কর্মজীবন ও ব্যক্তিগত জীবনের মাঝে ভারসাম্য রক্ষা করা জরুরী একটা ব্যাপার। অনেকেই সারাজীবন কেবল চিন্তাই করেন, কীভাবে তিনি এই দুটো ব্যাপার পুরোপুরিভাবে উপভোগ করবেন। কাজে ব্যস্ত হয়ে গেলে নিজেকে সময় দেওয়া হয় না, আবার সময় অপচয় করার মতো মানুষও কম নেই। তাই চলুন জেনে নিই, কীভাবে কাজ এবং জীবনের মাঝে ভারসাম্য রক্ষা করবেন।
কাজ ও জীবনের ভারসাম্য বলতে কী বোঝায়?
কাজ ও জীবনের মাঝে ভারসাম্য তৈরি করার অর্থ হলো, কতটুকু সময় আপনি যথাক্রমে আপনার কাজ এবং ব্যক্তিগত জীবনে ব্যয় করেছেন। ভারসাম্য তৈরির উদ্দেশ্য হলো, একজন ব্যক্তি যাতে নিজেকে যথেষ্ট সময় দিতে পারে। আবার তার পাশাপাশি কর্মজীবনও যেন তাৎপর্যপূর্ণ হয়। এই পুরো সময় জুড়ে হীনমন্যতা, চাপ ও প্রতিকূল পরিবেশকে মোকাবিলা করে এগিয়ে যাওয়াই ভারসাম্য তৈরির ইতিবাচক দিক।
Source: assuresoftware.com
কিন্তু বাস্তবে কয়জন মানুষ প্রতিকূল পরিস্থিতি এবং নিজের সঙ্গে লড়াই করে টিকে যেতে পারে? নিজের উপর অবিচল বিশ্বাস টিকিয়ে রেখে সামনের দিকে পথ চলতে পারলেই সফলতার দেখা পাওয়া যায়। সেই সঙ্গে সফলতা বজায় রেখে সুন্দর একটি জীবনযাপন করা সম্ভব। ভারসাম্যের একটি ভালো উদাহরণ হতে পারে, কাজের ফাঁকে আপনার প্রিয় মানুষটির একবার খোঁজ নিতে পারা।
কাজ ও জীবনের সবকিছু একীভূত করা বলতে কী বোঝায়?
প্রযুক্তি যত এগিয়ে যাচ্ছে, আমরা হয়তো তত নিজেদের গুটিয়ে নিচ্ছি। শুধুমাত্র নিজেকে নিয়ে কিংবা কাজ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লে, সেটা ভারসাম্য তৈরির পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়াবে। প্রতিযোগীতার এই যুগে সামনে এগিয়ে যেতে হলে আরেকজনের চেয়ে বেশি কাজ করতে হয়। তাই নিজেকে কিংবা পরিবারকে সময় দেওয়া কষ্টসাধ্য মনে হতে পারে।
Source: adigaskell.org
সমাধান হিসেবে অনেকেই কাজ থেকে ফিরে এসে, কাজের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ রাখেন; এই চিন্তা করে যে, এখন আমি শুধু নিজেকেই সময় দেবো। কিন্তু কিছু দায়িত্ব থাকে যেগুলোর ব্যাপারে সবসময় আপনাকে সজাগ ও তথ্য সমৃদ্ধ থাকতে হয়। তাই সবচেয়ে ভালো উপায় হতে পারে, যদি কাজ এবং ব্যক্তিগত জীবনের ব্যাপারগুলো একীভূত করে নেওয়া যায়। বাসার কিছু কাজ কর্মক্ষেত্রে করতে পারেন, আবার কিছু কাজ সম্পাদন করে নিতে পারেন বাড়িতে বসেই।
Source: thehappyquotient.com
এভাবে অনেকগুলো ছোট-ছোট দায়িত্ব ভাগ করে নিতে পারেন। যেমন: অফিসে যাওয়ার পথে আপনার বাচ্চাকে বিদ্যালয়ে নিয়ে গেলে একটা দায়িত্ব পালন করা হয়। আবার বাসায় বসে অবসর সময়ে, জমানো মেইলগুলো পড়ে নিতে পারেন।
এভাবে কী লাভ হয়?
কাজ এবং নিজের ব্যক্তিগত চাহিদাগুলোর জন্যও সমান সময় ব্যয় করার সুযোগ থাকে, যদি সবকিছু একীভূত করতে পারেন। একটি কাজ করতে গিয়ে আরেকটি বাদ দেওয়ারও সম্ভাবনা এবং প্রয়োজন কমে যায়। এছাড়াও আরো কিছু সুবিধা হলো-
১. বাস্তবসম্মত
কাজকে ব্যক্তিগত জীবন থেকে আলাদা করে দিতে গেলে, কেবল একটি দিকেই মনোযোগ দিতে পারবেন। আর বাস্তবে এটি করতে গেলে আপনাকে হিমশিম খেতে হবে এবং বিভিন্ন সমস্যায় পড়তে হবে। আমাদের পুরো জীবনব্যবস্থাটাই এমন হয়ে গিয়েছে যে, আপনি চাইলেই যোগাযোগ বন্ধ রাখতে পারবেন না। তাই পদ্ধতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক না হয়ে, পদ্ধতিকেই নিজের অনুকূলে ব্যবহার করুন।
২. বৈচিত্র্য
সুখীভাবে বেঁচে থাকতে হলে জীবনে বৈচিত্র্য নিয়ে আসতে হয়। কাজকে জীবন থেকে আলাদা করে কখনোই বৈচিত্র্যের দেখা পাওয়া যায় না। আপাত দৃষ্টিতে মনে হতে পারে, কাজ শেষ করে আপনি পরিবারকে সময় দেবেন কিংবা পরিবারের সঙ্গে সময় কাটিয়ে তারপর কাজ করবেন।
Source: reed.co.uk
কিন্তু এটি একঘেয়ে, অফিসের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে থাকবেন, আর চিন্তা করবেন কখন বের হতে পারবেন। এতে আপনার সময় কাটতেই চাইবে না। আর আপনি যদি কাজ ভালবাসেন, তখন ভাববেন কখন ছুটি শেষ করে কাজে ফিরবেন। কিন্তু কিছু কাজ যদি অফিস থেকে বাড়িতে নিয়ে যান, তবে কাজ এবং পরিবারকে সময় দেওয়া দুটোই হবে।
৩. মান বৃদ্ধি
মানসম্মত কাজ এবং সাধারণ কাজের মধ্যে যেমনি পার্থক্য আছে। তেমনি মানসম্মত সময় কাটানো এবং কোনো রকমে জীবন পার করে দেওয়ার মাঝেও পার্থক্য রয়েছে। তাই আপনার সকাল নয়টা থেকে বিকাল পাঁচটা সময়টিতেই কর্মক্ষেত্রের ও পারিবারিক উভয় কাজ ভারসাম্যপূর্ণভাবে সম্পাদন করতে পারেন।
Source: glossycover.com
এটি হতে পারে বাচ্চাদেরকে বিদ্যালয়ে আনা-নেওয়ার মাধ্যমে, কাজের এক ফাঁকে বাজার কিনে এনে, বাসায় অবসরে অফিসের ছোট কোনো কাজ শেষ করার মাধ্যমে। এভাবে আপনার অফিসের কাজগুলোও শেষ করতে পারবেন, আবার নিজের জন্যও সময় বের করতে পারবেন।
কাজ আর জীবনকে একীভূত করবেন কীভাবে?
কাজ ও জীবনকে একীভূত করা বেশ কঠিন। তারপরও কিছু কৌশল ও দিকনির্দেশনা পালন করলে, সহজেই জীবন ও কাজকে একীভূত করতে সক্ষম হবেন। চলুন বিষয়গুলো জেনে নিই।
১. সুবিধা মতো সময় নির্বাচন
আপনার জন্য সুবিধা হয় এরকম সময় নির্বাচন করে, ব্যাপারটি প্রতিষ্ঠানকে জানাতে পারেন। বহু প্রতিষ্ঠানই এরকম কাজের সুযোগ দিয়ে থাকে। তাই খোঁজ নিন, প্রতিষ্ঠানে যদি নিজের সময় নির্বাচনের সুযোগ থাকে, তবে আবেদন করুন।
Source: adigaskell.org
আর যদি প্রতিষ্ঠানে এরকম কিছুর প্রচলন না থাকে, তবে উচ্চপদস্থদের থেকে পরামর্শ নিতে পারেন। হয়তো তারা আপনার জন্য কোনো উপায় বের করে দিতে পাররেন।
২. নিজের প্রয়োজনগুলো খুঁজে বের করুন
সবার জীবনের উদ্দেশ্য ও চাহিদা এক নয়। ভিন্ন পরিবেশে এবং সুযোগ-সুবিধার ভিন্নতা অনুযায়ী প্রত্যেকের চাহিদাও সাধারণত ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে। তাই নিজের জীবনের উদ্দেশ্য ও চাহিদাগুলো খুঁজে বের করুন। এগুলো জানা থাকলে সহজেই কাজ আর জীবনের মধ্যে ভারসাম্য তৈরি করতে পারবেন। আর চাহিদা জানা থাকলে, সেগুলোকে একীভূত করতেও সুবিধা হবে।
৩. দিনলিপি তৈরি করুন
যখন আপনার জীবনের সব লক্ষ্য আর চাহিদাগুলো খুঁজে বের করে ফেলবেন। তারপর কাজ হলো, সবকিছুর একটা দিনলিপি তৈরি করা। আপনার দূরবর্তী লক্ষ্য ও কাছাকাছি লক্ষ্যগুলোকে পর্যায়ক্রমে গুরুত্ব অনুসারে সাজাতে পারেন।
Source: lifehacker.com
বিশেষ কোনো দিবস, অফিস থেকে ঘুরতে যাওয়ার সময়, বাচ্চাদের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগীতার মতো বিষয়গুলো নিয়ে তৈরি করুন আপনার দিনলিপি। আরও লক্ষ্য করুন, কোন সময়গুলোতে আপনি বেশি সচেতন ও কর্মময় থাকেন। আর কোন সময়গুলোতে অলসতা ভর করে। তাহলে গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো আর করতে অসুবিধা হবে না।
৪. মানের উপর জোর দিন
আপনি কত সময় অফিসে ব্যয় করছেন কিংবা পরিবারে কতটুকু সময় দিচ্ছেন; এটির চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, ব্যয় করা সময়গুলো কেমন প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়েেছ। অনেকেই অফিসে বসে সব ধরনের চিন্তা-ভাবনায় সময় অতিবাহিত করেন। আর প্রয়োজনের অতিরিক্ত সময়ও সেখানে ব্যয় করেন।
Source: perforce.com
কিন্তু তার এই কাজ মোটেও মানসম্মত নয়। পরিবারকে সময় দেওয়ার ক্ষেত্রেও এমনটি ঘটতে পারে।
৫. সঠিক কাজটি করুন
আপনার কাজ এবং জীবনকে একীভূত করার পর দেখুন, সব সুন্দরভাবে চলছে। পরিবারে, কর্মক্ষেত্রে, সমাজে আপনার গুরুত্বপূর্ণ অবদান তৈরি হচ্ছে। কিন্তু একটা বিষয় মাথায় রাখতে হবে, সব কাজই আপনি করতে হবে এমন কোনো নিয়ম নেই। যে কাজটা করে আপনি তৃপ্তি পান না, সেটি না করাই ভালো। শুধু মানুষ কী মনে করবে, এটি না চিন্তা করে, নিজের ভাবনাগুলোকে গুরুত্ব দিন।
Source: tweeterlinder.com
জীবনে সুখি হওয়াটাই আসল উদ্দেশ্য হওয়া উচিৎ। কাজ যদি মুখ্য বিষয় হয়ে দাঁড়ায়, তবে একটি সময়ে গিয়ে আপন মানুষগুলোকে হারিয়ে ফেলতে পারেন। তাই ভারসাম্য তৈরি করে, সবকিছু একীভূত করতে পারাটাই সফলতা।
Featured Images:tlnt.com