পূর্ণকালীন চাকরির চেয়ে কেন খন্ডকালীন চাকরি ভাল তা নিয়ে আমি ইতিপূর্বে একটি নিবন্ধ লিখেছি। এই নিবন্ধে এমন আরও কিছু কারণ নিয়ে আলোচনা করবো। কেউ কেউ আমার এ নিবন্ধ পড়ে ভাবতে পারেন আমি মানুষকে অলস হতে অনুপ্রাণিত করছি। কম কাজ করে প্রতিষ্ঠান বা দেশের সার্বিক কর্মতৎপরতা কমিয়ে আনার পরামর্শ দিচ্ছি। না, মোটেও তা নয়।
বর্তমান সময়ে বিজ্ঞান এতটা উন্নতি সাধন করেছে যে, উদ্ভাবিত নতুন নতুন প্রযুক্তি আমাদের শ্রমকে অনেকাংশে সহজ করে দিয়েছে। আগে একজন কৃষকের এক বিঘা জমি চাষ করতে সারাদিন সময় লেগে যেত, প্রযুক্তির কল্যাণে এখন সেই জমি মাত্র ২০ মিনিটেই চাষ করা সম্ভব হয়। আগে যেখানে কোনো অফিসে কর্মীদের উপস্থিতি হিসাব করার জন্য একজন আলাদা কর্মীর প্রয়োজন হত, এখন তা একটি ছোট্ট ডিভাইস করতে পারে। পূর্বে যে হিসেব করার জন্য কয়েক হাজার মানুষের প্রয়োজন হতো তা এখন একটি কম্পিউটার করতে পারে। তাহলে প্রযুক্তি বিপ্লবের এই সময়ে এসে কেন আমি কম কাজে বেশি উৎপাদন এবং রোজগারের সুযোগ গ্রহণ করবো না?
১. অনেক বেশি কর্মশক্তি পাবেন
কর্মঘন্টা কম হওয়ায় স্বাভাবিক স্বাস্থ্য পরিচর্যা এবং সময়মতো খাদ্যভ্যাস আপনার কর্মশক্তি বাড়িয়ে দিবে। অবশ্যই আপনি পূর্ণকালীন চাকরির চেয়ে খণ্ডকালীন চাকরিতে শরীরে অনেক বেশি কর্মশক্তি অনুভব করবেন। টানা কাজ করে ক্লান্ত হয়ে যাওয়ার বদলে দিনভর প্রফুল্ল মেজাজে কাজ করতে পারবেন। আপনি বিশ্রাম নেওয়ার জন্য যথেষ্ট সময় পাবেন, যা আপনার শরীর এবং মনকে সতেজ রাখবে। এমনকি দিনভর এই প্রফুল্ল ভাব পরবর্তী দিনের কাজের জন্য আপনাকে প্রস্তুত রাখবে।
২. অনেক বেশি শিখতে পারবেন
শুধুমাত্র কিছু সংখ্যক সৌভাগ্যবান পূর্ণকালীন চাকরিজীবী কাজের বাইরে অন্য কিছু নিয়ে ভাবার অবসর পান। আপনার ক্ষেত্রে এই সম্ভাব্যতা শূন্যের কাছাকাছি। সুতরাং আপনি যদি আপনার চাকরির প্রশিক্ষণ ও এ সম্পর্কিত জ্ঞানের বাইরে অন্য কিছু চর্চা করতে চান বা জানতে চান তাহলে নিজের মতো করে তার পেছনে সময় দিতে হবে। আর এটা সম্ভব একমাত্র খন্ডকালীন চাকরিতে।
মূল কাজের পাশাপাশি অনেক মানুষের বিভিন্ন রকম সৃজনশীল চর্চার অভ্যাস থাকে। আপনি পূর্ণকালীন চাকুরিজীবী হলে কাজের চাপে সৃজনশীল চর্চা করার সুযোগ পাবেন না। কিন্তু আপনি যদি খন্ডকালীন চাকরিজীবী হন তাহলে সৃজনশীল কাজের জন্য পর্যাপ্ত সময় পাবেন, যা আপনাকে অনেক নতুন কিছু শেখার সুযোগ করে দিবে।
আপনি যদি খণ্ডকালীন চাকরিজীবী অথবা নিজের প্রতিষ্ঠান পরিচালনাকারী হয়ে থাকেন তবে বাড়তি কাজ বা জানার জন্য যথেষ্ট সময় পাবেন, যা আপনার জীবনকে আরো বেশি সুন্দর, অর্থপূর্ণ এবং স্বাচ্ছন্দ্যময় করবে। আপনি আপনার সম্পূর্ণ সময়কে স্বাধীনভাবে নিজের মতো করে ব্যবহার করতে পারবেন।
৩. আপনি আরো বেশী সৃজনশীল হবেন
অনেক সফল মানুষ বলে থাকেন, পূর্ণকালীন চাকরি ছাড়ার পর তাদের সৃজনশীলতা অনেক বেড়ে গেছে, যা ব্যক্তিজীবনে তাদের আরো বেশি সফল করেছে।আগেই বলেছি খন্ডকালীন চাকরি আপনাকে পর্যাপ্ত সময় দিবে যা আপনি সৃজনশীল কাজে ব্যবহার করতে পারবেন। খন্ডকালীন কাজ বা নিজের কাজ আপনাকে সর্বোচ্চ সৃজনশীলতার স্বাধীনতা দিবে, যাতে আপনি পর্যায়ক্রমে নিজের কাজ এবং ব্যক্তিজীবনে কাঙ্ক্ষিত উন্নতি সাধন করতে পারবেন। পূর্ণকালীন চাকরিতে থেকে কোনোভাবেই যা সম্ভব না।
কেননা পূর্ণকালীন চাকরির সবচেয়ে বড় সমস্যা মানসিক চাপ, যা আপনার সৃজনশীলতাকে সমূলে ধ্বংস করে। সুতরাং সৃজনশীলতা বাড়ানোর জন্য আপনাকে খণ্ডকালীন চাকরি অথবা নিজের প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করতে হবে।
৪. জীবনের বৈচিত্র্য খুঁজে পাবেন
খন্ডকালীন চাকরিতে পূর্ণকালীন চাকরির মতো এমন কোনো নিয়ম নেই যে, আপনাকে সারা জীবন একই অফিসে, একই জায়গায়, একই কাজ করে যেতে হবে। পূর্ণকালীন চাকরির এমন নিয়ম মানুষকে একঘেয়ে, বিরক্ত এবং বিক্ষিপ্ত করে তোলে। খন্ডকালীন চাকরিতে আপনি চাইলে যেকোনো সময় আপনার কাজ পরিবর্তন করতে পারেন। এক্ষেত্রে কৌশলী হলে এমন চাকরি বেছে নিতে পারেন যা আপনি পৃথিবীর যে কোন প্রান্তে বসে পরিচালনা করতে পারবেন। স্বভাবতই এইসব কাজে উচ্চ বেতন দেয়া হয়ে থাকে।
পূর্ণকালীন চাকরিতে কর্পোরেট পলিটিক্স, অফিসের পরিবেশ এবং আরো অনেক কিছু আমলে নিয়ে আপনাকে চলতে হয়। কিন্তু খণ্ডকালীন চাকরিতে এমন কোনো ঝামেলা নেই। কোনো কারণে আপনি পূর্ণকালীন চাকরি হারালে, সেই মুহূর্তে আপনি সর্বোস্ব হারাবেন। কিন্তু খণ্ডকালীন চাকরিতে এমন কোনো সম্ভাবনা নেই। কেননা আপনি কাজ করবেন আপনার সৃজনশীলতা দিয়ে। আর এসব ক্ষেত্রে একটি কাজ হারালে আরও কয়েকটি কাজ সামনে এসে হাজির হয়।
৫. দুশ্চিন্তামুক্ত
আপনি যখন কোনো পূর্ণকালীন চাকরি করেন তখন আপনাকে অনেক নিয়ম-নীতি এবং বাধ্যবাধকতার মধ্যে থাকতে হয়; নির্দিষ্ট সময় অফিস যাওয়া, নির্দিষ্ট সময়ে কাজ শেষ করা।
কিন্তু এক্ষেত্রে এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। আপনি নিজেই আপনার নিয়ন্ত্রণকারী। আপনি যখন টাকার জন্য কোনো কাজ করছেন তখন এ ব্যাপারে দুটি চিন্তা আসতে পারে। হয় আপনি কাজটা পছন্দ করেন তাই করছেন, নয়তো আপনি বাধ্য হয়ে কাজটা করছেন। বাধ্য হয়ে করা কাজ আপনার মনের উপর বিশেষ প্রভাব ফেলবে, যা আপনার শরীর-মনকে অসুস্থ করে তুলবে। কিন্তু আপনি যদি সত্যিই কাজটা ভালোবেসে করেন তাহলে এমন অস্বস্তির সম্ভাবনা কম।
কিন্তু পূর্ণকালীন চাকরিতে সব সময় কি ভালোবেসে কাজ করা সম্ভব হয়? হয় না! কিন্তু খন্ডকালীন চাকরি বা নিজের কাজ সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে ভালবেসেই করা যায়।
৬. আপনি দীর্ঘজীবী হবেন
আমরা সবাই জানি কম চাপ, ভালো খাদ্য এবং পর্যাপ্ত ঘুম অবশ্যই আপনাকে দীর্ঘজীবী করে তুলবে। এমন জীবন একমাত্র খণ্ডকালীন চাকরি বা নিজের মতো করে করা চাকরিতেই পাওয়া সম্ভব।
সুতরাং সুস্থ থাকতে হলে এবং দীর্ঘজীবী হতে হলে পূর্ণকালীন চাকরি ছেড়ে খন্ডকালীন চাকরি ধরুন অথবা নিজের মতো করে কিছু করুন।
৭. আপনি আরো বেশি উৎপাদনশীল হবেন
কথাটা শুনে প্রথমবার খটকা লাগতে পারে। খন্ডকালীন চাকরিতে বেশি উৎপাদনশীল কিভাবে হওয়া সম্ভব?
আসলে উৎপাদনশীলতা কাজের পরিমাণের উপর নির্ভর করে না। খন্ডকালীন চাকরি অনেকটা ছুটি কাটাতে কাটাতে কাজ করার মতো। কাজটা যখন আপনার নিজের, কাজেই আপনি নিজের তাগিদে কাজের প্রতি আরো বেশি মনোযোগী হবেন, দ্রুত কাজ করবেন এবং স্বভাবতই আপনার ভুল কম হবে। নিশ্চিত ভাবেই এই প্রচেষ্টা আপনাকে কাজে বিজয়ী করে তুলবে।