যেকেউ ইউটিউবে চ্যানেল খুলে ভিডিও আপলোড করে তা থেকে আয় করতে পারে। এটি একটি উন্মুক্ত প্ল্যাটফর্ম। কিন্তু এই উন্মুক্ত প্লাটফর্মে প্রবেশ করা যতটা সহজ, এখান থেকে সফল হওয়া ততটা সহজ নয়। ইউটিউবে সাফল্যের জন্য নানান খুটিনাটি বিষয়ে তীক্ষ্ণ নজর রাখতে হয়। নিয়মিত চ্যানেলের এসইও করতে হয়, এবং মনোযোগ ধরে রেখে দীর্ঘদিন ভিডিও আপলোড করে যেতে হয়।
তবে একটি ইউটিউব চ্যানেলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো তার কনটেন্ট, অর্থাৎ ভিডিও। আপনার তৈরি করা ভিডিও ইউটিউবের দর্শক দেখবে কিনা তা নির্ভর করে আপনার ভিডিও তৈরীর দক্ষতার ওপর। আপনার ভিডিওর মান এবং বিষয়বস্তু দর্শকের কাছে যতটা আকর্ষণীয় হবে দর্শক আপনার চ্যানেল ততটাই আগ্রহ নিয়ে দেখবে। ইউটিউব চ্যানেলে অধিক সাবস্ক্রাইব, এবং ভিউ পাওয়ার জন্য ভালো ভিডিও তৈরির বিকল্প নেই। আজকের নিবন্ধে ইউটিউবের জন্য ভালো কনটেন্ট প্রস্তুত করার কলাকৌশল নিয়ে আলোচনা করবো।
১. একটি চ্যানেলে একই ধরনের ভিডিও
ইউটিউবের জন্য ভিডিও তৈরি করার পূর্বে নিশ্চিত হয়ে নিন আপনি আসলে কোন বিষয়ে কাজ করতে চান। অর্থাৎ আপনার কনটেন্ট বা বিষয়বস্তু কি হবে? আমি ইতিপূর্বে একাধিক নিবন্ধে ইউটিউবের অভিনব সব কনটেন্ট আইডিয়া নিয়ে আলোচনা করেছি। সেখান থেকে কনটেন্ট আইডিয়া নিয়ে ইউটিউবিং শুরু করতে পারেন।
তবে একটি নির্দিষ্ট কনটেন্ট আইডিয়া মাথায় নিয়ে ভিডিও তৈরি করা শুরু করলে ওই চ্যানেলে অন্য কোনো ভিডিও প্রকাশ না করাই শ্রেয়। সব সময় আপনার ইউটিউব কমিউনিটি এবং দর্শকের চাহিদা মাথায় রেখে ভিডিও তৈরি করুন। ইউটিউবে বিভিন্ন ধরনের চ্যানেল আছে। যার যে চ্যানেল পছন্দ সেই চ্যানেলটি মানুষ সাবস্ক্রাইব করে রাখে।
সুতরাং আপনার চ্যানেলে আপলোড করা ভিডিও দেখে দর্শক বুঝে যাবে আপনার চ্যানেলটি কোন ধরনের। এমনকি ইউটিউবের এলগরিদমও সহজেই এটা নির্ণয় করতে জানে। কাজেই আপনি একটি প্রযুক্তি পণ্য রিভিউ চ্যানেলে হঠাৎ করে যদি একটি শর্ট ফিল্ম প্রকাশ করে দেন তবে নিশ্চয়ই আপনার দর্শকরা হতাশ হবে! কেননা তারা শর্ট ফিল্ম দেখার জন্য আপনার চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করেনি। সুতরাং দর্শকের মনোযোগ ধরে রাখতে একটি চ্যানেলে সব সময় একই ধরনের ভিডিও আপলোড করুন।
২. সংক্ষিপ্ত এবং যথাযথ ভিডিও নির্মাণ
ইউটিউবে ভিডিও র্যাংক করাতে হলে নিশ্চিত করতে হবে দর্শক আপনার ভিডিওটি সম্পূর্ন দেখছে কিনা। ইউটিউবে ভিডিওর ওয়াচ-টাইম এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ২০১৭ সালের শেষের দিকে ইউটিউব তাদের অ্যালগোরিদমে ব্যাপক পরিবর্তন আনে। এরপর থেকে ভিডিওর ভিউ সংখ্যার চেয়ে ওয়াচ-টাইম তথা দেখার সময়কাল বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উছেঠে। এই কারণে যে ভিডিও গুলো দর্শক ১০০ শতাংশ বা তার কাছাকাছি দেখে সেই ভিডিও গুলো ইউটিউব সার্চে র্যাংক হয়।
সুতরাং ১৫ মিনিট দীর্ঘ একটি ভিডিও তৈরি করে যদি দর্শক ধরে রাখতে ব্যর্থ হন, তবে এমন ভিডিও বানানোর প্রয়োজন নেই। অর্থাৎ ভিডিও তৈরি করুন যথাযথ এবং সংক্ষিপ্ত, যেন আপনার তৈরি করা ভিডিওটি দর্শক সম্পূর্ণ দেখে।
কেননা আপনার ভিডিও কতটা দীর্ঘ সেটা মুখ্য বিষয় নয়, বরং সম্পূর্ণ ভিডিওর কত শতাংশ মানুষ দেখল সেটাই গুরুত্বপূর্ণ। কাজেই ইউটিউবের জন্য ভিডিও তৈরীর সময় এই সূক্ষ্ম বিষয়টি মাথায় রাখুন, এবং যথাযথ ভিডিও তৈরি করুন। যেন আপনার ভিডিওর বিষয়বস্তু বুঝতে হলে একজন দর্শককে সম্পূর্ণ ভিডিওটি দেখতে হয়। এই কৌশলটি কাজে লাগালে আপনি খুব সহজেই ১০০ শতাংশ ভিডিও ভিউ নিশ্চিত করতে পারবেন। তাতে সহজেই আপনার ভিডিও র্যাংক হবে।
৩. ৮ থেকে ১২ মিনিট দৈর্ঘ্যের ভিডিও তৈরি করুন
ঠিক উপরের পয়েন্টে যে বিষয়টি আলোচনা করেছি, এবার তার বিপরীত বক্তব্য দিতে চলেছি। অর্থাৎ বলতে চাইছি, আপনার ভিডিও দীর্ঘ করার চেষ্টা করুন। কেননা ইউটিউবের বিবেচনায় সংক্ষিপ্ত ভিডিওগুলো সব ধরনের বিজ্ঞাপন প্রচারের জন্য উপযুক্ত নয়, অর্থাৎ আপনার ভিডিও যদি তিন মিনিটের কম হয় তাহলে ইউটিউবের ভিডিওতে যে চার প্রকার বিজ্ঞাপন প্রচার করা হয়, তার সবগুলো আপনার ভিডিওতে প্রদর্শিত হবে না।
এক্ষেত্রে আদর্শ সময়সীমা হল ৮ থেকে ১২ মিনিট। এই ৮ থেকে ১২ মিনিট দৈর্ঘ্যের ভিডিওতে ইউটিউবের সরবরাহ করা চার প্রকারের বিজ্ঞাপনের সবগুলোই প্রদর্শিত হয়।
এটা বলার অবকাশ রাখে না যে, আপনি ইউটিউবিং করছেন টাকা রোজগার করার জন্য। কিন্তু সংক্ষিপ্ত ভিডিও হওয়ার কারণে আপনার রোজগার যদি কমে যায়, তবে এটা নিশ্চয়ই কাম্য নয়। সুতরাং ভিডিও অবশ্যই যথাযথ এবং সংক্ষিপ্ত করার চেষ্টা করুন। তবে তা ৮ থেকে ১২ মিনিটের মধ্যে।
আবার কোনো কোনো ভিডিওর ধরন এমন যে তা কোনভাবেই ৩ মিনিটের চেয়ে দীর্ঘ করা সম্ভব নয়। এমন ভিডিওর ক্ষেত্রে অযথা কালক্ষেপণ করে ভিডিও দীর্ঘ করার কোনো প্রয়োজন নেই। কেননা এটি এমন কোনো অবশ্যপালনীয় বিষয় নয়। শুধুমাত্র অধিক রোজগার নিশ্চিত করার জন্যই এই পরামর্শটি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
৪. ওয়াচ-টাইম বিশ্লেষণ
আগেই বলেছি ইউটিউবে সাফল্যের জন্য আপনাকে নানান খুটিনাটি বিষয় মনোযোগী হতে হবে। আপনার চ্যানেলের ভিডিও যদি কোনোভাবেই র্যাংক না করে, অথবা ভিউ কম হয়, তাহলে বুঝতে হবে দর্শক আপনার ভিডিও গ্রহণ করছে না। কিন্তু প্রশ্ন হলো, আপনার প্রতিটি আলাদা আলাদা ভিডিও দর্শক কত শতাংশ দেখেছে? এটা জানা খুব জরুরী।
আপনি যখন জানতে পারবেন দর্শক আপনার ভিডিও কতটুকু দেখছে, অথবা দেখেনি, তখন কোন বিষয় পরিবর্তন আনতে হবে তা খুব সহজেই আপনি অনুধাবন করতে পারবেন। সুতরাং এর জন্য ভিডিওর ওয়াচ টাইম এবং ভিউ বিশ্লেষণ করতে হবে।
এই কাজটি করার জন্য আপনি ইউটিউবের ডানদিকের কোনায় আপনার প্রোফাইল আইকনে ক্লিক করুন। তারপর ক্রিয়েট ষ্টুডিওতে প্রবেশ করুন। এই পেজের বাঁদিকে নিচে ANALYTICS-এ ক্লিক করুন। তারপর এনালিটিক্স পৃষ্ঠার ডানদিকে ‘গড় দেখার সময়’ বিভাগটি দেখুন। এখানে আপনার দৈনন্দিন ইউটিউবের ভিউ সংখ্যা, প্রতিটি আলাদা আলাদা ভিডিওর গড় ওয়াচ-টাইম, এবং তার বিপরীতে রেভিনিউ, সব কিছুই দেখতে পাবেন। সুতরাং এই এনালিটিক্স পেজটি নিয়ে গবেষণা করুন, এবং নির্ণয় করুন আপনার ভিডিও কেন ভিউ হচ্ছে না। তারপর প্রয়োজনীয় সংশোধনী এনে নতুন ভিডিও তৈরি করুন।
৫. ভিডিও কার্ড এবং ইয়েন্ড স্ক্রিনের ব্যবহার
একটি ভিডিও চলাকালীন অন্যান্য ভিডিওতে দর্শককে আকৃষ্ট করার জন্য ভিডিও কার্ড এবং ইয়েন্ড স্ক্রিন ব্যবহার করুন। ভিডিও কার্ড ব্যবহার করে দর্শককে সরাসরি আপনার অন্যান্য ভিডিওতে মনোযোগী করে তুলতে পারেন।
অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ভিডিও লিংক গুলির সাথে ছোট ছোট টিকা যোগ করে দর্শকের কাছে আকর্ষণীয় করে তুলুন। আকর্ষণীয় শব্দের টীকা লেখার মাধ্যমে দর্শককে নতুন ভিডিও দেখতে প্রলুব্ধ করুন। এবং অবশ্যই ভিডিওর শেষে ইয়েন্ড স্ক্রিনে আরো দুইটি গুরুত্বপূর্ণ ভিডিও এবং সাবসক্রিপশন বাটনটি যুক্ত করে দিন। এই কৌশলগুলো কাজে লাগালে কিছুটা হলেও ভিডিওর ভিউ এবং ওয়াচ-টাইম বাড়বে।
ইউটিউবে সফল হওয়ার সব কৌশল শিখতে আমার নিজেরই দীর্ঘ সময় লেগেছে। তাছাড়া ইউটিউব ক্রমাগত নতুন নতুন পরিবর্তন আনছে, এবং আমাদের তা বাধ্য হয়ে শিখতে হচ্ছে।
সুতরাং ইউটিউবে সফল হওয়ার কৌশল একদিনে শিখে ফেলার মতো বিষয় নয়। তবুও আমার বিশ্বাস এই নিবন্ধ থেকে ইউটিউবের ভিডিও তৈরি এবং ভিউ বাড়ানো ও ওয়াচ-টাইম ধরে রাখার কৌশল রপ্ত করতে পারবেন। পরবর্তী কোনো নিবন্ধে ইউটিউবিংয়ের অন্যান্য বিষয় নিয়ে আলোচনা করার আশা রাখছি।