এখন বর্ষা মৌসুম। ক্ষণে ক্ষণেই আকাশ মেঘাচ্ছন্ন হচ্ছে আর যখন তখন বৃষ্টি নামছে। এবারের বর্ষার সাথে বজ্রপাতের হারও বেড়েছে কয়েকগুণ। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের এক গবেষণা মতে, বিগত আট বছরে বজ্রপাতের ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছে প্রায় ১৮,০০ এর অধিক মানুষ। এর মধ্যে ২০১২ সালে মারা গেছে সর্বাধিক, ৩০১ জন! ঝড় সতর্কীকরণ কেন্দ্রের আবহাওয়াবিদ মোঃ আব্দুর রহমান খান গণমাধ্যমের এক সাক্ষাৎকারে বলেন, “এপ্রিল ও মে মাসে সবচেয়ে বেশি কালবৈশাখী হয়ে থাকে। আমাদের দেশে এই দুই মাসে ঝড়, বজ্রপাত ও বৃষ্টি বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। এখন ঝড়, বৃষ্টি, শিলাবৃষ্টি এবং বজ্রপাত হবে।”

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের প্রধান ডক্টর এম এ ফারুক বলেন, “এ বছরের জুন, জুলাই ও আগস্টের তাপমাত্রার পরিমাণটা অন্যান্য বছরের তুলনায় অনেক বেশি হবে। এই তাপমাত্রার সঙ্গে বজ্রপাত বৃদ্ধির একটি গভীর সম্পর্ক রয়েছে। এ বছরে বজ্রপাতের সংখ্যা, বজ্রপাতের ফ্রিকোয়েন্সি, ইনটেনসিটি – সবকিছুই বাড়বে।”
সুতরাং পূর্বের যেকোনো সময়ের চেয়ে এবছর বজ্রপাতের সময় বেশি সর্তকতা অবলম্বন করা জরুরী। এই নিবন্ধে বিস্তারিতভাবে জানাবো বজ্রপাতের সময় কী কী সর্তকতা অবলম্বন করতে হবে।
চলুন, তার আগে খুব সংক্ষেপে জেনে নিই, বজ্রপাত কেন হয়?
আর্দ্র ও উত্তপ্ত আবহাওয়ায় বায়ু যখন দ্রুতগতিতে ঠান্ডা হয় তখন বাতাসের জলীয় বাষ্পে বজ্রমেঘের সৃষ্টি হয়। বজ্রমেঘের মধ্যে বাতাসের দ্রুতগতির আলোড়নের ফলে জলীয়বাষ্পে একই সময়ে একই সাথে শিশির বিন্দু, বৃষ্টিকণা ও তুষারকণার সৃষ্টি হয়। এই বৃষ্টিকণা ও তুষারকণার দ্রুত সংঘর্ষে স্থির বিদ্যুতের সৃষ্টি হয়। তবে ঘটনাটি যেহেতু বিশাল মেঘমালার মধ্যে ঘটে, তাই এর ফ্রিকোয়েন্সি, পরিমাণ এবং সংঘর্ষে সৃষ্ট শব্দের পরিমাণও অনেক বেশি হয়। এই বিদ্যুৎ প্রায় ৩০ হাজার ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড তাপ উৎপন্ন করে। তাই এর ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণও এত বেশি হয়।

জলবায়ু এবং আবহাওয়া পরিবর্তনের কারণে বজ্রপাতের শক্তি পূর্বের যেকো্নো সময়ের তুলনায় এখন অনেক বেড়েছে। আগে যেখানে বজ্র সংঘর্ষে ২ হাজার ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড তাপ উৎপন্ন হতো, এখন সেখানে উৎপন্ন হয় ৩০ হাজার ডিগ্রী! স্থির বিদ্যুতের পরিমাণ আগে যা ছিল ৫০ কিলো ভোল্ট, তা এখন ৩৫০ কিলো ভোল্ট শক্তি নিয়ে পৃথিবীতে আছড়ে পড়ছে।
বজ্রপাতের ক্ষয়ক্ষতি থেকে বাঁচতে করণীয়
১. খোলা এবং উঁচু জায়গা থেকে দ্রুত সরে যাওয়া
বজ্রপাতের সময় খোলা এবং উঁচু কোনো জায়গায় অবস্থান করবেন না। কেননা বজ্রপাতের সময় আপনি খোলা জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকলে বজ্রের বিদ্যুৎ আপনাকেই স্পর্শ করবে। আবার এমন কোনো উঁচু জায়গায় দাঁড়াবেন না যেখানে আপনিই সবচেয়ে উঁচু। যেমন বজ্রবৃষ্টির সময় কোনোভাবেই ছাদে বৃষ্টিতে ভেজা যাবে না।

সুতরাং বজ্রপাতের সময় খোলা মাঠ, কৃষিক্ষেত বা দালানকোঠার ছাদ থেকে দ্রুত সরে যান এবং কংক্রিট নির্মিত পাকা বাড়িতে আশ্রয় নিন।
২. ধাতব বস্তু থেকে দূরে থাকুন
কৃষিক্ষেতে কাজ করার সময় কৃষকরা ভারী ধাতব যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে থাকেন। এই ধাতব বস্তু বজ্রের বিদ্যুৎকে আকর্ষণ করে। একইভাবে ঘরের জানালা বা অন্যান্য ধাতব বস্তু বজ্রের বিদ্যুৎকে আকর্ষণ করে। সুতরাং বজ্রপাতের সময় কোনো ধাতব যন্ত্রপাতি, ঘরের জানালা অথবা ধাতব কোনো কিছু স্পর্শ করা থেকে বিরত থাকুন।
৩. বিদ্যুৎ চালিত যন্ত্র ব্যবহার থেকে বিরত থাকুন
বজ্রপাতের সময় বিদ্যুৎ চালিত যেকোনো যন্ত্র ব্যবহার থেকে বিরত থাকুন। যেমন কম্পিউটার, টেলিভিশন, রেডিও, মোবাইল ফোন, ওয়াইফাই রাউটার, ইলেকট্রিক কেটলি, ফ্যান এবং অন্যান্য সকল ইলেকট্রিক যন্ত্রপাতি। এমনকি বজ্রপাতের সময় ফ্রিজ এবং রেফ্রিজারেটরের বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিন।

এইসব বিদ্যুৎ চালিত যন্ত্রপাতি বজ্রের বিদ্যুৎকে আকর্ষণ করে। আপনি বহুতল ভবনের মধ্যে সুরক্ষিত থাকলেও এসব যন্ত্রপাতি বজ্রপাতে নষ্ট হয়ে যেতে পারে এবং বজ্রপাতের সময় এইসব যন্ত্রপাতি ব্যবহার করলে আপনিও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারেন।
৪. বিদ্যুতের খুঁটি এবং উঁচু গাছ থেকে দূরে থাকুন
বজ্রের বিদ্যুৎ, বিদ্যুতের খুঁটি এবং উঁচু গাছকেও আক্রান্ত করে। সুতরাং বজ্রপাতের সময় নিরাপদ ভেবে কোনো উঁচু গাছের নিচে আশ্রয় নেওয়া যাবে না। কেননা উঁচু গাছ এবং বিদ্যুতের খুঁটিতে বজ্রপাত হওয়ার সম্ভাবনা খুব বেশি থাকে।
৫. পানি থেকে দূরে থাকুন
পানি খুব ভালো বিদ্যুৎ পরিবাহী। তাই বজ্রপাতের সময় পানি থেকে যতটা সম্ভব দূরে থাকুন। যেমন বজ্রবৃষ্টির সময় পুকুরে গোসল করা বা বাথরুমে বাথট্যাব বা ঝর্ণায় গোসল করা যাবে না। এমনকি বজ্রপাতের সময় শরীর ভেজা রাখা উচিত নয়। এতে কাছাকাছি কোথাও বজ্রপাত হলে বিদ্যুৎস্পর্শ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে, যা আপনার শরীরের মারাত্মক ক্ষতি করতে পারে।

৬. গাড়ির ভেতরে থাকলে যা করবেন
বজ্রপাতের সময় আপনি যদি কোনো গাড়ির ভেতরে অবস্থান করেন তবে চেষ্টা করুন গাড়িটি কোন ভবনের নিচে বা কংক্রিটের ছাউনির নিচে নিয়ে যেতে। যদি তা সম্ভব নাও হয় তাহলে কোনোভাবেই গাড়িটি চালু রাখা যাবে না। এমনকি গাড়ির কোন ধাতব অংশ ধরে থাকা যাবে না। জানালা দিয়ে বাইরে তাকানো, এমনকি জানালার কাচ স্পর্শ করা যাবে না।
৭. এক জায়গায় অনেক মানুষ থাকবেন না
সাধারণত বৃষ্টির সময় পরিবারের সবাই একত্রিত হয়ে গল্প করে, আড্ডা দেয়। কিন্তু যদি বজ্রসহ বৃষ্টিপাত হয় তাহলে এমন একত্রে থাকা যাবে না। কংক্রিটের ছাদের নিচে হলেও বজ্রপাতের সময় চেষ্টা করুন পরিবারের সব মানুষ বিভিন্ন ঘরে অবস্থান করতে। খোলা জায়গায় থাকলে একই ছাতার নিচে অনেক মানুষ অবস্থান করবেন না। পরস্পরের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি করুন এবং সম্ভব হলে পরস্পরের মধ্যে অন্তত ৫০ থেকে ১০০ ফুটের দূরত্ব বজায় রাখুন।

৮. খালি পায়ে বা আলগা শরীরে থাকবেন না
বজ্রপাতের সময় খালি পায়ে বা আলগা শরীরে ভূমি স্পর্শ করবেন না। ঘরের মধ্যে অবস্থান করলেও পায়ে প্লাস্টিক বা রাবারের জুতা পরুন। শরীরে জামা পরুন।
৯. বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হওয়ার পর তাৎক্ষণিক করণীয়
আপনার উপর বা আপনার কাছাকাছি বজ্রপাতের সম্ভাবনা থাকলে কয়েক মুহূর্ত আগেই তা অনুভব করা যায়। যেমন শরীরে বিদ্যুৎ অনুভব করা, শরীর শিরশির করে কাঁপা এবং বিদ্যুতের প্রভাবে আপনার চুল খাড়া হয়ে যাওয়া। এইসব লক্ষণ বুঝতে পারলে খুব দ্রুত কানে আঙ্গুল দিয়ে বসে পড়ুন। তবে কোনক্রমেই মাটিতে শুয়ে পড়বেন না। তাতে বিদ্যুৎস্পর্শ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

১০. বাড়ি, অফিস বা স্থাপনা নিরাপদ করুন
বাড়ি, অফিস বা স্থাপনা নির্মাণের সময় দক্ষ ইঞ্জিনিয়ারের পরামর্শ নিয়ে বাড়িতে অবশ্যই আর্থ-ইন সংযুক্ত রড স্থাপন করুন এবং বজ্রপাত থেকে নিরাপদ থাকতে প্রয়োজনীয় পূর্বপ্রস্তুতি দিন।
বজ্রপাতে কেউ আহত হলে প্রাথমিক চিকিৎসা
কেউ বজ্রপাতে আহত হলে বা বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হলে যেসব চিকিৎসা দেওয়া হয়, ঠিক তেমন প্রাথমিক চিকিৎসা দিন। সবার আগে আহত ব্যক্তির হৃদস্পন্দন এবং শ্বাস-প্রশ্বাস ফিরিয়ে আনার এবং স্বাভাবিক করার চেষ্টা করুন। তারপর যত দ্রুত সম্ভব তাকে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে বা হাসপাতালে নিন। বজ্রপাত থেকে নিজে নিরাপদ থাকুন, অন্যকেও নিরাপদ রাখুন।