চলচ্চিত্রের অজানা দিক এবং আমাদের কিছু ভ্রান্ত ধারণা

শিরোনাম দেখে অনেক পাঠকই দ্বিধায় পড়ে যেতে পারেন যে, এই লেখাটি হয়তো তার জন্য নয়। নিশ্চয়ই ভাবছেন, চলচ্চিত্রের পাঠ তো তাদের জন্যেই প্রযোজ্য যারা চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে চান কিংবা চলচ্চিত্র নিয়ে কাজ করতে আগ্রহী। বিষয়টি আসলে তেমন নয়। আমাদের মধ্যে খুব কম মানুষই আছেন যারা সিনেমা দেখতে পছন্দ করেন না। অনেকেই দৈনিক একটি বা একাধিক সিনেমা দেখে থাকেন।  সিনেমা ‘দেখা’র এই চোখকে আরো তীক্ষ্ন, আরো প্রখর করতেই আমাদের আজকের এই আয়োজন।

{ "slotId": "2452885053", "unitType": "in-article" }

সিনেমা শুধু দেখার বিষয় নয়, এটি অনুধাবনের বিষয়, উপলব্ধির বিষয়। চলচ্চিত্রের সাথে আপনার বোঝাপড়া যত গাঢ় হবে আপনি তাকে তত গভীরভাবে বিশ্লেষণ করতে পারবেন। ব্যাপারটা অনেকটা আমাদের ব্যক্তিজীবনের সম্পর্কের মতো। একজন মানুষকে আপনি যত বেশি জানবেন তত ভালোভাবে তাকে বুঝতে পারবেন আর তারপরেই আপনার মন সিদ্ধান্ত নিবে যে মানুষটাকে আপনি পছন্দ করবেন নাকি অপছন্দ করবেন। অনেক সময় দেখা যায়, প্রথম দেখায় একজন মানুষকে আমাদের খারাপ লাগে। কিন্তু ধীরে ধীরে তার সম্পর্কে জানার পর, তাকে বুঝার পর তার ব্যাপারে আমাদের আগের ধারণা পাল্টে যায়। সিনেমা ব্যাপারটিও তাই।

একটা চলচ্চিত্রে স্বাভাবিকভাবে আমরা যা দেখি তার ভিতরে এমন অসংখ্য অনুষঙ্গ থাকে যা হয়তো আমাদের নজর এড়িয়ে যায় কিংবা আমরা পুরোপুরি অনুধাবন করতে পারি না। এই বুঝতে না পারা বিষয়গুলোই কিন্তু একটা চলচ্চিত্রের মূল অলংকার, এই বিষয়গুলোই চলচ্চিত্রটির চিত্রভাষা এবং দর্শনের গভীরতা নির্ধারণ করে দেয়। তাই যে কোনো চলচ্চিত্রকে যথাযথ ভাবে বুঝার জন্য আমাদেরকে সবার আগে ‘চলচ্চিত্র’ ব্যাপারটিকে বুঝতে হবে। চলচ্চিত্র কী, এর ইতিহাস, কিভাবে একটা চলচ্চিত্র তৈরি হয়, চিত্রনাট্য, চিত্রভাষা, নন্দনতত্ব, অভিনয়, চিত্রগ্রহণ, রঙ এর ব্যবহার, লাইটিং, সম্পাদনা ইত্যাদি বিষয়গুলো সম্পর্কে ধারণা থাকতে হবে। তাহলেই কোনো চলচ্চিত্রের সাথে বোঝাপড়াটা যথার্থ হওয়া সম্ভব।

এই লেখায় একটা বড় ভূমিকা প্রয়োজন ছিল কেননা এটি আর পাঁচটা সাধারণ বিষয়ে লেখা নয় যা পড়ার জন্য যে কেউ আগ্রহী হবে। তবে এই লেখার মূল উদ্দেশ্য – চলচ্চিত্রের সকল সাধারণ দর্শককে চলচ্চিত্র বিষয়টির উপর একটা সম্যক ধারণা দেয়া যাতে যে কোনো চলচ্চিত্রকে অনুধাবনে তারা আরও পারদর্শী হয়ে ওঠেন এবং একই সাথে যারা চলচ্চিত্র নির্মাণে আগ্রহী তারাও এ লেখাটির মাধ্যমে উপকৃত হবেন।

{ "slotId": "", "unitType": "in-article", "pubId": "pub-6767816662210766" }

আরও একটি বিষয় শুরুতেই বলে নেয়া ভাল, পুরো লেখাতে অনেক বিদেশি ভাষা এবং টেকনিক্যাল টার্ম ব্যবহার করা হবে। চলচ্চিত্র যেহেতু একটি বৈশ্বিক বিষয় তাই এর ব্যবহার্য টেকনিক্যাল শব্দগুলো বৈদেশিক ভাষাতেই ব্যবহার করা হয়। অধিকাংশ শব্দেরই বাংলা অনুবাদ হয় না। যে সকল শব্দের বাংলা অনুবাদ হয়েছে সেগুলোও ভীষণ কর্ণপীড়াদায়ক এবং দুর্বোধ্য।

এই লেখাটির বিষয়বস্তু যেহেতু অনেক বিস্তৃত তাই একটি বা দুইটি ভাগে পুর্নাঙ্গ লেখা প্রকাশ করা সম্ভব হবে না। চলচ্চিত্রের একেকটি বিষয়ের উপর একেকটি লেখা পর্যায়ক্রমে প্রকাশ করা হবে। প্রতিটি লেখার সাথে (প্রযোজ্য ক্ষেত্রে) তার পূর্ববর্তী এবং পরবর্তী সকল লেখার লিংক সংযুক্ত করে দেয়া হবে।

আমাদের আজকের আলোচনার বিষয়বস্তু – ‘চলচ্চিত্র কী?’। তাহলে আসুন ডুব দেয়া যাক চলচ্চিত্রের মহাসমুদ্রে।

চলচ্চিত্র কী?

একেবারে সহজ কথায় চলচ্চিত্র হলো, কোনও বাস্তব ঘটনার ভিজুয়াল রিপ্রেজেন্টেশন। অর্থাৎ বাস্তবে ঘটে যাওয়া যে কোনো ঘটনা কিংবা বাস্তবের মতো করে সাজিয়ে অভিনয়ের সাহায্যে ফুটিয়ে তোলা কোনো ঘটনা ক্যামেরার মাধ্যমে দৃশ্য ধারণ করলে তাকে চলচ্চিত্র বলা যাবে।

চলচ্চিত্র শব্দটির ইংরেজি প্রতিশব্দ হল Film। এই Film কথাটি এসেছে Film Strip থেকে। প্রথম চলচ্চিত্র উদ্ভাবনের পর থেকেই চলচ্চিত্র ধারণ করা হতো এনালগ ফিল্ম স্ট্রিপে। সেই থেকেই এই ভিজুয়াল আর্ট ফর্মটির নামকরণ হয়। কালক্রমে ফিল্ম শব্দটির আরও অনেক প্রতিশব্দ তৈরি হয়েছে , যেমন- মুভি, টকি, সিনেমা ইত্যাদি। এই প্রতিটি নামকরণের পিছনে আলাদা প্রেক্ষাপট রয়েছে যা আমরা ‘চলচ্চিত্রের ইতিহাস’ টপিক এ আলোচনা করবো।

বাংলা  ‘চলচ্চিত্র’ শব্দটি মূলত ইংরেজি ‘মুভি’ শব্দ থেকে অনুদিত। এই শব্দটির একটি মাজেজা রয়েছে। চলচ্চিত্রে আমরা যা দেখি তা আসলে অসংখ্য স্টিল ইমেজ ছাড়া আর কিছুই নয়। মূলত প্রতি সেকেন্ডে ২৪ টি স্টিল ছবি বা ফ্রেম পর পর পর্দায় চলতে থাকে। মানুষের চোখের একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য রয়েছে। আমরা যা দেখি তার রেশ সেকেন্ডের ভগ্নাংশ সময় পর্যন্ত আমাদের চোখে থেকে যায়। মানব চোখের এই বৈশিষ্ট্যের কারণেই প্রতি সেকেন্ডে ২৪ ফ্রেম গতিতে যখন ছবি চালানো হয় তখন আমরা ২৪ টা আলাদা ছবি না দেখে চলমান চিত্র দেখতে পাই। আর এ কারণেই একে চলচ্চিত্র বলা হয়।

এরকম পরষ্পর সম্পর্কযুক্ত কতগুলো ফ্রেম যখন পরপর দ্রুত চলতে থাকে তখন চলমান দৃশ্যের ইলিউশন তৈরি হয় । Image source: filmstudies.qwriting.qc.cuny.edu/

বর্তমানে অত্যন্ত জনপ্রিয় বিনোদন এবং গণমাধ্যম হলো চলচ্চিত্র। চলচ্চিত্র একইসাথে যেমন আর্ট তেমনই এটি অনেক বড় ইন্ডাস্ট্রি। চলচ্চিত্রের এই বিপুল জনপ্রিয়তার পিছনে সব থেকে বড় যে কারণ তা হলো এটি সমস্ত আর্টের একটি সমাগম। এখানে যেমন সাহিত্য আছে তেমন সঙ্গীত আছে, ফটোগ্রাফি আছে, পেইন্টিং আছে, ড্রামা আছে, নৃত্য আছে অর্থাৎ একটি পূর্ণাঙ্গ চলচ্চিত্র দর্শকের মনে সব রকম আর্ট ফর্মের চাহিদা পূরণে সক্ষম।

আর্ট এবং আর্ট ফর্ম বিষয়ে আমরা নন্দনত্ত্ব আলোচনার সময় একটু বিষদ ভাবে জানবো।

চলচ্চিত্র ও নাটকের পার্থক্য

এই বিষয়টি নিয়ে আলোচনার সময় পৃথিবীর যে কোনো দেশেই চলচ্চিত্রের সাথে থিয়েটার নাটকের পার্থক্য তুলে ধরা হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, সম্ভবত একমাত্র আমাদের দেশেই  এই তুলনামূলক আলোচনায় থিয়েটারের চেয়ে টেলিভিশন নাটকের অন্তর্ভুকিটাই অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক। প্রথমেই বলে রাখি, আন্তর্জাতিকভাবে টিভি নাটক বলে কোনো বস্তুর অস্তিত্ব নেই। যা আছে তা হলো টিভি সিরিয়াল। প্যাকেজ নাটকের নামকরণ আমাদের দেশীয় অগ্রজদের। মঞ্চনাটকের ফর্মকে কিছুটা এদিক ওদিক করে ক্যামেরায় ধারণ করে টেলিভিশনে প্রদর্শনের মাধ্যমেই প্যাকেজ নাটকের আবির্ভাব।

{ "slotId": "2452885053", "unitType": "in-article" }

চলচ্চিত্রের সাথে টিভি নাটকের মূল পার্থক্য আসলে দুই জায়গায়- ভিজ্যুয়াল এবং অভিনয়। বিষয়টা একটু পরিষ্কার করার চেষ্টা করি। চলচ্চিত্র আমরা বড় পর্দায় দেখে থাকি। তাই এর দৃশ্য ধারণের সময় তা এমন ভাবে করা হয় যেন পর্দায় মূল সাবজেক্ট (অভিনয়শিল্পী বা অন্য কোনো বস্তু) এর আশেপাশে অনেক বেশি জায়গা দেখা যায়। অর্থাৎ ওয়াইড এঙ্গেল শট বেশী নেয়া হয়। আর টেলিভিশনের পর্দা যেহেতু ছোট তাই চলচ্চিত্রের জন্য ধারণকৃত দৃশ্য টেলিভিশনের জন্য উপযোগী হবে না। কেননা সাবজেক্ট এর আশেপাশে অনেক জায়গা থাকলে টেলিভিশনের ছোট পর্দায় সাবজেক্ট এর অভিব্যক্তি কিংবা সাবজেক্টের চেহারা বুঝতে পারাই কষ্টকর হয়ে যাবে।

নিচে দুইটি ছবি দেয়া হল যাতে চলচ্চিত্র এবং টেলিভিশন নাটকের দৃশ্যায়নের পার্থক্য সহজেই বুঝতে পারবেন।

চলচ্চিত্রের ক্লোজ শট

{ "slotId": "2452885053", "unitType": "in-article" }
Forrest Gump চলচ্চিত্রের একটি ক্লোজ শট, Image source: sploid.gizmodo.com

 

টিভি নাটকের ক্লোজ শট

ভারতীয় টিভি সিরিয়ালের একটি ক্লোজ শট, Image source: pinterest.com

এবার আসি অভিনয়ের পার্থক্যের আলোচনায়। আমরা যখন হলে গিয়ে চলচ্চিত্র দেখি তখন সেখানে আমাদের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করে দেয়া হয়। বাইরের কোনো শব্দ ভিতরে আসে না, পুরো হল থাকে অন্ধকার, বিশাল পর্দায় ফিল্ম চলতে থাকে, দর্শকদের পুরো মনযোগ থাকে চলচ্চিত্রের দিকে। তাই পর্দায় ভেসে ওঠা যে কোনো সুক্ষ্ন অভিব্যক্তি কিংবা ক্ষীণভাবে ভেসে আসা সামান্য একটা দীর্ঘশ্বাসও দর্শকের নজর এড়ায় না। একারণেই অতিরঞ্জিত অভিনয়, অভিব্যক্তি কিংবা উচ্চস্বরে ডায়লগ চলচ্চিত্রের জন্য একেবারেই উপযুক্ত নয়। যেহেতু অনেক বড় পর্দায়, মনযোগের সাথে চলচ্চিত্র দেখা হয় তাই অল্পই বেশি হয়ে চোখে ধরা পড়ে আর বেশি হয়ে গেলে তা অগ্রহণযোগ্য মনে হয়। কিন্তু টেলিভিশনের ক্ষেত্রে বিষয়টি ঠিক উল্টো। দৈনন্দিন নানা কাজের ফাঁকে, অনেক সময় কাজ করতে করতেই বাসায় বসে আমরা টেলিভিশন দেখি। এর মাঝে চারপাশ থেকে অনেক কথা, অনেক শব্দ আমাদের কানে আসে। এছাড়া টেলিভিশনের স্ক্রিন চলচ্চিত্রের তুলনায় নগণ্য। এমতাবস্থায় টেলিভিশনের দিকে দর্শকের মনোযোগ ধরে রাখার জন্যেই কিছুটা অতিরঞ্জিত অভিনয় এবং উচ্চস্বরে ডায়লগ বলা প্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে। টেলিভিশনের অভিনয় শিল্পীদের মঞ্চ এবং সিনেমার মাঝামাঝি একটা মাত্রা নির্ধারণ করে অভিনয় করতে হয়।

বর্তমানে আর্টহাউজ ফিল্মগুলোর ক্ষেত্রে প্রায়ই সাধারণ দর্শকদের বলতে শোনা যায় যে, চলচ্চিত্রের নামে নাটক বানানো হয়েছে। এই অভিযোগ করাটা একজন চলচ্চিত্র নির্মাতার প্রতি অত্যন্ত অবিচার করা হবে যদি চলচ্চিত্রটি উপরে উল্লেখ করা দুইটি পার্থক্য বজায় রেখে নির্মিত হয়। তবে একটা বিষয় বলা প্রয়োজন, এ ক্ষেত্রে দর্শকের দায় কিছুটা কমই। কেননা অধিকাংশ টেলিভিশন নাটক নির্মাতাই টেলিভিশন নাটকে আর্ট হাউজ চলচ্চিত্রের ভিজুয়াল ল্যাঙ্গুয়েজ ব্যবহার করেন। যেহেতু আমাদের দেশে চলচ্চিত্রের বাজার সীমিত এবং সকলের জন্য চলচ্চিত্র নির্মাণেরর সুযোগ কম তাই অনেক নির্মাতাই টেলিভিশন নাটকে চলচ্চিত্রের মতো করে গল্প বলার চেষ্টা করেন। দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানোর মতো আর কি। আর এটা করতে গিয়েই সর্বনাশটা হয়েছে। আর্টহাউজ ফিল্ম দেখতে বসে দর্শকরা ভাবছেন এই জিনিস তো ঘরে বসে টিভি নাটকেই দেখা যায়। তাই ভিজুয়াল স্টোরি টেলিং আর অভিনয়ের ব্যাপারগুলো ওভারলুক করে গিয়ে শুধুমাত্র সরল-সহজ-সাধারণ গল্প দেখলেই তারা বলে দেন এটা তো নাটক দেখলাম।

{ "slotId": "2452885053", "unitType": "in-article" }

আজকের লেখা থেকে আমরা সামান্য ধারণা পেলাম যে, চলচ্চিত্র কী, তথাকথিত টেলিভিশন নাটক এর সাথে চলচ্চিত্রের  বেসিক পার্থক্য কোথায়। তাই পাঠক এবং চলচ্চিত্র দর্শকদের কাছে আমার অনুরোধ থাকবে, আজকের পর থেকে চলচ্চিত্র দেখে আপনার ইচ্ছা মত বিশ্লেষণ করুন, সমালোচনা করুন, ভিজুয়াল ল্যাঙ্গুয়েজ, স্টোরি টেলিং, অভিনয় ইত্যাদি বিষয়ের ভালো মন্দ দিকগুলো নিয়ে কথা বলুন। শুধুমাত্র এই কথাটি বলবেন না, “এটা তো নাটক বানাইছে”। আশা করি পরবর্তী বিষয়ের লেখাগুলো পড়লে পাঠকদের চলচ্চিত্র সম্পর্কিত ধারণা এবং বিশ্লেষণ ক্ষমতা পর্যায়ক্রমে আরও হৃদ্ধ হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *