সকাল ছয়টা। ঘুম উঠে থেকে সোজা চলে গেলেন বেসিনে। দাঁত ব্রাশ শেষে কোনো রকমে একটি স্যান্ডউইচ খেয়ে নিলেন। এরপর জিন্স প্যান্ট পায়ে গলিয়ে, ব্যাগ কাঁধে রওনা হলেন কর্মক্ষেত্রের উদ্দেশ্যে। স্যান্ডউইচ, টুথব্রাশ, টুথপেস্ট আর জিন্স এসব আমাদের নিত্যদিনের সঙ্গী। তবে সেগুলোর আবিস্কার কিভাবে হয়েছিলো সেসম্পর্কে আমরা কতটুকুই বা জানি? নিত্যদিনের তেমন প্রয়োজনীয় জিনিসগুলোর আবিস্কারের ঘটনা নিয়েই আমাদের আজকের আয়োজন।
১. সুপারগ্লু
১৯৪০ সালে যখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছিলো তখন ইস্টমান কোডাক কোম্পানির সাথে হ্যারি কুভার নামের এক রসায়নবিদ গবেষণা করছিলেন। টেকসই গান সাইট তৈরির জন্য তিনি তার টিম নিয়ে সায়ানোএক্রেলিটসের উপর গবেষণা শুরু করেন। সায়ানোএক্রেলিটসের উপর গবেষণা করে দেখেন এই রাসায়নিক পদার্থ প্রবলভাবে যেকোনো বস্তুর উপর লেগে থাকে। যার কারণে একে কাজে লাগানো অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। পরবর্তীতে জেট ইঞ্জিনের কেনোপিতে হিট রেজিস্টেন্স হিসাবে ব্যবহারের চেষ্টা করেন। সেখানেও একই সমস্যা।
যেখানে সায়ানোএক্রেলিটস লাগানো হয় সেখানে স্থায়ীভাবে এই পদার্থ লেগে থাকে। এরপর কুভারের মাথায় আসে যে কারণে সায়ানোএক্রেলিটস তিনি কাজে লাগাতে পারছেন না সেই জিনিসটিই অনেক কাজে আসতে পারে। পরবর্তীতে তিনি এর উৎপাদন শুরু করেন আর বাজারে সুপার গ্লু হিসাবে বিক্রি শুরু করেন। বছরখানেক পর ভিয়েতনাম যুদ্ধে ফিল্ড মেডিক যুদ্ধাহতের ক্ষত বন্ধের কাজে এর ব্যবহার করে অসংখ্য মানুষের জীবন বাঁচাতে সক্ষম হন। বর্তমানে তৈরি মেডিক্যাল গ্রেড সুপারগ্লু বিভিন্ন অপারেশনে ডাক্তাররা ব্যবহার করে থাকেন।
২. স্যান্ডউইচ
দু’ফালি পাউরুটির মধ্যে সবজি, টমেটো, মাখন আর মাংস দিয়েই সাধারণত স্যান্ডউইচ তৈরি করা হয়। স্যান্ডউইচের প্রথম ব্যবহার এবং আবিষ্কার জন মন্টেগুর হাত ধরে ১৭৬২ সালে শুরু হয়। জন মন্টেগু ছিলেন একজন পেশাদার জুয়াড়ি। তিনি জুয়াতে এতটাই আসক্ত ছিলেন যে, কোনো কোনো সময় টানা চব্বিশ ঘন্টার বেশি সময় তিনি জুয়ায় পার করতেন। জুয়ার সময় খাওয়া নিয়ে সমস্যা সৃষ্টি হওয়ার কারণে তিনি সেখানকার রাঁধুনিকে শুধু স্টেকের পরিবর্তে পাউরুটির মাঝে মাংস দিয়ে খাবার পরিবেশনের কথা বলেন। যাতে একহাতে খাবার খাওয়ার পাশাপাশি তিনি জুয়ায় মনোনিবেশ করতে পারেন।
জন মন্টেগু ছিলেন মার্কুইসের নিম্ন সম্ভ্রান্ত স্যান্ডউইচ বংশের চতুর্থ পরিবার প্রধান। তবে তার নামের জন্যই স্যান্ডউইচ নামকরণ করা হয়েছে এরকম নিশ্চিত দলিল পাওয়া যায়নি। বর্তমানের ৫০ ভাগের বেশি আমেরিকান এবং সারাবিশ্বে ২০ ভাগ মানুষ প্রতিদিনের খাবার হিসাবে স্যান্ডউইচ গ্রহণ করেন।
৩. নারীদের অন্তর্বাস
অন্তর্বাস আবিষ্কারের পূর্বে নারীরা তাদের বুকের গঠন ঠিক রাখতে বিভিন্ন পদ্ধতি ব্যবহার করতো। তবে অন্তর্বাসের সর্বপ্রথম ব্যবহার ঘটে মিনোনান সভ্যতার নারী ক্রিড়াবিদদের হাত ধরে চতুর্দশ শতাব্দীর মাধামাঝি সময়ে। তবে সেসময়কার পশ্চিম বিশ্বের ধনী মহিলাদের মধ্যে কর্সেটের প্রচলন বেশি থাকায় এর জনপ্রিয়তা পাওয়া ছিলো অসম্ভব। পরবর্তীতে ঊনবিংশ শতকে কর্সেটের বিকল্প হিসাবে অন্তর্বাস ব্যবহার করা শুরু হয়। যার নামকরণ এসেছিলো ব্রেস্ট সাপোর্টের সংক্ষিপ্ত রূপ হতে।
বিংশ শতাব্দীতে মহিলাদের অন্তর্বাসে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটলেও অন্তর্বাসের বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু হয় ১৯৩০ সালের পর হতে। পরবর্তীতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে ধাতুর স্বল্পতা যখন শুরু হয় তখন কর্সেটের উৎপাদন পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। এর প্রধান কারণ ছিলো কর্সেট তৈরিতে ধাতুর ব্যবহার। এছাড়া তখনকার ইউএস ইন্ডাস্ট্রিয়াল বোর্ড তাদের এক রিপোর্টে দেখিয়েছিলো, প্রতিবছর ২৮ হাজার টন ধাতু কর্সেট উৎপাদনে ব্যয় হয়। যে পরিমাণ ধাতু দিয়ে দুইটি যুদ্ধ জাহাজ তৈরি সম্ভব।
যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর কর্সেট আর তার পুরাতন মার্কেট ধরতে পারেনি। কেননা ততদিনে ইউরোপ এবং আমেরিকান অধিকাংশ রুচিশীল মহিলাদের কাছে অন্তর্বাসের ব্যবহার স্বাভাবিক হয়ে উঠেছিলো। পরবর্তীতে সেখান থেকে অন্তর্বাসের ব্যবহার এশিয়া, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকায় শুরু হয়।
৪. জিন্স প্যান্ট
আমাদের নিত্যপ্রয়োজনীয় পোশাকের মধ্যে জিন্সের প্যান্ট বিশেষ জায়গা করে নিয়েছে। বর্তমানে বিশ্বের প্রায় ৯২ শতাংশ মানুষ জিন্স প্যান্ট পরিধান করে থাকেন। জিন্সের প্রথম উৎপাদন হয় জেকভ ডব্লিউ. ডেভিস এবং তার পার্টনার লিভাই স্ট্রসের হাত ধরে ১৮৭১ সালে। গোল্ডরাশের সময় ছিলো তখন। আর নব্য টেইলারিং ব্যবসায় আসা জেকভ খেয়াল করলেন খনির শ্রমিকদের ব্যবহৃত প্যান্ট খুব দ্রুতই নষ্ট হয়ে যায়। অনেক চিন্তাভাবনা করে তিনি তার তৈরি প্যান্টে শক্ত মোটা কাপড় ব্যবহার করলেন আর জোড়া লাগালেন মেটাল রিভিট ব্যবহার করে। যেটা প্যান্টকে আরো টেকশই করে তুললো। তার তৈরি এ প্যান্ট খুব দ্রুতই মার্কেটে জনপ্রিয়তা অর্জন করে।
এরপর চাহিদার তুলনার সাপ্লাই কম হওয়াতে ডেভিস যোগাযোগ করেন লিভাইয়ের সাথে। যে কিনা ডেভিসের কাপড়ের ডিলার ছিলেন। লিভাই আর ডেভিস মিলে তাদের তৈরি জিন্সের ডিজাইন আরো উন্নত করেন যার নাম দেওয়া হয় ডেনিম। পরবর্তীতে মেটাল রিভিটের বিভিন্ন সমস্যার কারণে এর পরিবর্তে সুতার সেলাইয়ের ব্যবহার শুরু করেন। তাদের তৈরি ব্লু জিন্স এতটাই জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলো বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি তাদের কোম্পানী জিন্স হতে প্রতিবছর ৯১ বিলিয়ন ডলার আয় করতো।
৫. স্টেথোস্কোপ
১৮১৬ সালে রেনেন লেনেক নামের ৩৫ বছর বয়সী একজন ডাক্তার প্যারিসের রাস্তা দিয়া হাঁটছিলেন। হাঁটার সময় তিনি দেখলেন দুইটি বাচ্চা বড় সাইজের কাঠের টুকরো দিয়ে একে অপরকে সিগনাল পাঠাচ্ছে। একজন কানে কাঠের টুকরোটি ধরে রাখছে আর অন্যপ্রান্তে দ্বিতীয়জন ঘসে শব্দ তৈরি করছে, যা কাঠের টুকরোর ভিতরে এমপ্লিফাই হয়ে অপর প্রান্তে পৌঁছে যাচ্ছে।
সেই ঘটনার কিছুদিন পার হওয়ার পর চিকিৎসার জন্য ক্রুটিপূর্ণ হৃদপিন্ডের একজন মহিলা লেনেকের কাছে আসেন। যাকে বাহির থেকে দেখে সুস্থই মনে হচ্ছিলো। তাই সরাসরি তার বুকে কান লাগিয়ে পরীক্ষা করার ব্যাপারে তিনি অস্বস্তি অনুভব করছিলেন। হঠাৎ তার মনে পড়লো বাচ্চাদের খেলার কথা। তৎক্ষণাৎ তিনি কাগজের একটি রোল তৈরি করলেন আর মহিলার হৃদপিন্ডে চেপে ধরতে বললেন আর স্পষ্ট শুনলেন হৃদপিন্ডের শব্দ। পরবর্তী তিনবছর লেনেক বিভিন্ন যন্ত্রপাতির উপর পরীক্ষা চালান। এরপর ধাতু আর ফাঁপা কাঠ দিয়ে প্রথম স্টেথোস্কোপ তৈরি করেন। আস্তে আস্তে তার তৈরি করা স্টেথোস্কোপ পরিবর্তন হয়ে বর্তমানের ধাতু, প্লাস্টিক আর রবারের তৈরি স্টেথোস্কোপে এসে পৌঁছেছে।