জন্মের পর মানুষ আপনা থেকেই সবকিছু শেখে না। একদম শিশুকালে পিতা-মাতার সাহায্য নিয়ে মানুষ বেড়ে ওঠে। তারপর স্কুল-কলেজের শিক্ষকদের সাহায্য নিয়ে শিক্ষিত হয়ে ওঠে। ঠিক একইভাবে কর্মক্ষেত্রেও সফল হতে এমন অভিভাবক, শিক্ষক বা পরামর্শকের প্রয়োজন আছে।
তবে শিশুকালের অভিভাবক বা শিক্ষাজীবনের শিক্ষক আর কর্মজীবনের পরামর্শকের মধ্যে বিস্তর তফাৎ। অভিভাবক এবং শিক্ষক হাতে-কলমে শিখিয়ে দেন, কিন্তু পরামর্শক শুধু যথার্থ দিকনির্দেশনা দিয়ে থাকেন। বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়ে সেই দিকনির্দেশনা অনুসরণ করে সাফল্যের সোপানে আরোহন করতে হয় আমাদের। পরামর্শক বা মেন্টর ছাড়া শুধু নিজে কর্মক্ষেত্রে সফল হওয়া যায় না।
আমি এই নিবন্ধে আরো অনেকগুলো সুনির্দিষ্ট বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব। আমার বিশ্বাস এই আলোচনা শেষে আপনি যথাযথভাবে অনুধাবন করতে পারবেন কর্মজীবনে উন্নতি করতে কেন একজন যথার্থ ও যোগ্য মেন্টর তথা পরামর্শক খুঁজে বের করতে হয়।
১. তাদের দক্ষতার পাল্লা অনেক ভারী
আপনি যে কাজটি করছেন বা করতে চলেছেন, সে ব্যাপারে আপনার মেন্টর বা পরামর্শক অনেক বেশি জ্ঞান রাখেন। আপনার কর্পোরেট জগতে সে হয়তো আপনার চেয়ে আরো কয়েক ধাপ এগিয়ে আছেন, অথবা আপনার কাজের ক্ষেত্রে তিনি আরও বহু বছর ধরে কাজ করছেন। তারা কর্মক্ষেত্রে আপনার দায়িত্বের বাহ্যিক ব্যাপারের সাথে সাথে অন্তর্নিহিত গভীর ব্যপারগুলোও খুব ভালোভাবে জানেন। তাই ব্যবসা বা চাকরি যে ক্ষেত্রেই হোক সাফল্যের জন্য একজন মেন্টর আপনার প্রয়োজন।
যেমন একজন অভিজ্ঞ শিক্ষকদের কাছ থেকে সদ্য শিক্ষকতায় নাম লেখানো একজন শিক্ষকের অনেক কিছু শেখার আছে। নতুন এবং অভিজ্ঞ দুই শিক্ষকই হয়ত জানেন কিভাবে ক্লাসের সময় বাড়াতে হয়। কিন্তু অভিজ্ঞ শিক্ষক শ্রেণিকক্ষের সংস্কৃতি এবং মহল্লার সংস্কৃতির তফাৎও জানেন, যা তরুণ শিক্ষক জানেন না।
২. তারা সাফল্যের জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতা এবং জ্ঞানের সঠিক দিকনির্দেশনা দিতে পারেন
যেকোনো কর্মক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন অঞ্চলের ভিন্ন ভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং ভিন্ন ভিন্ন বিষয়ের স্নাতকরা একত্রে কাজ করতে আসেন। সুতরাং তাদের প্রত্যেকের যোগ্যতা থাকা শর্তেও পরস্পরের শিক্ষার মধ্যে এবং অনুধাবন ক্ষমতার মধ্যে বিশাল পার্থক্য থাকে। একজন দক্ষ মেন্টর আপনাকে এমন নির্দেশনা দিয়ে থাকেন, যা আপনাকে যেকোনো পরিবেশে যেকোনো অবস্থায় নিজের দুর্বলতা কাটিয়ে মানিয়ে নেওয়ার শক্তি-সামর্থ্য যোগায়।
যেমন ধরুন, কোনো প্রতিষ্ঠানের নতুন কর্মীদের প্রাথমিক ভাবে হয়তো একই বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কয়েকটি দলে ভাগ করে তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে এবং যেই পরিবেশে তাদের প্রশিক্ষণ দেয়া হলো এই পরিবেশ ছেড়ে অন্য ভিন্ন একটি পরিবেশে তাদের কাজ করতে যেতে হবে। একজন মেন্টর এক্ষেত্রে এমন নির্দেশনা ও পরামর্শ দিয়ে থাকেন যার আলোকে একজন মানুষ নিজেকে সব সংস্কৃতির উপযুক্ত করে গড়ে তুলতে পারেন। তাতে ঐ ব্যক্তি যে কোনো পরিবেশে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারেন।
৩. তারা গঠনমূলক প্রতিক্রিয়া দিয়ে থাকেন
আপনার মেন্টর আপনার ভুলগুলো পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে ধরিয়ে দিবে। অবশ্য ভুল সব মানুষই ধরিয়ে দেয়। কেননা অন্যের ভুল ধরা মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। কিন্তু অন্য সাধারণ মানুষ আর একজন মেন্টরের মধ্যে তফাৎ হলো সাধারণ মানুষ আপনাকে শুধু ভুলটা ধরিয়ে দিবে, কিন্তু একজন মেন্টর এই ভুল থেকে উত্তরণের পথ আপনাকে বলে দিবে।
কেউই হেরে যেতে বা লজ্জা পেতে চায় না। কিন্তু আমরা যখনই একা একা পথ চলার চেষ্টা করি, অচেনা পথে পাড়ি জমাতে আমাদের ভুল হবেই। কিন্তু যদি আমরা সেই ভুল থেকে শিখি, তাহলেই ভুলগুলো আমাদের জীবনের জন্য মূল্যবান হয়ে উঠবে। আর এই ভুল থেকে শিক্ষা নেওয়ার যথার্থ দিকনির্দেশনা করি একজন মেন্টর।
ধরুন, আপনার উপর ন্যস্ত কোনো দায়িত্ব আপনি প্রথমবার সম্পন্ন করেছেন। কিন্তু আপনার বস আপনার কাজে সন্তুষ্ট হতে পারেননি, তারা আপনার কথায় আস্থা খুঁজে পায়নি। একজন মেন্টর আপনাকে সেইসব কৌশল শেখাবে যা ব্যবহার করে আপনি বসের এই আস্থা অর্জন করতে সমর্থ হবেন এবং আপনাকে এই কাজের ভুলগুলো হাতে কলমে ধরিয়ে দিবে যেন এই ভুল আপনি দ্বিতীয়বার না করেন।
৪. তাদের দৃষ্টিভঙ্গি অনেক বড়
যেহেতু আপনার মেন্টর আপনার কর্মক্ষেত্রে দীর্ঘদিন ধরে আছেন, কাজেই তিনি আপনার প্রতিষ্ঠান বা কর্মক্ষেত্রে সম্বন্ধে অনেক বেশি জানেন। আপনার কর্মক্ষেত্র সম্বন্ধে তাদের বৃহৎ দৃষ্টিভঙ্গি আছে। তারা নানান রকম ভুল এবং আপোসের মধ্য দিয়ে আজকের জায়গাতে পৌঁছেছে। সুতরাং তারা অন্যদের ভুল করা থেকে রক্ষা করতে পারেন।
আপনি দেখবেন কর্মক্ষেত্রে নানান রকম রাজনীতি চলতে থাকে। সহকর্মীরা অনেক ক্ষেত্রে রাগান্বিত, পরস্পরের প্রতি বিরক্ত এবং নানা দল-উপদলে বিভক্ত। এই পরিবেশে আপনার হয়তো অসহায় লাগতে পারে। কিন্তু একজন মেন্টর আপনাকে জানাবে সেই সব গোপন রহস্য যা অন্য কেউ আপনাকে বলবে না! এই বিক্ষিপ্ত কর্মীদের ব্যাপারে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ যেকোনো সময় কোনো নেতিবাচক সিদ্ধান্ত নিতে পারেন, যেটা আপনি একজন মেন্টর থাকার কারণে আগে থেকে জানতে পারবেন। তখন সহকর্মীদের প্রতি হিংসাত্মক চোখে না তাকিয়ে আপনি বরং সহমর্মী হয়ে তাদের সাথে চলবেন, যা আপনার ক্যারিয়ার এগিয়ে নিতে অনেক বেশি সহায়ক হবে।
অন্যদের মতো নিরাপত্তাহীনতা ও অনিশ্চয়তার মধ্যে ডুবে যাওয়ার পরিবর্তে আপনি নির্দেশনাগুলো অনুসরণ করুন। একজন মেন্টর আপনাকে এমন পরামর্শ দিবে, যা আপনার কর্ম জীবনে পথ চলতে এবং সাফল্য বয়ে আনতে সহায়ক হবে।