প্রতি দুই তিন জন মানুষের মধ্যে একজন করে অন্তর্মুখী মানুষ খুঁজে পাওয়া যায়। এই অন্তর্মুখী মানুষেরা তুষার স্তুপের মতো চুপচাপ থাকে। তারা কখনোই অন্যদের বিরক্ত করে না বা উদ্দীপ্ত করে কর্মক্ষেত্রে টেনে আনে না। তারা কাউকে সহায়তা করতেও চাই না, সহায়তা নিতেও চায় না। আপনি যদি কোনো অন্তর্মুখী মানুষের সাথে কাজ করে থাকেন তবে নিশ্চয়ই জানেন কী হিমশীতল বরফ জলে আপনি নিমজ্জিত হয়ে আছেন! অন্তর্মুখী মানুষের সাথে কাজ করার অর্থ হলো, আপনি খুব নিরব এবং গভীর স্থানে কিছু খুঁজতে চলেছেন। মনে রাখবেন, অন্তর্মুখীরা সাধারণ মানুষের চেয়ে ৭৫ শতাংশ বেশি বুদ্ধিমান হয়ে থাকে।
কিন্তু কেন অন্তর্মুখীরা এত বুদ্ধিমান এবং কৌশলী হয়? কেন তারা কর্মক্ষেত্রে এতটা এগিয়ে থাকে? এই নিবন্ধে এমন পাঁচটি বিষয় নিয়ে আলোচনা করব, যা অন্তর্মুখীরা কখনোই করেন না, আর এই বিশেষ বৈশিষ্ট্যগুলি অন্তর্মুখীদের সাফল্যের চূড়ায় পৌঁছে দেয়।
১. তারা ভাবনা চিন্তা না করে কিছু বলেন না
বহির্মুখী বা বাঁচাল স্বভাবের মানুষ কথা বলার সময় প্রায়ই আপনাকে থামিয়ে দিবে এবং নিজের কথা বলতে শুরু করবে। কেননা আপনার কথা ধৈর্য সহকারে শুনে তার কথা বলার সময় আসা পর্যন্ত তারা অপেক্ষা করতে চায় না। আপনার সম্পূর্ণ কথা শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা না করেই বেশিরভাগ মানুষ যেখানে নিজের কথা বলতে শুরু করে, অন্তর্মুখী মানুষ সেখানে অন্যের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনে তারপর কিছু বলার চেষ্টা করে, এবং বলার পূর্বে তারা ভেবে নেয় কী বলবে। আপনি কথা বলার সময় মস্তিষ্কের মধ্যে সে নিজের কথা প্রস্তুত করে।
নাগরিক অধিকার সংক্রান্ত সেবাদানকারী একটি মার্কিন প্রতিষ্ঠানের ভাইস প্রেসিডেন্ট জো ম্যাকহুগ বলেন, সহকর্মী এবং বসদের বুঝতে হবে যে অন্তর্মুখীরা তাৎক্ষণিকভাবে চিন্তা করতে পারে না। যেকোনো বিষয়ের মতামত দিতে তাদের কিছুটা ভাবতে হয়।
যদিও এ কারণে তারা কিছুটা সমালোচিত, কিন্তু তারা কোনো কিছু জানার পর চিন্তা করতে এবং মতামত দিতে কিছুটা সময় নিয়ে থাকে।
২. অবিরাম ছোট ছোট আলাপে নিরুৎসাহী
আপনি কোথাও চাকরি করলে নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেছেন কর্মীরা দিনভর ছোট ছোট বিষয় নিয়ে খোশগল্পে মেতে থাকে। অন্তর্মুখী মানুষ এই প্রবণতা একদম পছন্দ করে না।বিশেষ করে বহির্মুখী মানুষের সংস্পর্শে এলে অন্তর্মুখীদের এই বৈশিষ্ট্য স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
কর্মক্ষেত্রে এই খোশগল্পের প্রবণতা অন্তর্মুখীদের স্বকীয়তা নষ্ট করে। বহির্মুখীদের এই সক্রিয় মিথস্ক্রিয়া অন্তর্মুখীদের ক্লান্ত বা বিষণ্ণ করে তোলে। অন্তর্মুখীরা ছোট ছোট বিষয়ে খোশগল্পের চেয়ে গভীর বিষয়ে কথা বলতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। কারো সাথে গল্প করে সময় কাটানোর সময় তারা দর্শন, রাজনীতি বা এজাতীয় খুব গভীর বিষয় নিয়ে কথা বলতে পছন্দ করে।
অন্তর্মুখী মানুষদের নিয়ে কাজ করা লেখিকা সোফিয়া ডেম্বলিং বলেন, এই প্রবণতা নির্ভর করে একজন মানুষ তার চারপাশের পরিবেশকে কিভাবে গ্রহণ করে বা বর্জন করে তার ওপর।
৩. অন্যের মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করেন না
জনপ্রিয়তার প্রতিযোগিতা অন্তর্মুখীদের বিষয় নয়। তারা সবসময় নিজেদের কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকে এবং সত্যিই অন্যের মনোযোগ আকর্ষণ করার কোনো চেষ্টা করে না; আরো স্পষ্ট করে বললে পছন্দই করে না।
পক্ষান্তরে বহির্মুখীরা সম্পূর্ণ বিপরীত। তারা তীব্রভাবে অন্যের মনোযোগ আকর্ষণ করার চেষ্টা করে, বিভিন্ন কাজের স্বীকৃতি, পুরস্কার অর্জন করতে মরিয়া হয়ে ছুটতে থাকে। কথা এবং কাজের মধ্য দিয়ে অন্যের কাছে নিজেকে বিখ্যাত করে তুলতে চায়। নিজের উদ্যম এবং দৃঢ়তা বাইরের মানুষের কাছে প্রচার করে নিজের অবস্থান তৈরি করতে চায়। কিন্তু অন্তর্মুখীদের মধ্যে এরকম কোনো প্রবণতা লক্ষ্য করা যায় না।
আরেকটি মজার তথ্য হলো, রাজনৈতিক নেতৃস্থানীয় ভূমিকার জন্য অন্তর্মুখীদের প্রায়ই উপেক্ষা করা হয়, কিন্তু কোনো ভাবে তারা যদি নির্বাচিত হয়, তবে তারাই সবচেয়ে চিন্তাশীল এবং বিচক্ষণ নেতা হয়ে থাকেন।
৪. নিজেদের ডেস্কে বসে থেকে পৃথিবীকে অভিশাপ দেন না
অন্তর্মুখীরা একা থাকতে পছন্দ করে, নিজের মতো জীবন যাপন করতে ভালবাসে, তারা ছোটখাটো বিষয়ে খোশগল্প পছন্দ করে না, তারা কখনোই অকারণে নিজেকে প্রকাশ করতে চায় না। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে, তারা অপরিচ্ছন্ন, অসামাজিক এবং সেকেলে।
বাইরে থেকে মনে হতে পারে তারা সবসময়ই নিজের ডেস্কে বসে থেকে বাইরের পৃথিবীকে অভিশাপ দেয় এবং আলো-ঝলমলে পৃথিবীর স্বাভাবিক মেলামেশা থেকে বঞ্চিত হয়। কিন্তু না। তারা কখনই বোকার মতো নিজের ডেস্কে বসে থাকে না। তারা শান্তভাবে নতুন নতুন বিষয় নিয়ে চিন্তা করে এবং ব্যক্তি ও কর্মজীবনে সাফল্যের রূপরেখা অঙ্কন করে।
দক্ষ শিল্পীর মতো তারা কাজের পরিকল্পনা করে, নতুন নতুন প্রকল্প সৃষ্টি করে, এবং বিশাল কর্পোরেশনের নেতৃত্ব দিয়ে থাকে। আপনার সাথে অন্তর্মুখী কোনো মানুষ ততদিন পর্যন্ত মিশতে রাজি থাকবে যতদিন আপনি তাকে বহির্মুখীদের মতো বাচাল করে তুলবেন না বা শোরগোলের মধ্যে টেনে আনবেন না, অর্থাৎ কোনোক্রমেই একজন অন্তর্মুখী মানুষকে তার স্বকীয় অবস্থান থেকে সরানো যায় না।
৫. তাদের নেতৃত্বে থাকা মানুষদের নিরবে প্রশংসা করেন
অন্তর্মুখীরা নেতৃত্ব দিয়ে সফল হয়। কারণ তারা খুব ভালো শ্রোতা হয়ে থাকে। এমনকি তারা অধস্তনদের থেকে পরামর্শ নিতে পছন্দ করে। অন্তর্মুখীদের এই বৈশিষ্ট্য তাদের দক্ষ নেতা বানিয়ে তোলে। মনোযোগ সহকারে অন্যের বক্তব্য শোনা এবং প্রশংসার মাধ্যমে তা গ্রহণ করার এই বিশেষ গুন তাদের কর্মক্ষেত্রে সমঞ্জস্যপূর্ণ বিধান জারি রাখতে সহায়তা করে।
অন্তর্মুখী সিইওরা দক্ষতার সাথে নিজেদের কাজ পরিচালনা করে এবং কর্মীদের নিরবে প্রশংসা করে। তারা ব্যক্তিগতভাবে ধন্যবাদ জানানো বেশি ফলদায়ক মনে করে। এই বিশেষ গুণ বহির্মুখী বসদের মধ্যে কখনোই থাকে না। অন্তর্মুখীদের এই বিশেষ গুণের কারণে কর্মীদের সাথে তাদের বিশেষ ব্যক্তিগত বন্ধুত্বের সম্পর্ক তৈরি হয়, যা কর্মক্ষেত্রে তাকে আরো বেশি সফল করে তোলে।