আমরা ১ম পর্বে ভাষা অর্জনসংক্রান্ত প্রাথমিক স্তরের বক্তব্য ও আচরণবাদ সম্পর্কে জেনেছি। এ পর্বে আমি আপনাদেরকে বিশ্বজনীন ব্যাকরণ ও কগনেটিভ তত্ত্বসহ, আরো গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্য সম্পর্কে অবহিত করার চেষ্টা করবো। তাই কীভাবে মানুষ ভাষা অর্জন করে, সে সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গভাবে ধারণা পেতে এ আর্টিকেলটি পড়ুন।
বিশ্বজনীন ব্যাকরণ
আমেরিকান ভাষাতাত্ত্বিক ও ভাষাদার্শনিক নোয়াম আব্রাহাম চমস্কি আচরণবাদের কঠোর সমালোচনার মধ্য দিয়ে সহজাতবাদী (Innatist) ভাষা-দর্শনের সূত্রপাত ঘটান। মানুষ কীভাবে ভাষা অর্জন করে; তার প্রক্রিয়াকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে, নোয়াম আব্রাহাম চমস্কি বেশ নতুন এক ধারণা ও মতবাদ নিয়ে বিশ্বের কাছে হাজির হন।
এবার ভাষা অর্জন সংক্রান্ত সকল মতবাদ অভিজ্ঞতাবাদ (Empiricism) ও সহজাতবাদ (Innatism) এ দুটি পরস্পর বিরোধী দার্শনিক মতবাদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। চমস্কি মানব মস্তিষ্ককে মডিউলার বা প্রকৌষ্ঠিক রূপে দেখেন। নানা ধরনের কর্ম সম্পাদনের জন্য মস্তিষ্কে পৃথক পৃথক অংশ বা প্রকোষ্ঠ (Module) নির্ধারণ করা রয়েছে। আর ভাষার জন্যও মানব মস্তিষ্কে পৃথক মডিউল বা প্রকোষ্ঠের অস্তিত্ব রয়েছে।
ভাষা হচ্ছে এক ধরনের বুদ্ধিবৃত্তিক অঙ্গ, যা স্বয়ংক্রিয় এবং মস্তিষ্কের অন্যান্য অংশের থেকে পৃথক। আর তিনি মস্তিষ্কের এ প্রকোষ্ঠকে এলএডি (Language Acquisition Device) হিসেবে অভিহিত করেন। এ এলএডিয়ের মাধ্যমেই মানব শিশুরা খুব সহজে ও দ্রুততার সঙ্গে ভাষা অর্জন করে থাকে। এলএডির পরে চমস্কি ইউজি (Universal Grammar) ধারণার উদ্ভব ঘটান; আর ইউজিকে চমস্কি ল্যাংগুয়েজ ফ্যাকাল্টি নামেও অভিহিত করেন। তার মতে পৃথিবীতে মাত্র একটিই ভাষা রয়েছে, আর ভাষার প্রধান অংশগুলো হলো কর্তা, কর্ম, ক্রিয়া, উদ্দেশ্য, বিধেয় ইত্যাদি।
ফলে দেখা যাচ্ছে, তিনি ব্যাকরণের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করেছেন; যা নোয়াম চমস্কির ভাষায় জেনারেটিভ ব্যাকরণ নামে পরিচিত। শুদ্ধভাবে লেখা ও পড়ার জন্য আদর্শ ব্যকরণের অবশ্যই প্রয়োজন আছে। তবে আমরা যখন কথা বলে থাকি, তখন প্রচুর বাক্য উচ্চারণ করি, যা ব্যাকরণসম্মত না। কিন্তু এতে আমাদের মনের ভাব প্রকাশ করার ক্ষেত্রে, তেমন কোনো ব্যাঘাত ঘটে না। এসব অব্যাকরণসম্মত বাক্যগুলোকেও যে ব্যাকরণের আওতাভুক্ত করতে হবে, এমন কথা চমস্কি বলছেন না। বরং তার জেনারেটিভ ব্যাকরণের উদ্দেশ্য হচ্ছে, এমন কয়েকটি নির্দিষ্ট নিয়ম তৈরি করা, যে নিয়মে একটি ভাষার অধিকাংশ বাক্যকে নির্মাণ (Generate) করা সম্ভব।
কগনেটিভ তত্ত্ব
সুইস জীববিজ্ঞানী ও মনস্তাত্ত্বিকবিদ জাঁ পিয়াজে মানব শিশুর মনস্তত্ত্ব নিয়ে বিশেষভাবে অধ্যয়ন করেছেন। তিনি জ্ঞানের বিকাশকে বেছে নিয়ে ছিলেন, তাঁর গবেষণার মূল প্রতিপাদ্য হিসেবে এবং জ্ঞান বিকাশের প্রক্রিয়া হিসেবেই মানব আচারণ ও ভাষা অর্জন সংক্রান্ত বিষয়ে ব্যাখ্যা প্রদান করার চেষ্টা করেন। তিনি শিশুদের ওপর গবেষণা চালিয়ে প্রমাণ করেন যে, শিশুর জ্ঞানের বিকাশ মূলত পরিবেশের সাথে খাপ খাওয়ানোর এক বিশেষ ধরনের যোগ্যতা।
পরিবেশের বিভিন্ন বস্তু ও ঘটনার সাথে পারস্পারিক ক্রিয়ার মাধ্যমে, শিশুরা এ ধরনের যোগ্যতা লাভ করে থাকে। জাঁ পিয়াজে গবেষণার মাধ্যমে দেখতে পান যে, শিশু তার জ্ঞানের নির্মাণ প্রক্রিয়ায় সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। এ প্রক্রিয়ায় পুরনো জ্ঞান নতুন জ্ঞানের সাথে যুক্ত হয় এবং তার পুরনো জ্ঞানের সংশোধন ও পুনর্গঠন চলতে থাকে। তিনি বলেন, একটি শিশুকে বিভিন্ন জ্ঞান ও ধারণাসমূহ নির্মাণ করে নিতে হয় কিংবা শৈশবের দিনগুলোতে চারপাশের পরিবেশের সাথে প্রত্যক্ষ সংযোগ স্থাপনের মধ্য দিয়ে উদ্ভাবন করতে হয়। জাঁ পিয়াজের এ মতবাদই নির্মাণবাদ বা কগনিটিভ তত্ত্ব হিসেবে পরিচিত।
তিনি বিশ্বাস করতেন জ্ঞান ও ধারণাসমূহ ভাষার চেয়ে আগে এসেছে। যেমন: একটি শিশু যখন বলে, বলটি লাল, এ শব্দাংশ কিংবা বাক্যটি উচ্চারণ করার আগে, সে অবশ্যই বল ও লাল রং সম্পর্কে ধারণা ও জ্ঞান অর্জন করেছে। এ বস্তু সম্পর্কে ধারণা না থাকলে, সে এ বাক্য বলতে পারতো না।
ভাষা অর্জন সংক্রান্ত এ তিনটি তত্ত্বই বেশ প্রভাবশালী ও সুপরিচিত। এ তত্তগুলোর মাধ্যমে আমরা কীভাবে ভাষা অর্জন করে থাকি, সে সম্পর্কে সহজেই অনুমান করতে পারি। এবার আমি ভাষা সংক্রান্ত আরো কিছু তথ্য নিয়ে আলোচনা করব, এতে ভাষা অর্জন সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার ধারনা আরো সুস্পষ্ট হয়ে যাবে।
ভাষার বৈশিষ্ট্যসমূহ
সাধারণভাবে একটি ভাষা বিশ্লেষণ করলে সিনট্যাক্স, সেমান্টিক্স, ফোনোলজি, মর্ফলজি ও প্রাগমেটিক্স এ পাঁচটি বৈশিষ্ট্য ও উপাদান পাওয়া যায়।
ক. সিনট্যাক্স
সিনট্যাক্সকে বাংলায় বাক্যতত্ত্ব হিসেবে অভিহিত করা হয়। বিভিন্ন শব্দ ও শব্দসমষ্টি ব্যাকরণ সম্মতভাবে সাজানোর মাধ্যমে একটি ভাষার সঠিক বাক্য গঠন করাকে সিনট্যাক্স বলা হয়। সিনট্যাক্স ব্যতীত একটি ভাষা বোধগম্য হয়ে ওঠে না।
যেমন: আর গরু মাঠে খাবার মানুষ খায় ঘাস রেস্টুরেন্টে। এ বাক্যটি দ্বারা কিছুই বোঝা যাচ্ছে না; প্রকৃতপক্ষে সিনট্যাক্স অনুযায়ী বাক্যটি হবে, গরু মাঠে ঘাস খায় আর মানুষ রেস্টুরেন্টে খাবার খায়।
খ. সেমান্টিক্স
সেমান্টিক্সকে বাংলা ভাষায় অর্থতত্ত্ব হিসেবে অভিহিত করা হয়। একটি ভাষায় ব্যবহৃত বিভিন্ন শব্দ ও শব্দাংশের অর্থ এবং অর্থ পরিবর্তনের ইতিহাস ইত্যাদি বিষয় নিয়ে ভাষাবিজ্ঞানের এ শাখাটি আলোচনা করে থাকে।
গ. মর্ফলজি
মর্ফলজি বাংলা ভাষায় শব্দতত্ত্ব বা রূপমূলতত্ত্ব হিসেবে পরিচিত। ভাষাবিজ্ঞানের এ শাখায় শব্দের গঠন নিয়ে আলোচনা করা হয়। মর্ফলজি মূলত শব্দের রূপ ও অর্থের মধ্যকার সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা উপস্থাপন করে। শব্দ যেহেতু ভাষার একটি কেন্দ্রীয় ধারণা, সেহেতু রূপমূলতত্ত্বের সাথে ভাষাবিজ্ঞানের অন্যান্য শাখা যেমন: ধ্বনিতত্ত্ব এবং অর্থ ও বাক্যতত্ত্বের মধ্যে গভীর সম্পর্ক রয়েছে। এছাড়াও রূপমূলতত্ত্বের সূত্রগুলো মেনে ভাষায় নতুন নতুন শব্দ তৈরি হয়, ফলে অভিধানবিজ্ঞানের সাথেও মর্ফলজির নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে।
ঘ. ফোনোলজি
ফোনোলজি বাংলা ভাষায় ধ্বনিতত্ত্ব হিসেবে পরিচিত। এটি ভাষাবিজ্ঞানের এমন একটি শাখা যেখানে কোনো নির্দিষ্ট ভাষার ধ্বনিব্যবস্থা আলোচিত হয় ।
এতে মূলত বাক ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে সৃষ্ট ধ্বনির ভৌত উৎপাদন ও অনুধাবন নিয়ে আলোচনা করা হয়। ধ্বনিতত্ত্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো একটি ভাষার স্বলক্ষণযুক্ত (distinctive) পৃথক পৃথক ধ্বনি এককগুলো বের করা। যেমন, ইংরেজিতে p এবং b দুইটিই পৃথক ধ্বনি একক।
ঙ. প্রাগমেটিক্স
প্রাগমেটিক্স বাংলা ভাষায় প্রয়োগবিজ্ঞান হিসেবে পরিচিত। ফার্দিন্যন্দ দ্য সস্যূর বর্ণিত সাংগঠনিক ভাষাবিজ্ঞানের প্রতিক্রিয়ায় প্রাগমেটিক্সের উদ্ভব ঘটে। বিংশ শতকের নব্বইয়ের দশকের দিকে প্রাগমেটিক্স ভাষাবিজ্ঞানের একটি স্বতন্ত্র শাখা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে শুরু করে। ১৯৮৫ সাল থেকে প্রয়োগবিজ্ঞান বিষয়ক আন্তর্জাতিক সম্মেলন হয়ে আসছে।
সে সময়ে গঠিত হয় আন্তর্জাতিক প্রয়োগতাত্ত্বিক সমিতি। প্রয়োগবিজ্ঞানের সংজ্ঞা ও পরিধি নিয়ে মত পার্থক্য থাকলেও, প্রয়োগবিজ্ঞান যে ভাষাবিজ্ঞানের অন্যতম নতুন একটি শাখা ও ধারণা, এ বিষয়ে সকলেই একমত পোষণ করেছেন এবং একে বিভিন্ন ভাষাবিজ্ঞানীরা বিভিন্ন ভাবে সংজ্ঞায়িত করার চেষ্ঠা করেছেন। জিওফ্রি লিচ বলেন, “প্রয়োগবিজ্ঞান হচ্ছে ভাষিক প্রকাশ এবং এদের ব্যবহারকারীর মধ্যকার সম্পর্কসংক্রান্ত বিদ্যা।”
দুই পর্ব বিশিষ্ট আর্টিকেলটির দ্বিতীয় পর্বে আলোচিত বক্তব্যের মাধ্যমে, ভাষা অর্জন সংক্রান্ত বিষয়ে, আপনার ধারণা বেশ পরিষ্কারভাবে বোধগম্য হয়েছে বলে প্রত্যাশা করি।
Featured Image:Cognifit.com