ আমেরিকান বিজ্ঞানীদের প্রশংসায় এত মত্ত থাকি যে, বাঙ্গালি বিজ্ঞানীদের গবেষণা কর্ম দেখার ফুসরত পাই না। বাঙ্গালি এই প্রতিভাবানরা নানান আর্থিক ও বিজ্ঞান গবেষণা পরিবেশের অভাব থাকা সত্ত্বেও তাদের অসীম মেধা দ্বারা বিশ্ব দরবারে নিজেদের দেশ ও কাজকে মর্যাদাবান করেছেন। বিশ্বদরবারে তাদের পরিচিতি থাকলেও তার এক-দশমাংশও নিজ দেশে নেই! এটা জাতির জন্য খুবই লজ্জাজনক বটে। তাই এখনই সময় বাঙ্গালি বিজ্ঞানীদের জীবন ও কর্ম সম্পর্কে জানার।
আব্দুস সাত্তার খান
আব্দুস সাত্তার খানকে আমাদের দেশের মানুষ খুব একটা না চিনলেও যুক্তরাষ্ট্রে তিনি খুবই জনপ্রিয় একজন বিজ্ঞানী। সেখানে তার ব্যাপক সুনাম রয়েছে এবং অনেক সম্মননা অর্জন করেছেন। ধাতব প্রকৌশল বিদ্যায় শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানীদের খাতায় নিজের নাম লিখিয়েছেন। প্রায় ৪০ টিরও বেশি সংকর ধাতুর আবিষ্কারক তিনি। তিনি এই সংকর ধাতুগুলো মূলত জেট ইঞ্জিন, টার্বাইন ইঞ্জিন প্রভৃতিকে টার্গেট করে তৈরি করেছেন। এই ধাতুগুলোর উচ্চতাপমাত্রায় কোনো ক্ষতি হয় না এবং এগুলো জারণ প্রতিরোধী, ইঞ্জিন হালকা করে তোলে। ফলে বিভিন্ন জেট ইঞ্জিন, টার্বাইন ইঞ্জিন চলাকালের উচ্চ তাপমাত্রাসম্পন্ন পরিবেশে এই ধাতুগুলো ব্যবহার করা হয়ে থাকে।
সাত্তার খানের তৈরি করা একটি নিকেল বেস সংকর ধাতু মার্কিন যুদ্ধবিমান F-15 এবং F-16 এ ব্যবহার করা হয়েছে। যা এগুলোর ফুয়েল ইফিসিয়েন্সি অনেক বাড়িয়ে দিয়ে জ্বালানী সাশ্রয় করেছে। এজন্য ১৯৮৬ সালে মার্কিন বিমানবাহিনী তাকে ‘ইউনাইটেড টেকনোলজিস স্পেশাল অ্যাওয়ার্ড’ প্রদান করে। তার তৈরি সংকর ধাতুগুলো নাসার বিভিন্ন স্পেস সাটলে এবং অনেক ক্ষেপণাস্ত্রেও ব্যবহৃত হয়েছে। এজন্য নাসা হতেও ‘ইউনাইটেড টেকনোলজিস রিসার্চ সেন্টার অ্যাওয়ার্ড অব এক্সিলেন্স’ পদক পান।
সাত্তার খানের মত অন্য কোনো বাঙ্গালি বিজ্ঞানী আমেরিকা হতে এত বেশি সম্মননা পেয়েছেন বলে মনে হয় না। সারাবিশ্বের এয়ার ইন্ডাষ্ট্রিতে তার তৈরি করা সংকর ধাতুগুলো একটি বিপ্লব ঘটিয়েছে। আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয়, নাসা, বিমানবাহিনী, গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোতে সাত্তার খানের নাম উচ্চারিত হলেও বাংলাদেশে জন্ম নেওয়া এই প্রতিভাবানের নাম খুব বেশি মানুষ জানে না!
চলুন এয়ার ইন্ডাষ্ট্রিতে বিপ্লব ঘটানো এই প্রতিভাবান সমন্ধে একটু জেনে আসি।
আব্দুস সাত্তার খান ১৯৪১ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৬২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে রসায়ন বিভাগে স্নাতক এবং ১৯৬৩ সালে মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন। ঐ বছরেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৬৪ সালে তিনি অক্সফোর্ডে পাড়ি জমান উচ্চতর ডিগ্রী অর্জনের জন্য। ১৯৬৮ সালে অক্সফোর্ড হতে PhD ডিগ্রী অর্জন করেন এবং দেশে ফিরে আবার শিক্ষকতায় যোগদান করেন।
১৯৭৩ সালে তিনি গবেষণার কাজে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান এবং নাসার ইউনাইটেড টেকনোলজি এবং অ্যালস্টমে গবেষণা কর্ম শুরু করেন। মূলত নাসাতে থাকাকালীন সময়েই তিনি সংকর ধাতুগুলো আবিষ্কার করতে সক্ষম হন। ফ্লোরিডা স্টেট ইউনিভার্সিটিতে অধ্যাপক হিসেবে যোগদানের পর কার্বন ন্যানো-টেকনোলজি সম্পর্কিত একটি গবেষণা সম্পন্ন করার পর ব্যাপক সুনাম অর্জন করেন।
বাংলার এই প্রতিভাবান শুধু বিজ্ঞানেই অবদান রাখেননি, দেশের বিপদের সময়ও সবার আগে ছুটে এসেছিলেন। ১৯৯১ সালে বাংলাদেশের প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ের সময় তিনি রেডক্রসের মাধ্যমে ৬১ হাজার ডলার বাংলাদেশে পাঠান। আব্দুস সাত্তার খান যুক্তরাষ্ট্রে তার ব্যাপক সুনামের প্রভাব খাটিয়ে টেক্সাসের লামার বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে একটি যোগসূত্র স্থাপন করে দিয়েছেন। যার কারণে লামার বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থীরা বিশেষ সুবিধা পেয়ে থাকেন। যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডায় বাংলাদেশী প্রবাসীদের সুবিধার্থে তিনি সেখানে Bangladeshi Association of Florida প্রতিষ্ঠা করেন।
২০০৮ সালে ফ্লোরিডাতে এই প্রতিভাবান শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
শুভ রায়
বর্তমান বিশ্বে বিজ্ঞানের যে শাখাগুলো বেশী এগিয়ে যাচ্ছে তার মধ্যে অন্যতম হল বায়োমেডিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং। বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে আমাদের দেশের বিজ্ঞানীরাও যে এই ক্ষেত্রে তাদের অবদান রেখে যাচ্ছেন। তার খবর রাখে কয়জন?
বলছিলাম শুভ রায়ের কথা, যিনি কৃত্তিম কিডনি আবিষ্কার করে সারা বিশ্বে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন।
প্রযুক্তির সবচেয়ে বেশী প্রয়োগ হচ্ছে এখন মেডিকেল সেক্টরে। উন্নত বিশ্বের সরকারগণ বায়ো-মেডিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং সেক্টরে কোটি কোটি ডলার অনুদান দিচ্ছেন সর্বোত্তম চিকিৎসা সেবা প্রদানের লক্ষ্যে। প্রযুক্তি এবং আর্থিক সংকটের কারণে তৃতীয় বিশ্বের রাষ্ট্রগুলোর মতো আমাদের দেশের সরকারও এই সেক্টরে পর্যাপ্ত পরিমানে অনুদান দিতে পারছে না। কিন্তু তাই বলে আমাদের দেশের দেশের প্রতিভাবানরা থেমে নেই। উন্নত বিশ্বের গবেষণা কেন্দ্রগুলোতে নিজ মেধা দ্বারা ঠিকই জায়গা করে নিচ্ছেন। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশী সাড়া ফেলেছেন শুভ রায়।
Cleveland Clinic মেডিকেল রিসার্চের জন্য সারাবিশ্বে র্যাঙ্কিং এ ২ নাম্বারে আছে, সেখানে শুভ রায় ১৯৯৮ সাল হতে ২০১১ সাল পর্যন্ত বহু গবেষণা কার্যে নিয়োজিত ছিলেন।
শুভ রায় ১৯৬৯ সালে ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা অশোক রায় পেশায় চিকিৎক ছিলেন। পেশাগত কারণে অশোক রায় উগান্ডায় চলে যাওয়ায় শুভ রায়ের বাল্যকাল সেখানেই কাটে। অতঃপর উচ্চশিক্ষার জন্য তিনি যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান। যুক্তরাষ্ট্রের ওহাইওর মাউন্ট ইউনিয়ন কলেজ (বর্তমানে ইউনিভার্সিটি অব মাউন্ট ইউনিয়ন) থেকে তিনি কম্পিউটার বিজ্ঞান, পদার্থবিজ্ঞান ও গণিতে গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন করেন। ১৯৯৫ সালে শুভ রায় কেস ওয়েস্টার্ন রিজার্ভ ইউনিভার্সিটি থেকে তড়িৎ প্রকৌশল ও ফলিত পদার্থবিজ্ঞানে মাস্টার্স এবং ২০০১ সালে তড়িৎ প্রকৌশল ও কম্পিউটার বিজ্ঞানে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন।
২০০১ সাল হতে ২০০৮ সাল পর্যন্ত তিনি Cleveland State University এবং Case Western Reserve University তে শিক্ষকতার পেশায় নিয়োজিত ছিলেন। ২০০৮ সালে তিনি University of California, San Francisco তে বায়ো ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড থেরাপিউটিক সায়েন্স বিভাগে যোগদান করেন এবং বর্তমানে তিনি উক্ত বিভাগে অধ্যাপক হিসেবে নিয়োজিত আছেন।
ড. শুভ রায় বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও ইউনির্ভার্সিটি কর্তৃক বিভিন্ন সম্মননায় ভূষিত হয়েছেন। এছাড়া বায়ো মেডিকেল সাইন্সের উপর তার লেখা একাধিক বই রয়েছে যেগুলো বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্যবই হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
মেঘনাধ সাহা
বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে ইউরোপিয়ান, আমেরিকানরা যখন বিজ্ঞানে একের পর এক বিল্পব ঘটিয়ে যাচ্ছিলেন ভারতীয় উপমহাদেশ তখন সাহিত্যের জোয়ারে ভেসে যাচ্ছিলো। অবশ্য সেসময় বিজ্ঞান গবেষণার পরিবেশ ভারতীয় উপমহাদেশে তেমন একটা ছিল না। সেইসময় এই উপমহাদেশের গুটিকয়েক বিজ্ঞানীই বিশ্ব দরবারে সাড়া ফেলতে সক্ষম হয়েছিলেন। তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন ঢাকার একটি দরিদ্র পরিবারে জন্ম নেওয়া মেঘনাদ সাহা। তার বিখ্যাত ‘সাহা ইকুয়েশন’ এবং ‘থার্মাল আয়োনাইজেশন’ থিওরী দ্বারা অ্যাস্ট্রোফিজিক্সের দুনিয়ায় পুরো তাক লাগিয়ে দেন।
১৯৩০ সালে ও ১৯৩৭ সালে তিনি পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনিত হয়েছিলেন কিন্তু নোবেল কমিটি গবেষণা কর্মকে একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যবহার হিসেবে উল্লেখ্য করে, কোনো আবিষ্কার হিসেবে নয়। তাই মেঘনাধ সাহা নোবেল পুরস্কার হতে বঞ্চিত হন। জগৎ বিখ্যাত বিজ্ঞানী আইন্সটাইন মেঘনাধ সাহা সম্পর্কে বলেন,”Dr. M.N. Shaha has won an honoured name in the whole scientific world.”
মেঘনাদ সাহা ১৮৯৩ সালে ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন। ১৯১৩ সালে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ হতে গণিতে স্নাতক ডিগ্রী অর্জনের পর ১৯১৯ সালে তিনি কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় হতে ডক্টরেট ডিগ্রী অর্জন করেন। ১৯২৭ সালে তিনি রয়েল সোসাইটির ফেলো নির্বাচিত হন। তিনি কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে সত্যেন্দ্রনাথ বসু ও প্রশান্ত চন্দ্র মহালনবিশের সহপাঠী এবং আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসু ও আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের ছাত্র ছিলেন। ১৯৫৬ সালে মেঘনাধ সাহা দিল্লিতে হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যুবরণ করেন।