আপনি যদি ইন্টারনেটে বিশ্বাসের ইংরেজি প্রতিশব্দ ‘Trust’ লিখে সার্চ করেন নিশ্চয়ই অসংখ্য রেজাল্ট পাবেন। কিন্তু সবচেয়ে অবাক করা ব্যাপার হলো, প্রাথমিকভাবে যে লিঙ্ক বা ইন্টারনেট ঠিকানাগুলো পাবেন তার বেশিরভাগই অর্থনৈতিক নিরাপত্তা সম্পর্কিত। বিভিন্ন কোম্পানি, ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠান নানাভাবে আপনার অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ট্রাস্ট খুলে বসেছেন। আপনি অর্থনৈতিক এবং ব্যবসা সম্পর্কিত পরামর্শ নিয়ে অনেক ট্রাস্টের সন্ধান পাবেন। কিন্তু আশ্চর্য হলেও সত্য, সাধারণ অর্থে Trust বা বিশ্বাস বলতে যা বোঝায় সে সম্পর্কে খুব বেশি পরামর্শ পাবেন না!
বিশ্বাস বলতে সাধারণ অর্থে কোনো বিষয়, কোনো ব্যক্তি বা কোনো মতাদর্শের উপর বিশ্বাস স্থাপন করা বোঝায়। হয়তো কদাচিৎ ধর্মবিশ্বাস নিয়ে কিছু ওয়েবসাইট পেতে পারে। কিন্তু সার্বিকভাবে বিশ্বাস নিয়ে খুব বেশি কাজ আপনার চোখে পড়বে না।
তাই আমি অনেকটা হতাশ হয়েই এই নিবন্ধ লিখতে শুরু করেছি। বিশ্বাস বলতে শুধুমাত্র অর্থনৈতিক নিরাপত্তা বা ধর্মবিশ্বাস বোঝায় না। বিশ্বাস একটি বিস্তৃত ব্যাপার, যা আমাদের ব্যক্তি এবং কর্মজীবন গভীরভাবে নিয়ন্ত্রণ করে। বিশ্বাসের কারণে জীবনে সাফল্য আসে। আবার বিশ্বাসহীনতা বিপর্যয় ডেকে আনে। আমি এই নিবন্ধে বিশ্বাসকে নানা আঙ্গিক থেকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করবো।
ব্যক্তিজীবনে বিশ্বাসের গুরুত্ব
বিশ্বাস জীবনের অপরিহার্য অনুষঙ্গ। আপনি যদি কোনো কিছুতেই বিশ্বাস স্থাপন করতে না পারেন তবে আপনার জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠবে। মস্তিষ্ক বিকৃতি এবং বিকারগ্রস্ততা জেঁকে বসবে। আপনার জীবন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হবে।
বিশ্বাস ছাড়া আপনি কোনো মানুষের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করতে এবং রক্ষা করতে পারবেন না। আপনার চারপাশে অনেক দম্পতির সংসার ভাঙতে দেখবেন শুধু বিশ্বাসের অভাবে। যে দম্পতি পরস্পরকে বিশ্বাস করতে পারে না, তাদের মধ্যে পরস্পরকে সন্দেহ করা এবং বিশ্বাসঘাতকতার প্রবণতা ক্রমশ বৃদ্ধি পায়। একসময় তাদের সম্পর্ক শেষ হয়ে যায়!
আপনি একা থাকতে চান? তার জন্যও বিশ্বাসের প্রয়োজন আছে। আপনি যদি ঈশ্বর বিশ্বাসহীনতায় ভোগেন, তবে জীবনের কোনো অর্থ খুঁজে পাবেন না। আপনার জীবন গন্তব্যহীন হয়ে পড়বে।
কর্মক্ষেত্রে বিশ্বাসের প্রয়োজনীয়তা
কর্মক্ষেত্রেও বিশ্বাস অপরিহার্য। কোনো প্রতিষ্ঠান বিশ্বাস ছাড়া এগোতে পারে না। বিশ্বাসহীনতা প্রতিষ্ঠানকে পিছিয়ে দেয়। ব্যর্থ হওয়ার ভয় এবং নতুন প্রকল্প গ্রহণের দ্বিধা চূড়ান্তভাবে প্রতিষ্ঠানকে ব্যর্থতায় পর্যবসিত করে।
আপনি যদি বিশ্বাস স্থাপন না করেই কোনো বসের সাথে কর্মী পরিচালনার কাজ করেন তবে সেই কাজে আপনি সম্পূর্ণ মনোযোগ দিতে পারবেন না, সবকিছুতেই একটা অবজ্ঞার ভাব স্পষ্ট হয়ে উঠবে। সঙ্গত কারণে বস আপনার উপর নজরদারি শুরু করবে এবং নানা ছোটখাটো ভুল খুঁজে বের করবে। বাস্তবে আপনি এই ভুলগুলো করেছেন। কেননা এই বস এবং কাজের প্রতি আপনার সম্পূর্ণ বিশ্বাস ছিল না।
যে সহকর্মীরা পরস্পরকে বিশ্বাস করেন না তারা সব সময় অন্যের দোষ খোঁজা নিয়ে ব্যস্ত থাকে। পরস্পরকে উৎসাহ দেওয়া এবং সফলভাবে কাজ করার পরিবর্তে তারা নেতিবাচক ধ্যান ধারণা নিয়ে বসবাস করে। এমনকি কাজের সময় তারা একে অন্যের ভুল ধরতে এবং অপমান করতে ব্যস্ত থাকে। তাতে স্বভাবতই কর্মক্ষেত্রের রাজনীতি বৃদ্ধি পায়।
বড় কোম্পানির বাড়তি খরচ
বড় বড় কোম্পানি সবসময়ই কর্মক্ষেত্র পরিচালনা এবং উৎপাদন ব্যয় কমানোর চেষ্টা করে। এই কারণে তারা খুঁজে খুঁজে অতিরিক্ত খরচের ক্ষেত্র সংকুচিত করে। বিশাল বিশাল কোম্পানিতে অডিট তথা নিরীক্ষণ বিভাগ থাকে শুধুমাত্র বিশ্বাসের অভাবে। কোম্পানিগুলো তাদের কর্মীদের উপর তীক্ষ্ণ নজর রাখে। কেননা কোম্পানি তার সব কর্মীকে সমানভাবে বিশ্বাস করে না। এমনকি কোম্পানি তাদের গ্রাহক এবং ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান উপরেও নজর রাখে।
বস্তুত এই নজরদারি খাতে কোম্পানি এবং রাষ্ট্রের বিরাট অংকের অর্থ লগ্নি করতে হয় শুধুমাত্র বিশ্বাসের অভাবে। আমাদের সমাজে একটা কথা প্রচলিত হয়েছে যে, বর্তমান সময়ে আপনি কাউকে বিশ্বাস করতে পারেন না। একবার চিন্তা করে দেখুন, যদি শুধুমাত্র পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা যেত তাহলে রাষ্ট্র এবং বিভিন্ন কোম্পানি পরিচালনায় কত বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার খরচ কমে যেত! মানুষের জীবন কত সহজ হতো।
উৎপাদনশীল প্রধান কাজ বাদ রেখে আমরা প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় এই বিশেষ নজরদারী কাজের দিকে অধিক মনোযোগ দিয়ে থাকি এবং অর্থ ব্যয় করে থাকি। কেননা আমরা পরস্পরকে বিশ্বাস করি না।
চিন্তা করে দেখুন, আমাদের যদি সার্বক্ষণিকভাবে বিশ্বাসের অভাবে অন্যদের উপর নজরদারি করতে হয় তাহলে দিনের কি পরিমাণ সময় এবং অর্থ এর পিছনে ব্যয় করতে হয়? তাছাড়া সব সময় একটা বাড়তি চাপ সহ্য করতে হয়।
বিশেষ পরামর্শ
দৈনন্দিন জীবনে অতিরিক্ত চাপ সহ্য করা মানুষদের প্রতি আমার একটি পরামর্শ হলো, অন্যকে বিশ্বাস করতে শিখুন। শুধু বিশ্বাসের অভাবে বিভিন্ন ক্ষেত্রে নেতারা অতিরঞ্জিত কাজ করেন। তারা নিজেরা সাধারণ কর্মীদের মতো কাজ করেন না, অথচ সার্বক্ষণিক চাপ অনুভব করেন। প্রত্যেকটি সভায় উপস্থিত হন, তদারকি করেন এবং সবসময় কর্মীদের পিছে লেগে থাকেন।
দাপ্তরিক যোগাযোগ করতে আমাদের একই ইমেইলের কপি অসংখ্য লোককে পাঠাতে হয়। কেননা আমাদের পরস্পরের মধ্যে বিশ্বাস নেই। প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করতে গিয়ে আমরা নানা গোপন কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকি; ব্যবসায়িক প্রতিদ্বন্দ্বী এবং নিজের প্রতিষ্ঠানের নানা বিভাগের ওপর বিশেষ নজরদারি করি এবং সবসময় একটা বাড়তি উত্তেজনা অনুভব করি। আসলে এই বাড়তি নজরদারি এবং চাপ প্রতিষ্ঠানের প্রকৃত কাজ নয় অথচ এই কাজেই আমাদের বেশি দুশ্চিন্তা করতে হয়! আর এই বাড়তি চাপ আমাদের অসুস্থ প্রতিযোগিতার দিকে ধাবিত করে।
কিভাবে এই অবিশ্বাসের চক্র থেকে বের হওয়া যায়?
কেউ একজনকে বিশ্বাস করার প্রবণতা সৃষ্টির জন্য কাজ শুরু করতে হবে। কোনো একটি কাজ বা পদক্ষেপের মাধ্যমে বিশ্বাস স্থাপন শুরু করতে হবে। অন্য কারো জন্য অপেক্ষা করার প্রয়োজন নেই। কেননা অন্য সবাই শুরু করার অপেক্ষায় আছে। একজন ব্যক্তির ভালো গুণ, দক্ষতা, সততা, প্রতিশ্রুতি বিশ্বাস করার মধ্য দিয়ে আপনাকেই এই বিশ্বাসের চক্র সৃষ্টি করতে হবে।
প্রশ্ন হল অন্যরা কি আপনার বিশ্বাসের মর্যাদা রাখবে? আপনার মনে এই সন্দেহজনক প্রশ্ন থাকার অর্থ আপনি এখনো সত্যিকারের বিশ্বাস স্থাপন করতে পারেননি! মনে রাখা দরকার, জীবন অনিশ্চিত। পরবর্তী দিন আমরা বেঁচে থাকব কিনা সেই নিশ্চয়তা যেখানে নেই সেখানে নিঃশর্তভাবে অন্যকে বিশ্বাস করতে আপত্তি কোথায়? জীবন কখনো পরিপূর্ণ না, আর সব মানুষ সৎ না। কিন্তু জীবনের ভারসাম্য রক্ষা করে ইতিবাচক থাকতে আপনাকে বিশ্বাস স্থাপন করতেই হবে। তাছাড়া আপনার বিশ্বাস অন্য কোনো অসৎ মানুষের মনে সততার জন্ম দিতে পারে।
সুতরাং জীবনের প্রয়োজনে আজ থেকেই বিশ্বাস স্থাপন শুরু করুন, আর জীবনকে সহজ স্বাচ্ছন্দ্যময় করে তুলুন।