২০১৫ সালে ফিলিপাইনের এক গৃহহীন বালক ডেনিয়েল ক্যাবেরার একটি ছবি ভাইরাল হয়। ছবিতে দেখা যায় একটি রেস্টুরেন্টের সামনে ছোট্ট একটি কাঠের চ তার উপর পড়াশোনা করছে ক্যাবেরা। তার এই নিদারুণ দৃশ্য দেখে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সাহায্য আসতে শুরু করে। বলা যায় এই একটি ভাইরাল ছবির বদৌলতে তার অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো হয়ে যায়।
Photo: Govloop
ছবি ভাইরাল হওয়ার ঘটনা হয়তো তার জীবন বদলে দেয়, কিন্তু তাতে কি লক্ষ মানুষের সমস্যার সমাধান হয়েছে? নিশ্চয়ই না। নয় বছর বয়সী ক্যাবেরার এই ছবিটি তার ব্যক্তিগত করুণ জীবন উপস্থাপন করার সাথে সাথে এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলের বিপুলসংখ্যক মানুষের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি শক্তির বাইরে থাকার বাস্তব চিত্রও উপস্থাপন করে। বলার অপেক্ষা রাখে না, ভাইরাল ছবিটি লক্ষ মানুষের মনে কেবল ক্যাবেরার জন্য করুণা সৃষ্টি করলেও লক্ষ মানুষের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সমস্যা নিয়ে ভাবায় না।
এ অঞ্চলের উদ্যোক্তাদের বিপুল সংখ্যক মানুষের এই বিদ্যুৎ ও জ্বালানী সমস্যা নিয়ে গুরুত্বের সাথে ভাবতে হবে। কেননা এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলে ২০১৯ সালে এসেও প্রায় ৪০০ মিলিয়নের বেশি মানুষ বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সুবিধার বাইরে রয়েছে। উদ্যোক্তারা আগ্রহী হলে এ অঞ্চলে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে বিপ্লব ঘটানোর সুযোগ রয়েছে। বিদ্যুৎ সুবিধার বাইরে থাকা এই বিপুল সংখ্যক মানুষ নিশ্চয়ই এ অঞ্চলের উদ্যোক্তাদের গুরুত্বপূর্ণ ভোক্তা। তাদের জীবনমানের উন্নয়ন, সুলভে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সুবিধা সরবরাহ, শিক্ষা এবং সচেতনতায় বিনিয়োগ করে উদ্যোক্তারা যেমন নিজেরা লাভবান হতে পারে, তেমনি এই অঞ্চলের লক্ষ মানুষের সমস্যার সমাধান হতে পারে। সুযোগ সুবিধার বিবেচনায় পিরামিডের নিচে থাকা মানুষগুলো আরো একটু স্বস্তির জীবন-যাপন করতে পারে।
জীবন সংগ্রাম
ক্যাবেরার গল্পটা বেশ করুণ। এই ছবি ভাইরাল হওয়ার কিছুদিন আগে এক অগ্নি দুর্ঘটনায় তার ঘর বাড়ি পুড়ে ছাই হয়ে যায়। তার মা স্থানীয় একটি রেস্টুরেন্টে কাজ করে। আর এই রেস্টুরেন্টের সামনে ছোট্ট একটি কাঠের বেঞ্চে বসে রাস্তার হাল্কা আলোয় বই পড়ার চেষ্টা করে ক্যাবেরা। ক্যাবেরা এখানে সংকটের প্রতীক। বিদ্যুৎ এবং জ্বালানি সংকটের কারণে পড়াশোনার জন্য তার এমন করুণ পদক্ষেপ নিতে হয়েছিল। এদিকে বাড়ি ঘর আগুনে পুড়ে যাওয়ায় তার বসবাসের কোনো জায়গা ছিল না।
ফিলিপাইনের গৃহহীন বালক ডেনিয়েল ক্যাবেরা; Photo: Entrepreneur
ক্যাবেরার মতো এশিয়া-প্যাসিফিকের ৪০০ মিলিয়ন মানুষ যখন আলোর সংকটে আছে, তখন পৃথিবীর কোনো কোনো উন্নত শহর আলো দূষণে ডুবে গেছে। সেখানকার মানুষের কাছে এই গল্প রুপকথার মতো মনে হবে। অথচ এই রূপকথা পৃথিবীর লক্ষ লক্ষ মানুষের নিত্যদিনের বাস্তবতা।
বিদ্যুৎ সুবিধার বাইরে থাকা এই দরিদ্র মানুষেরা সাধারণত কেরোসিন তেলের বাতির উপর নির্ভর করে। কেরোসিনের ল্যাম্প রাতের অন্ধকার ঘোচাতে কিছুটা সহযোগিতা করলেও বিদ্যুতের অভাব তাতে কোনোভাবেই পূরণ হয় না। তাছাড়া কেরোসিনের এই বাতি অসংখ্য দুর্ঘটনার কারণ। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় কেরোসিন বাতির দুর্ঘটনায় আগুন লেগে লক্ষাধিক মানুষের মৃত্যু হয়েছে। বিভিন্ন সময় এই আগুন ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। আগুনে পুড়ে অসংখ্য মানুষ বিকলাঙ্গ হয়েছে। এমনকি কেরোসিনজনিত দুর্ঘটনা ত্বক, শ্বাসতন্ত্র এবং শরীরের কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রের ক্ষতিসাধন করে। এছাড়া গবেষণায় দেখা গেছে এক একটি বাড়ি থেকে প্রতিবছর ১৪০ কিলোগ্রাম কার্বন-ডাই-অক্সাইড নিঃসরণ হয়।
Photo: Smart Energy International
এখন ২০১৯ সাল, টমাস আলভা এডিসনের বৈদ্যুতিক বাতি আবিষ্কারের ১৪০ বছর পরের গল্প। এই সময়ের মধ্যে কেরোসিনের বাতি জাদুঘরে চলে যাওয়ার কথা ছিল। অথচ এখনো বিশ্বব্যাপী লক্ষ লক্ষ মানুষ বিদ্যুৎ সুবিধার বাইরে আছে এবং কেরোসিনের বাতিজনিত দুর্ঘটনায় জীবন দিচ্ছে।
কেন এই দীর্ঘ অপেক্ষা?
এখন স্বভাবতই প্রশ্ন আসে, কেন? কেন এই দীর্ঘ অপেক্ষা? সারা পৃথিবীতে ডিজিটাল প্রযুক্তি বিপ্লবের এই সময়ে এসেও কেন দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার মানুষ কেরোসিনের বাতির মতো আদিম এবং বিপদজনক আলোর উৎস নিয়ে জীবন ধারণ করে? আসলে মূল সমস্যা প্রযুক্তিগত নয়। কেননা এর অসংখ্য বিকল্প ইতিমধ্যে আবিষ্কৃত হয়েছে, যা সহজলভ্য এবং এই সব মানুষের ধারে কাছেই রয়েছে।
Photo: ACN Pacific
এর পেছনের মূল সমস্যা সচেতনতা এবং শিক্ষা। এ অঞ্চলের মানুষের মধ্যে শিক্ষার আলো না থাকায় তারা উপলব্ধি করতে পারে না যে, বিদ্যুৎ এবং জ্বালানি সমস্যার সমাধান হলেই তাদের জীবনমানের ব্যাপক পরিবর্তন হবে। এমনকি শুধুমাত্র শিক্ষার অভাবে নানা রকম সচেতনতা সৃষ্টি করেও তাদের উপলব্ধি করানো সম্ভব হচ্ছে না যে, তাদের এই পরিবর্তনটা প্রয়োজন। স্থানীয় মানুষজন ব্যাপকভাবে যখন সমস্যা সমাধানের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে তখনই কেবল সমস্যার সমাধান করা সম্ভব হয়।
এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো স্থানীয় মানুষকে শিক্ষিত করা। তাদের মধ্যে কেরোসিনের বাতিসহ এ জাতীয় জিনিস ব্যবহারের ঝুঁকি ও ক্ষতিকর দিক সম্বন্ধে সচেতনতা সৃষ্টি করা। আমরা যদি তাদের বোঝাতে সক্ষম হই, তাহলে নিশ্চয়ই এ অঞ্চলে একটা বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনা সম্ভব।
পণ্য নয়, সামাজিক গতিশীলতার প্রচার
এখন প্রশ্ন হলো কীভাবে উদ্যোক্তারা শক্তির অ্যাক্সেস এবং সামাজিক গতিশীলতা সম্পর্কিত বিষয়গুলোর কার্যকর দূত হিসেবে কাজ করতে পারে?
Photo: eLearning Industry
এর একটিই সমাধান: আলো, পানি, রান্না, এবং প্রকৃতপক্ষে বৈশ্বিক সৌর হোম সিস্টেমের মাধ্যমে সক্রিয় হতে পারে এমন সামাজিক গতিশীলতার উপর আমাদের মনোযোগ বাড়াতে হবে। নিজেদের পণ্যের প্রচার না করে এই বিষয়গুলোতে সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে।
কম খরচে বেশি আলো
অসচেতন জনগোষ্ঠীর মধ্যে সামাজিক গতিশীলতার বিষয়গুলো প্রতিষ্ঠা করতে হলে আপনাকে মুখে বলা বন্ধ করে, কাজে দেখাতে হবে। ধরা যাক, আপনি কোনো একটি পরিবার বা সংস্থাকে সোলার সিস্টেম দান করলেন। তাকে এই সহযোগিতা করার মধ্য দিয়ে বুঝিয়ে দিতে হবে এই পদ্ধতি তার জন্য কতটা কল্যাণকর। তিনি যখন প্রযুক্তি ব্যবহার করা শুরু করবেন, তখনই কেবল তাকে জানাতে হবে কীভাবে এই প্রযুক্তি তার দৈনন্দিন জীবনের অর্থ, সময় এবং শক্তি অপচয় রোধ করছে এবং জীবনমানের উন্নয়ন ঘটাচ্ছে।
Photo: MaRS Discovery District
এভাবে যদি পদক্ষেপ নেওয়া হয় তবে নিশ্চয়ই দক্ষিণ এশিয়ার আলো বঞ্চিত মানুষের মধ্যে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনা সম্ভব হবে। সাথে সাথে এ অঞ্চলের উদ্যোক্তারাও সমান লাভবান হবে।
Feature Image: Kazakhstan 2050