আগে মানুষ ভাবতো, মানুষ একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ বুদ্ধিমত্তা নিয়ে জন্মায় এবং এই বুদ্ধিমত্তার সর্বোচ্চ ব্যবহার করে সে কাজ করে। সম্প্রতি বিজ্ঞানীরা প্রমাণ করেছেন মানুষ আসলে কিছু আনন্দদায়ক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তার বুদ্ধিমত্তা বাড়াতে পারে। এখন আমরা জানি যে, নতুন কিছু শেখার মাধ্যমে মস্তিষ্ক নতুন নিউরাল কানেকশন তৈরি করে যা আমাদের বুদ্ধিমত্তা বাড়িয়ে দেয় এবং কাজের মান ও দ্রুততা বাড়ে। জেনে নিন এমন নয়টি শখের কথা যেগুলো আপনার বুদ্ধিমত্তা বাড়িয়ে স্মার্ট করে তোলে –
বাদ্যযন্ত্র বাজানো শেখা
সঙ্গীতচর্চা আমাদের সৃজনশীলতা, গাণিতিক দক্ষতা, ভাষাগত দক্ষতা বাড়াতে সাহায্য করে। অনেকের মতে, দলগত খেলাতেও এই সুফলগুলো পাওয়া যায়। বাদ্যযন্ত্র বাজানোর ফলে করপাস কলোসোম শক্তিশালী হয়, যা মস্তিষ্কের হেমিস্ফিয়ারগুলোকে নতুন সংযোগ তৈরির মাধ্যমে একত্রে যুক্ত করে।
উন্নত করপাস কলোসোম যেকোনো বয়সেই আপনার নেতৃত্বের দক্ষতা, স্মৃতি, সমস্যার সমাধান এবং সমগ্র মস্তিষ্কের কাজের মান, গতি ও সাবলীলতা বাড়িয়ে দেয়।
সব সময়ই কিছু না কিছু পড়া
আপনি ‘গেম অব থ্রোন্স, হ্যারি পটার, শার্লক হোমস কিংবা ওয়াল স্ট্রিটের সাম্প্রতিক ইস্যু যাই পড়ুন না কেন সবগুলোই আপনাকে স্মার্ট করে তুলতে সাহায্য করবে। পড়াশোনা আমাদের মানসিক চাপ কমায়। ফলে চাপমুক্ত হয়ে আপনি crystallized, fluid, and emotional এই তিন ধরণের বুদ্ধিমত্তা বাড়াতে পারবেন ।
যা সমস্যা সমাধানে, অনেক ধরনের জ্ঞানের সমন্বয় করে ভালমতো জীবন যাপন করতে, প্যাটার্ন সমাধান করতে, কোনো প্রক্রিয়া সহজে বুঝতে এবং অন্য মানুষের অনুভূতিগুলোকে ভালমতো বুঝতে সহযোগিতা করবে আমাদের এবং কর্মক্ষেত্রে সঠিক ব্যাবস্থাপনায় কাজ করতে পারবেন।
নিত্যনতুন স্থানে ঘুরতে যাওয়া
ভ্রমণ আপনার একঘেয়েমী কাটানোর পাশাপাশি আরও অনেক সুবিধা দেয়। ভ্রমণ আপনার বুদ্ধিমত্তা বাড়িয়ে দেয়। ভ্রমণে যেতে আমাদের যে মানসিক ও শারিরিক পরিশ্রম করতে হয় তাতে মন সহজেই অবসাদ ও চাপ মুক্ত হয়। আপনি ভ্রমণের মধ্য দিয়ে প্রচুর অভিজ্ঞতা অর্জন করবেন। তাতে বিভিন্ন কাজের ক্ষেত্রে আপনার পর্যবেক্ষণ শক্তি বাড়বে, কোনো বিষয় সহজে এবং দ্রুত বোঝার সক্ষমতা বাড়বে। যাত্রাপথে অনেক বেশি মানুষের সাথে মেলামেশার ফলে মানুষের মনস্তত্ত্ব যেমন সহজে বুঝতে পারবেন, তেমনি কর্মীদের থেকে কাজ আদায় করে নিতে পারবেন সহজে। প্রত্যেকটি নতুন স্থান ভ্রমণ আপনার সামনে নতুন কিছু শেখার এবং নতুন অভিজ্ঞতার দরজা খুলে দেবে।
নিয়মিত ব্যায়াম করা
মাঝে মাঝে এবং একা ব্যায়াম করে কোনো ফল হবে না। যখন তখন এক- দুইবার কঠোর পরিশ্রম করার চেয়ে নিয়মিত কম পরিশ্রমেও ভালো ফল পাবেন। নিয়মিত ব্যায়াম করলে দেহের কোষে BDNF নামের একটি প্রোটিন নির্গত হয়। যা স্মৃতি রক্ষা, শেখা, মনোযোগ, বুঝতে পারা ইত্যাদি বুদ্ধিমত্তা সম্পর্কিত কাজে সহযগিতা করে। এটি মানসিক সুস্থ্তার লক্ষণ।
বিজ্ঞানীরা মনে করেন বেশি সময় ধরে বসে থাকা স্বাস্থ্যকর নয়। এর ফলে আমাদের মস্তিশকের স্বাভাবিক কর্মক্ষমতা দিন দিন কমতেই থাকবে।
নতুন ভাষা শেখা
স্মৃতিশক্তি ও মানসিক দক্ষতা বাড়াতে ধাঁধা মিলানো বাদ দিয়ে নতুন একটি ভাষা শিখুন। গবেষণায় দেখা গেছে, যারা বহুভাষী তারা অন্যদের চেয়ে সহজে ধাঁধা মিলাতে পারে। সফলতার সাথে নতুন ভাষা শিখতে পারলে তা আপনার মস্তিশকের কর্মক্ষমতা বাড়াবে। যেকোনো মানসিক দক্ষতায় তারা অন্যদের চেয়ে এগিয়ে থাকবে। তারা পরিকল্পনা এবং সমস্যা সমাধানের কাজে অনেক বেশি দক্ষ হয়ে উঠবে।
আবার কমপক্ষে দুইটি ভাষা বলার যোগ্যতা থাকলে চাকরিদাতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা সহজ হবে। তেমনি আপনার কাজের, মানুষের সাথে ব্যবহারের যোগ্যতা বেড়ে যাবে। অনেকের মতে, উচ্চপদে যাওয়ার জন্য তাদের ইংরেজির পাশাপাশি স্প্যানিশ অথবা ফ্রেঞ্চ ভাষা শিখতে হয়েছে।
নানা ধরনের খাবার রান্না করা
অনেকেই মনে করেন রান্নাবান্না মানেই সময়ের অপচয় এবং তারা একে এড়িয়ে গিয়ে অন্য দিকে মনোযোগ দিতে চান। কিন্তু অযথা ঘ্যানঘ্যান না করে আমরা রান্নায়ও নতুন কিছু করার আনন্দ নিতেই পারি। যারা নানা ধরণের পদ রান্না করেন এবং নতুন পদ শিখে, নিজে থেকে আবিষ্কার করে রান্না করেন এবং কাজটাকে উপভোগ করেন তাদের উচ্চস্তরের সৃজনশীল প্রতিভা আছে। কাজের উন্নত মানের দিকে তাদের নজর থাকে এবং নতুন কিছু করতে এরা ভয় পায় না। যখন আপনি রান্না করছেন তখন আপনি শুধুই রাঁধছেন না, একই সাথে অনেকগুলো দক্ষতা অর্জন করছেন। আপনাকে দ্রুত সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে, সঠিক অনুমান করতে হচ্ছে, একই সাথে সব কিছু দেখে রাখতে হচ্ছে। এইসব গুণ অর্জনের মাধ্যমেই আপনি আরো স্মার্ট হয়ে উঠছেন।
মস্তিষ্ককে কাজ করান
সুডোকো, ধাঁধা সমাধান, রিডল, ভিডিও গেম, কার্ড গেম এগুলো নিউরোপ্লাস্টিসিটি বাড়ায়। যা নিউরাল কানেকশনে এবং সিন্যাপ্সে অনেক ধরনের পরিবর্তন করে। যা মস্তিশকের নতুন বিন্যাসে সহায়তা করে। নার্ভ সেল নতুন কোনো কাজ করলে এর ফলে নতুন নিউরাল সংযোগ তৈরি হয় এবং নিউরোপ্লাস্টিসিটি বাড়ে। যা কোনো একটি বিষয় ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখার প্রবণতা তৈরি করবে।
ধ্যান করা
১৯৯২ সালে দালাই লামা বিজ্ঞানী রিচার্ড ডেভিডসনকে ধ্যানের সময় তার ব্রেন ওয়েভ নিয়ে গবেষণা করার জন্য আমন্ত্রণ জানান। তিনি দেখতে চেষ্টা করেন যে ধ্যানের সময় মস্তিষ্কের যে তরঙ্গ তৈরি করে তাকে নিয়ন্ত্রণ করা যায় কিনা। কিংবা যখন যা ভাবতে চাওয়া হয় তখন তা ভাবা যায় কিনা। এই পরীক্ষা করার জন্য দালাই লামা এবং অন্যান্য ভিক্ষুদের বলা হলো ধ্যানের মধ্যে তাদের মনকে দয়ার দিকে ফোকাস করতে। মস্তিষ্কের এই তরঙ্গকে গবেষণা করে দেখা গেল, ধ্যানের মধ্যে তাদের মন গভীর প্রার্থনায় আচ্ছন্ন। এই পুরো গবেষণাটি পরে ন্যাশনাল একাডেমী থেকে ২০০৪ সালে এবং পরে ওয়াল স্ট্রিট জার্নালে প্রকাশ করা হয়। দুই জায়গাতেই বিষয়টি আলোড়ন তৈরি করে।
অনেক আশাবাদী মানুষের কাছে ধ্যান খুবই আগ্রহের বিষয়। কারণ তারা বিশ্বাস করে ধ্যানের মাধ্যমে ইতিবাচক কমান্ড বারবার দিয়ে আমরা আমাদের মস্তিষ্কের ভাবনাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি। এবং এর ফলে মনে ইচ্ছামতো ইতিবাচক সাড়া ফেলা যায়, যা সাফল্যের জন্য খুবই জরুরি। কোনো আলোচনা কিংবা বিশেষ কোনো কাজ যার আগে আপনি নার্ভাস হয়ে যান তাতে ধ্যান করলে অনেক বেশি আত্মবিশ্বাসী হতে পারবেন।
নিয়মিত লেখালেখি করা
আপনি যদি নিয়মিত লেখার চর্চা করেন তাহলে আপনার সার্বিক বুদ্ধিমত্তার মান বাড়বে। লেখালেখি অবশ্যই আপনার ভাষাগত দক্ষতা বাড়াবে। কিন্তু একই সাথে আরও কিছু দক্ষতাও বাড়াবে যেমন – সহজে মনোযোগ কেন্দ্রিভূত করতে পারা, সৃজনশীলতা, কল্পনাশক্তি বাড়াবে। লেখকদের খুবই উচ্চ বুদ্ধিমত্তার মানুষ হিসেবে বিবেচনা করা হয় – আসলেও তাই। আপনি যেকোনো ভাবে লিখতে পারেন। আপনি কাগজে-কলমে কিংবা ব্লগে লিখতে পারেন। মনের মধ্যে থাকা ছবিগুলোকে ভাষা দিয়ে সবার সামনে সুন্দরভাবে, আপনার পছন্দমত উপস্থাপন করতে পারবেন। নিজের মনের অনুভূতিগুলোকে, চিন্তাগুলোকে সহজে, সুন্দরভাবে লিখে প্রকাশ করতে পারাটা উচ্চ বুদ্ধিমত্তা ও স্মার্টনেসের লক্ষণ।