প্রযুক্তি দুনিয়ায় প্রতিনিয়ত ঘটে চলেছে নানা আবিষ্কার, নানান উদ্ভাবন। কিন্তু ঠিক কতগুলোর খবরই বা আমরা জানি কিংবা রাখি? কিছু প্রযুক্তি শুধু উদ্ভাবিত হয় কিন্তু প্রকাশ পায় না, কিছু প্রযুক্তি উদ্ভাবনের সাথে সাথেই ছড়িয়ে যায় সর্বত্র, ছড়িয়ে দেয় এক নতুন মাত্রা, আর কিছু প্রযুক্তি হারিয়ে যায় প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে। তেমনি ২০১৭ সালও ছিল একটি প্রযুক্তিসমৃদ্ধ বছর, যে বছরে ঘটে গেছে নানান কিছু, হয়ে গেছে নানান উদ্ভাবন।
সেই হাজারো উদ্ভাবনের মধ্য থেকে সেরা, তাক লাগানো ১০ টি প্রযুক্তি নিয়ে আলোকপাত করা হয়েছে ‘MIT Technology Review’-তে, যেখানে স্থান পেয়েছে মস্তিষ্ক নিয়ে গবেষণা, সিকিউরিটি সিস্টেমকে আরো আধুনিক করা, নতুন প্রযুক্তিবান্ধব যান, কোয়ান্টাম কম্পিউটার, সৌর কোষ, জিন থেরাপি সহ আরও বেশ কিছু প্রযুক্তি। চলুন জেনে নেই সেই সব প্রযুক্তি সম্পর্কে।
১. প্যারালাইসিস নিরাময়
প্যারালাইসিস শব্দটি শুনলে অনেকেই ভয় পেয়ে যান। সেই প্যারালাইসিস নিরাময়কারী প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করছেন বিজ্ঞানীরা, যা সম্ভব হবে ব্রেইন ইমপ্লান্টের মাধ্যমে। এটি কোনো প্রকার আঘাতপ্রাপ্ত স্পাইনাল কর্ডকে পুনরায় স্থাপন এবং গতিবিধি বা চলাচল নিয়ন্ত্রণের স্বাধীনতা দিবে। গবেষকরা আশা করছেন, আগামী ১০-১৫ বছরের মধ্যেই এই প্রযুক্তি চলে আসবে চিকিৎসা বিজ্ঞানে, বেঁচে যাবে অনেক রোগীর জীবন।
আমরা জানি যে, শরীরের প্রতিটি অঙ্গকেই নিয়ন্ত্রণ করে মস্তিষ্ক, আর কোনো কারণে (দুর্ঘটনা বা রোগ) মস্তিষ্কের কোনো অংশের ক্ষতি হলে মস্তিষ্ক সেই অঙ্গকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। অর্থাৎ মস্তিষ্কে সংকেত আদান-প্রদান ব্যবস্থা ব্যহত হয়। যার ফলে আঘাতপ্রাপ্ত অঙ্গটি কাজ করতে অসমর্থ হয় এবং সেটি রূপ নেয় প্যারালাইসিসের দিকে। তবে যদি আঘাত গুরুতর না হয় তাহলে কিছুক্ষণ পর সেটি আবার কার্যক্ষম হয়। কিন্তু যদি কোনো কারণে দীর্ঘদিন পরেও অঙ্গের কার্যক্ষমতা ফিরে না আসে তখন কী করণীয় তা নিয়ে চিকিৎসা বিজ্ঞানের কোনো উত্তর জানা ছিল না।
কিন্তু ফ্রান্সের একদল গবেষক সেই অজানারই উত্তর খুঁজেছেন, কিভাবে? তারা কাজে লাগিয়েছেন কম্পিউটারকে, যার মাধ্যমে মস্তিষ্কের কার্যকলাপ সংকেতে রূপান্তর করা সম্ভব হয়েছে। এক্ষেত্রে তারা কার্যক্ষম অঙ্গ থেকে সংকেত গ্রহণ করতে পারেন এবং সেই সংকেতকে কোনো বিকল অঙ্গে পাঠাতে সক্ষম হয়েছেন। আর সমগ্র ব্যবস্থাটি পরিচালিত হবে তারহীন প্রযুক্তির মাধ্যমে এবং গবেষক দল বিশ্বাস করেন, তারা এই প্রযুক্তির মাধ্যমে প্যারালাইসিসে আক্রান্ত ব্যক্তিকে সুস্থ করে তুলতে পারবেন। গবেষক দল একটি বানরের উপর তাদের এই প্রযুক্তির ব্যবহার করেছেন এবং বানরের অঙ্গের সংকেত গ্রহণ এবং সেটিকে পুনরায় বিকল অঙ্গে পাঠাতে সক্ষম হয়েছেন।
২. স্বয়ংক্রিয় ট্রাক
আগামী ৫-১০ বছরের মধ্যেই হাইওয়েতে চলার উপযোগী হচ্ছে এই চালকবিহীন স্বয়ংক্রিয় ট্রাকগুলো।
আর ২০১৭ সালের সবথেকে আলোচিত প্রযুক্তির একটি হচ্ছে এটি। প্রথম দিকে শুধু চালকবিহীন গাড়ির প্রচলন শুরু হলেও এখন সেটি ট্রাকের জন্য প্রযোজ্য। সম্প্রতি বিখ্যাত গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ‘টেসলা’ তাদের চালকবিহীন গাড়ির পাশাপাশি চালকবিহীন সেমিট্রাকের প্রদর্শনী করেছে, যা ২০১৮ সালেই বাজারে আসবে।
কিন্তু এক্ষেত্রে মাথায় রাখতে হবে বেশ কয়েকটি বিষয়কে। প্রথমত, ট্রাক একটি ভারী পণ্যবহনকারী পরিবহন। এতে প্রযুক্তির ব্যবহার শুরু করাটা বেশ ঝুঁকিপূর্ণ ও সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। দ্বিতীয়ত, গাড়ির চেয়ে ট্রাকে পণ্য এবং অবস্থাভেদে গতির পরিবর্তনও ভিন্ন। তৃতীয়ত, একজন দক্ষ চালকের অবশ্যই প্রয়োজন রয়েছে একটি পণ্য বোঝাই ট্রাককে কোনো রকম দুর্ঘটনা ছাড়া সঠিক গন্তব্যে পৌঁছে দিতে। আর দক্ষ চালক একদিনে হওয়া সম্ভব নয়। একটি কম্পিউটারকে যখন এত কিছু বিবেচনা করে কাজ করতে এবং নিয়ন্ত্রণ করতে হবে তখন ব্যাপারটা আসলে যতটা সোজা মনে হয় ততটা সোজা নয়। তবে দীর্ঘ গবেষণার ফলে সাফল্য পেয়েছেন বিভিন্ন গবেষক। আর বেশ কিছু নির্মাতা প্রতিষ্ঠান তাদের গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন এখনও। এছাড়া চীনেও এরকমের পরীক্ষামূলক ট্রাক দেখা যাচ্ছে। কিন্তু সমস্যার কথা হচ্ছে, ট্রাকচালকদের কর্মসংস্থানের বিষয়টি। যুক্তরাষ্ট্রে শ্রম পরিসংখ্যান ব্যুরোর মতে, প্রায় ১৭ লাখ পেশাদার ট্রাক চালক রয়েছেন যাদের স্বয়ংক্রিয় ট্রাক প্রযুক্তির বদলে কর্মসংস্থানের যোগান দেয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
৩. লেনদেন হবে আপনার মুখের অবয়ব অনুযায়ী
কেমন হবে যদি আপনার চেহারার মাধ্যমেই আপনি করতে পারেন লেনদেন, যাতে দিতে হবে না আঙ্গুলের ছাপ, থাকবে না আঙ্গুলের ছাপ চুরি হবার ভয়? হ্যাঁ, ঠিক এমন প্রযুক্তিই আবিষ্কৃত হয়েছে যাতে ব্যবহৃত হবে আপনার মুখমণ্ডল আর যা হবে বায়োমেট্রিক পদ্ধতির থেকেও বেশি নিরাপত্তাবেষ্টিত। আর এই প্রযুক্তির জন্য আপনার অপেক্ষা করার প্রয়োজন নেই, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ইতোমধ্যেই এই প্রযুক্তির ব্যবহার শুরু হয়ে গিয়েছে।
আপনার চেহারা বা মুখমণ্ডল স্ক্যান করেই চলবে এখন লেনদেন। শুধু তাই নয়, এর মাধ্যমে শনাক্ত করা যাবে অপরাধীকে। এই প্রযুক্তি ব্যবহার করার জন্যে একটি স্মার্টফোনই যথেষ্ঠ। আর সেটি প্রকাশ পেয়েছে এ বছরে বাজারে আসা আইফোন ১০ স্মার্টফোনটিতে। যাতে ‘ফেসঅ্যাপ’ নামক ব্যবস্থার মাধ্যমে ফোনটিকে আনলক করা যাবে। তবে স্মার্টফোন ছাড়া স্ক্যান করার যন্ত্রটি এখন পর্যন্ত শুধুমাত্র চীনেই সীমাবদ্ধ রয়েছে। দেশটির বড় বড় বিপণি বিতানগুলোতে রয়েছে এই স্ক্যানিং পদ্ধতি, যার মাধ্যমে ক্রেতারা অর্থ পরিশোধ করতে পারছেন খুব সহজেই। তাছাড়া চীন এই ব্যবস্থাটিকে ব্যবহার করছে অপরাধীদের খুঁজে বের করতেও। বেশ কয়েক বছর ধরে গোয়েন্দা সংস্থাদের কম্পিউটারগুলো কাজ করে চলেছে মানুষের মুখ বা চেহারা স্ক্যান করা নিয়ে। আর প্রযুক্তির বিবর্তনে বিষয়টি অনেক এগিয়েছে, তাই এই প্রযুক্তির সাহায্য নিয়েই চীনের রাস্তাগুলোতে বসানো হচ্ছে মানুষের চেহারা শনাক্ত করতে সক্ষম এমন ক্যামেরা। শুধু মানুষ নয়, প্রযুক্তির বিবর্তনে ক্যামেরাগুলো এখন গাড়ির তথ্যও বের করতে সক্ষম।