শুধুমাত্র নিজের কাঙ্ক্ষিত বেতনের কাজ পেলেই তাকে ভালো চাকরি বলে না, ভালো চাকরি হতে হলে কাজটির মধ্যে অবশ্যই নিজের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন থাকতে হবে, সাথে সাথে সহকর্মী এবং একজন ভাল বস থাকতে হবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত সব প্রতিষ্ঠানে এমন কর্ম পরিবেশ এবং কাঙ্ক্ষিত বস পাওয়া যায় না। চাকরির সম্মানী যত ভালই হোক একজন ভাল বস না পেলে সেই কাজে স্বস্তি পাওয়া যায় না। এমনকি স্বাচ্ছন্দ্যপূর্ণ কাজ বাধাগ্রস্ত হওয়ার সাথে সাথে কাজ হারানোরও ভয় থাকে! কেননা একজন খারাপ বসের সাথে সবসময়ই কর্মীদের ভালো অভিজ্ঞতা সৃষ্টি হয় না।
তবুও জীবনের প্রয়োজনে বাধ্য হয়ে আমাদের কাজ করতে হয়। আমরা চাইলেই অফিসের বস পরিবর্তন করতে পারি না, বরং কর্পোরেট রাজনীতির খপ্পরে পড়ে নিজের অবস্থানই পরিবর্তন হয়ে যায়। তাই সাধারণ কর্মীদের খারাপ বসের সাথে আপোষ করেই চলতে হয়। কিন্তু এই আপোষ তখনই করা যায় যখন খারাপ বসের গতি-প্রকৃতি সার্বক্ষণিকভাবে অনুধাবন করা যায়।
আজকের এই নিবন্ধে এমন কয়েকটি বিষয় নিয়ে আলোচনা করবো যেসব বিষয় মাথায় রাখলে একজন খারাপ বসকে খুব সহজেই আপনি চিহ্নিত করতে পারবেন এবং তার সাথে সুসম্পর্ক বজায় রেখে কাজের পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারবেন।
১. অসৌজন্যমূলক আচরণ এবং দলের সাথে কম যোগাযোগ
যোগাযোগ সফল সম্পর্কের চাবিকাঠি। কর্মীদের থেকে ভাল কাজ আদায় করতে বসকে হতে হয় চমৎকার যোগাযোগ দক্ষতা সম্পন্ন। পরিবারের লোকদের সাথে মানুষের সম্পর্ক যেমন নিবিড়, কর্মীদের সাথে বসের সম্পর্ক তেমন নিবিড়। কিন্তু আপনার বস যদি খারাপ প্রকৃতির মানুষ হয়ে থাকে তবে তিনি এই সম্পর্কের গুরুত্ব বুঝবেন না। তিনি চিৎকার করে কথা বলবেন, কর্মীদের সাথে অসৌজন্যমূলক আচরণ করবেন এবং নিজেকে কর্মীদের অধিকর্তা জ্ঞান করবেন। এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হলে বুঝতে হবে তিনি আত্ম-অহমিকায় ভুগছেন।
কোম্পানির যেকোনো খারাপ পরিস্থিতিতে বসকে জানতে হয় কিভাবে দলের সাথে যোগাযোগ করতে হবে। কিভাবে গোটা টিম সুন্দরভাবে সাজাতে হবে, তাদের দিকনির্দেশনা দিতে হবে। একজন ভাল বসের অন্যতম প্রধান গুণ হলো প্রকল্প সম্বন্ধে কর্মীদের স্পষ্ট এবং বাস্তবসম্মত ধারণা দেওয়া, তাদের কাজকে সহজ করে তোলা। কিন্তু আপনার বস যদি খারাপ প্রকৃতির মানুষ হয় তবে তিনি সম্পূর্ণ উল্টো আচরণ করবেন। তিনি কর্মীদের কাজ বুঝিয়ে না দিয়েই কাজ আদায় করার চেষ্টা করবেন।
এমন বসের খপ্পরে পড়লে আপনাকে অবশ্যই কাজ এবং যোগাযোগের ক্ষেত্রে কৌশলী হতে হবে। চাকরির প্রয়োজনে আপনাকে বাধ্য হয়ে অনেক কিছুই হজম করতে হবে। নিজেদের কাজ নিজেরা বুঝে নিতে হবে এবং সময়মতো সম্পাদন করতে হবে। তারপরও বসের আচরণ যদি সহ্য সীমা অতিক্রম করে তবে নীরবে এই চাকরি ছেড়ে অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানে চাকরি খোঁজাই শ্রেয়।
একজন বস হিসেবে যদি এই অভ্যাস আপনার মধ্যে থাকে তবে তা এখনই ত্যাগ করুন এবং আধুনিক যুগের কর্মীদের সাথে যতটা সম্ভব সৌজন্যমূলক আচরণ করুন। কাজের প্রয়োজনে কর্মীদের সাথে গভীর যোগাযোগ রক্ষা করুন।
২. ভয় প্রেরণার উৎস
যেকোনো কাজ সফলভাবে করতে প্রেরণা লাগে। একজন কর্মচারী কোম্পানির জন্য কতটা নিবেদিত হয়ে কাজ করবে তা নির্ভর করে কোম্পানির ঊর্ধ্বতনরা তাকে কতটা প্রেরণা দিয়ে থাকে তার উপর। পৃথিবীতে সব সফল প্রতিষ্ঠান প্রতিনিয়ত তাদের কর্মীদের নানান ভাবে অনুপ্রাণিত করে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে কিছু ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা মনে করেন কর্মীদের কাছ থেকে অধিক কাজ আদায় করার সবচেয়ে চমৎকার পন্থা হলো সবসময় তাদের ভয়ের মধ্যে রাখা, অর্থাৎ এই বসদের কাছে ভয় হল প্রেরণার উৎস! সুতরাং কর্মীদের থেকে বেশী কাজ আদায় করতে তারা কর্মীদের সব সময় নানান রকম ভয়ের মধ্যে রাখে।
এই প্রবণতা উপনিবেশিক শাসনের শামিল। এখন সময় পাল্টেছে। মানুষের চিন্তা চেতনা অনেক বেশি উন্নত হয়েছে। সুতরাং এই পদ্ধতিতে কর্মীদের অনুপ্রাণিত করার ধারণা ঠিক না। কর্মীদের ইতিবাচক প্রেরণা যেমন কর্মস্পৃহা বাড়িয়ে দেয়, তেমনি তাদের ভয় দেখালে প্রতিষ্ঠানে ক্ষতির সম্ভাবনাও বেড়ে যায়।
সুতরাং একজন বস হিসেবে যদি আপনি এমন ধ্যান-ধারণার পোষণ করে থাকেন তবে আজই আপনার চিন্তা ভাবনায় পরিবর্তন আনা প্রয়োজন। ইতিবাচক প্রেরণা কর্মীদের জন্য পুরস্কারের শামিল। তবে অবশ্যই ভুল হলে তাদের গঠনমূলক সমালোচনা করতে হবে। সেই সমালোচনা অবশ্যই সম্মানজনক পন্থায় হতে হবে।
৩. সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা
কোনো কোম্পানি একজন নতুন মানুষকে কর্মী হিসেবে নিয়োগ দেয় তখনই যখন সেই ব্যক্তি কোম্পানির প্রত্যাশা অনুযায়ী সকল যোগ্যতা পূরণ করে এবং নির্ধারিত কাজ সম্পাদন করার যাবতীয় দক্ষতা এবং যোগ্যতা তার মধ্যে থাকে। তাছাড়া যেকোনো প্রতিষ্ঠানের সকল কর্মীর ব্যক্তিগত জীবন আছে।
বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বসরা কর্মীদের ওপর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেন। সাধারণত কর্মীকে কাজ বুঝিয়ে দেওয়া এবং মাঝে মধ্যেই তাকে নির্দেশনা দেওয়া বসের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। কিন্তু কোনো কোনো অতিউৎসাহী বস কর্মীদের প্রত্যেকটি পদক্ষেপ নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। এমনকি তাদের ব্যক্তিগত জীবনও! এমন অবস্থায় কর্মীরা ব্যক্তিগত দক্ষতার উন্নতি এবং আত্মসম্মান হারানোর ঝুঁকিতে থাকেন।
একজন ভালো বস কখনোই এই প্রচেষ্টা চালায় না। যেকোনো প্রকল্প সফলভাবে সম্পাদন করার জন্য তিনি সম্পূর্ণভাবেই কর্মীদের ওপর নির্ভর করেন। কর্মীদের কাজের স্বাধীনতা দেন। তিনি শুধুমাত্র যথাযথ নির্দেশ দিয়ে থাকেন এবং প্রয়োজনীয় সময় পরামর্শ দেন। কর্মীদের পাশে থাকেন, কর্মীদের ব্যক্তিগত জীবনে কখনোই হস্তক্ষেপ করার চেষ্টা করেন না। তাছাড়া ব্যক্তিগত বিশেষ প্রয়োজনে কর্মীকে বিশেষ স্বাধীনতা দিয়ে থাকেন।
৪. ব্যর্থতার জন্য দোষারোপ করা
প্রতিষ্ঠানের কাজে সাফল্য ব্যর্থতা দুটোই থাকে। সবসময়ই কাজে সাফল্য আসবে এমন কোনো নিশ্চয়তা নেই। একটি টিম কোনো প্রকল্প সফল করার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালানোর পরও যদি প্রকল্পটি ব্যর্থ হয় তবে নিচু মানসিকতার বসেরা টিম এবং টিম মেম্বারদের এই ব্যর্থতার জন্য দোষারোপ করেন। তিনি খুঁজে দেখার চেষ্টা করেন কার কি ভুল আছে, কার কি দোষ আছে! সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালানোর পরও ব্যর্থতার দোষ কাঁধে আসা যেকোনো কর্মীর জন্যই অসম্মানজনক। কর্মীদের ব্যর্থতায় দোষারোপ করলে তার আত্মবিশ্বাস কমে যায়, কর্মস্পৃহা কমে যায়, এবং কর্মীরা সবসময় হীনমন্যতায় ভোগেন।
দলের মধ্যে শৃঙ্খলা থাকা আবশ্যক। তাই বিচক্ষণ বস কখনোই দলের ব্যর্থতায় কাউকে দোষারোপ করেন না, বরং সর্বদা কর্মীদের পাশে থাকেন। তাদের অনুপ্রাণিত করেন। এই ব্যর্থতাকে কাটিয়ে ওঠার পথ বাতলে দেন। কর্মীদের ব্যর্থতা নিজের ব্যর্থতা বলে মেনে নেন। কর্মীদের আরো বেশি উৎসাহিত করেন, আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে তোলেন, এবং পরবর্তী পদক্ষেপে সাফল্য নিয়ে আসেন।