প্রকৃতির অপার সৌন্দর্যের মধ্যে পাখি অন্যতম একটি উপাদান। এই পৃথিবীতে আছে হাজার প্রকারের হাজার রঙের পাখি। আর এই পাখিদের নিয়ে যুগে যুগে মানুষের আগ্রহের কখনো কমতি ছিল না। আমরা সাধারণ মানুষ সহ অনেক কবি সাহিত্যিকদের অনেক
সৃষ্টিশীলতার মাঝেও পাখিদের খুঁজে পাওয়া যায়। কিন্তু দুঃখের বিষয় এই যে, প্রকৃতির এই অবিচ্ছেদ্য উপাদানটির কিছু প্রজাতি আজ বিলুপ্ত, আর কিছু প্রজাতি বিলুপ্তির পথে। এই বিলুপ্তির মুখ্য কারণ হিসেবে নগরায়নকে দায়ী করলে খুব বেশি ভুল হবে না। আর
সেই নগরায়নের অন্যতম উপদান হল বহুতল ভবন।
প্রশান্ত মহাসাগরের উত্তর উপকূলবর্তী আমেরিকার যে প্রদেশটি অবস্থিত তার নাম ক্যালিফোর্নিয়া। ক্যালিফোর্নিয়া বলতেই আমাদের ভাবনায় প্রথম যা আসে তা হল হলিউড, গোল্ডেন গেট, তথ্য প্রযুক্তির রাজধানী খ্যাত সিলিকন ভ্যালি আর বহুতল বিশিষ্ট অত্যাধুনিক দালানকোঠা। ক্যালিফোর্নিয়ার সমুদ্র উপকূলবর্তী অঞ্চলে প্রায় ৪০০ প্রজাতির পাখিদের বাস। এই অঞ্চলটিকে উত্তর প্রশান্ত মহাসাগর থেকে দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগর উপকূলবর্তী অঞ্চলে যাওয়ার ফ্লাইওয়ে বলা হয় পাখিদের জন্য।
বিশেষজ্ঞদের মতে, পাখিদের এই চলার পথে মৃত্যুফাঁদ হয়ে দাঁড়াচ্ছে কাঁচবেষ্টিত বহুতল ভবনগুলো। কারণ পাখির গতিপথে যদি কোন স্বচ্ছ অথবা প্রতিফলনশীল কাঁচ পড়ে তখন পাখি তার মুক্ত গতিপথ আর তার গতিপথের মাঝে বাধা স্বরূপ কাঁচ বেষ্টিত ভবনগুলোর পার্থক্য করতে পারে না। স্বচ্ছ কাঁচ থাকলে তার ভেতরের টবে লাগান ছোট গাছপালা, মানুষ দেখলে পাখি ভাবে সামনে কোনো বাধা নেই। আর প্রতিফলনশীল কাঁচের উপর যখন তার চারপাশের পরিবেশ প্রতফলিত হয় তখনো পাখি পার্থক্য করতে পারে না। যার ফলে পাখি কাঁচের উপর তার ভরবেগে আছড়ে পরে এবং মৃত্যু ঘটে।
আমেরিকান বার্ড কঞ্জারভেন্সি (এ বি সি) এর মতে, উত্তর আমেরিকায় যত পাখি মারা যায় তার ১ থেকে ৫ শতাংশের মৃত্যু এই সংঘর্ষজনিত। আর পুরো আমেরিকায় প্রতি বছর সংঘর্ষজনিত মৃত্যু ঘটে ৩৬৫ মিলিয়ন থেকে ১ বিলিয়ন পাখির, কানাডাতে যার সংখা ২৫ মিলিয়ন এর মত।
আবার শীত এবং বসন্তে যখন গায়ক পাখিদের আনাগোনা শুরু হয় তখন রাতে কাঁচ বেষ্টিত বহুতল ভবনগুলোর আলোকসজ্জায় আকৃষ্ট হয়ে পাখি সেদিকে ছুটে যায় এবং মৃত্যু ঘটে।
এই সমস্যা সমাধানে প্রথম যে শহরগুলো এগিয়ে আসে সেগুলো হলো,
১. স্যানফ্রান্সিস্কো – ২০১১ সালে
২. ওকল্যান্ড – ২০১৩ সালে
৩. সানিভেল – ২০১৪ সাল
কয়েক মাস গবেষণার পরে সিলিকন ভ্যালির রাজধানী হিসেবে পরিচিত স্যানহোসের ইনভায়রন্মেন্টাল সার্ভিসেস ডিপার্টমেন্ট (ই এস ডি ), স্যান্টা ক্ল্যারা ভ্যলী অডুবন সোসাইটি (এস সি ভি এ এস), সিয়েরা ক্লাব সম্মিলিতভাবে আমেরিকান বার্ড কঞ্জারভেন্সি (এ বি সি) এর নীতিমালা অনুসারে পাখিবান্ধব স্থাপনা নির্মাণের নীতিমালা প্রণয়ন করে।
আমেরিকান বার্ড কঞ্জারভেন্সি (এ বি সি) এর নীতিমালা নিম্নরূপ
১. এ বি সি এর একটি নিয়ন্ত্রিত পরীক্ষায় দেখা গেছে যে, কোনো স্থাপনার ভূমি থেকে ৪০ ফুট পর্যন্ত সম্মুখ ভাগে সবচেয়ে বেশি সংঘর্ষ হয়ে থাকে পাখির। এই সংঘর্ষ ৭০ ভাগ বা তার বেশি পর্যন্ত কমানো সম্ভব যদি স্থাপনার ৪০ ফুট পর্যন্ত কাঁচের বিন্যাস এ বি সি এর নীতিমালা অনুসারে রাখা হয়।
২. স্থাপনার বহির্ভাগে ৪০ ফুট পর্যন্ত এই নীতি অনুসরণ করার পর তার উপরের ৬০ ভাগ পর্যন্ত এই নীতি অনুসরণ করতে হবে।
৩. স্থাপনায় কোনো স্বচ্ছ চলাচলের পথ থাকতে পারবে না যাতে পাখিরা বুঝতে না পারে সামনে কোনো বাধা আছে।
৪. স্থাপনার বহির্ভাগের আলোকসজ্জা বেষ্টিত এবং দিক এমন হতে হবে যে, শীত ও বসন্তে গায়ক পাখিরা আকৃষ্ট না হয়।
৫. রাতের বেলা স্থাপনার ভেতরের আলোকসজ্জা বন্ধ রাখতে হবে যেন জানালা থেকে আলো বাইরে না যায়।
৬. স্থাপনার বাহিরেরে দৃশ্য যেন এমন হয় যাতে স্থাপনার কাঁচ বেষ্টিত ভাগে বাইরের প্রতিফলন কম হয় এবং পাখিদের বিভ্রম না হয়।
ইউএসফিস এন্ড ওয়াইল্ডলাইফ সার্ভিস ডিভিশন অব মাইগ্রেটরি বার্ড ম্যানেজমেন্ট এর প্রকাশিত একটি অনুচ্ছেদে স্থাপনার বহির্ভাগের কাঁচ বেষ্টিত ভাগে পাখির সংঘর্ষ প্রতিরোধে নিম্নরূপ ব্যবস্থাগুলো নেওয়া যায়
১. কাঁচে বিভিন্ন ধরনের ফিল্মের আবরণ দিয়ে
২. কাঁচ তৈরির উপাদানরূপে বালি ও বিভিন্ন বিগলক পদার্থের মিশ্রণ কাঁচের মধ্যে ব্যবহার করলে।
৩. পাখি অতি বেগুনী বর্ণালী দেখতে পায় বলে যে ধরনের কাঁচ অতি বেগুনী বর্ণালী প্রতিফলন করে এমন কাঁচ ব্যবহার করলে।
৪. স্বল্প খরচে কাঁচের জানালায় নেটিং করলে।
৫. স্থাপনায় অপ্রয়জনীয় আলোকসজ্জা ব্যবহার না করলে।
৬. শীত ও বসন্তে পাখির অভিপ্রয়ানের সময় রাতে স্থাপনার ভেতরের সৌন্দর্যবর্ধনকারী আলোকসজ্জা না করলে।
উপরোল্লিখিত নিতীমালা অনুসরণ করলে সংঘর্ষজনিত পাখি মৃত্যু তাৎপর্যপূর্ণ হারে হ্রাস পাবে বলে ধারণা করা হয়। সিলিকন ভ্যালিতে ইনটুইট, ফেসবুক, অ্যাপল, গুগলের মতো শীর্ষস্থানীয় কোম্পানিগুলো তাদের নতুন ক্যাম্পাস করার কথা ভাবছে যেখানে তারা তাদের স্থাপনাগুলো করবে পাখিবান্ধব স্থাপনার নীতিমালা অনুসারে এবং ছোট পরিসরে কৃত্রিম বনায়ন সহ পাখিদের জন্য ছোট ছোট বাসা বানানোর ব্যবস্থা করবে যাতে তাদের কর্মীরা প্রকৃতির সহচর্যে থেকে তাদের উদ্ভাবনী ক্ষমতাকে শাণিত করতে পারে। আরো উদ্যমী হয়ে উঠে, সাথে সাথে তারা পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় সবাইকে উদ্বুদ্ধ করতে পারে এবং পাখিদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে পারে। কারণ তারা আশাবাদী যে, এই তাদের পদক্ষেপ অন্যান্য শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠান সহ ব্যক্তিগত পর্যায়ে মানুষকে অনুপ্রাণিত করবে এমন পাখিবান্ধব স্থাপনা নির্মাণে।