কর্মই জীবন! কাজ – বিষয়ে আরো কত কথাই না বলেছেন গুণীজনেরা। তবে সময় পারিপার্শ্বিকতার সাথে সাথে আমাদের কাজ করার ধাঁচ, অবস্থা অনেক কিছুই বদলেছে। একসময় মানুষ বেঁচে থাকার জন্য পশু শিকার করতো আর এখন অফিসে কাজ করে। সোজা বাংলায় বুদ্ধিকে জীবিকা হিসাবে ব্যবহার করে বেশিরভাগ মানুষ চলছে এখন। কাজের ধরনের সাথে সাথে কাজের পরিবেশ যেমন বদলাচ্ছে তেমনি তৈরি হচ্ছে নতুন নতুন সমস্যা। যেমন অনেকে কোলাহলময় অফিসে কাজ করতে পারেন না। কেউ আবার টিমে ভালোভাবে খাপ খাওয়াতে পারেন না। আবার অনেকে কফি শপে স্বচ্ছন্দ্যে কাজ করতে পারেন কেউবা দেখবেন কানে এয়ার ফোন গুঁজে নিজের মতো কাজ করে যাচ্ছে।
আমরা অনেকেই কোলাহলের মাঝে কানে হেডফোন গুঁজে কাজ করি। কেন এমন হয়?এর উত্তর পেলাম অরাল রবার্টস বিশ্ববিদ্যালয়ের লিডারশিপ এবং ইনোভেশন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক এবং বেশ কিছু বেস্ট সেলার বইয়ের রচিয়তা ডেভিড বার্কাস এর নতুন লেখায়।
বছর খানেক আগে আমি আমার নতুন বইয়ের ইন্টারভিউ দিতে গিয়েছিলাম, সেখানে সঞ্চালকের একটি কথা শুনে আমার খটকা লেগেছিল! সঞ্চালক ভদ্রলোক তার কর্মস্থলের কোলাহল নিয়ে এতটাই বিরক্ত ছিলেন যে, অফিসের বাইরের রাস্তায় কোওয়ার্কিং প্লেসের সদস্য পর্যন্ত হয়েছিলেন। আমি সিলিক্যান ভালীর খোলা অফিস কার্যক্রমের পক্ষে নই যদিও তবুও যে ব্যাপারটি আমার খটকা লাগলো তা হলো- কোওয়ার্কিং প্লেসগুলোতে খোলা হয় তারপরেও কেন আমরা সেখানে কাজ করতে স্বচ্ছন্দ বোধ করছি ,অফিসে কেন নয়! শুরু করলাম ঘাটাঘাঁটি, পেয়ে গেলাম বেশ কিছু পরীক্ষিত হাইপোথিসিস। যেখানে শব্দের সাথে মস্তিষ্কের কাজের ধারণা ব্যাখ্যা করা হয়েছে। এর উপর নির্ভর করে উত্তর মিলে গেল কেন আমরা অফিসে কাজ করার চেয়ে কোওয়ার্কিং প্লেস যেমন কফিশপের প্রতি আগ্রহী।
নিচের গ্রাফটা লক্ষ্য করুন।
নতুন গবেষণা বলছে, আসলে শব্দ আমাদের বিক্ষিপ্ত করে না বরং শব্দের উৎস আমাদের বিক্ষিপ্ত করে কাজে। নতুন এই গবেষণায় আরো দেখা যায় যে, কর্মক্ষেত্রের গুমগুম বা গুনগুন শব্দে বরং আমাদের মস্তিষ্ক বেশ ভালোভাবে কাজ করে বিশেষভাবে ক্রিয়েটিভ কাজ কর্মের জন্য। এর কারণ এই গুনগুন বা গুমগুম শব্দ আমাদের মস্তিষ্ককে অন্যদের কথায় মনোযোগ দিতে বাধা দেয়। সত্য বলতে, কাজ করার জন্য সবচেয়ে উপযোগী হচ্ছে কর্মক্ষেত্রের আশেপাশে বা পেছনে শব্দ থাকা, নিঃশব্দ নয়। আপনি নিজে একটু খেয়াল করেন, দেখবেন আমরা যখন কানে এয়ারফোন লাগিয়ে কাজ করি তখন আমরা বেশ মনোযোগের সাথে কাজ করতে পারি। একইভাবে একই কারণে আপনি কফি শপে বসে ভালোভাবে কাজ করতে পারেন, অফিসে নয়।
কনজিউমার রিসার্চের নতুন জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণায় দেখা গেছে যে, সঠিক পরিমাণের ব্যাকগ্রাউণ্ড নয়েজ আমাদের মস্তিষ্কের ক্রিয়েটিভ কাজ কর্মকে ত্বরান্বিত করে। ইউনিভার্সিটি অফ ইলিওন্স–আরবানা এর গবেষক রাভি মেহতা বিভিন্ন ধরনের শব্দের সাথে ব্যক্তির ক্রিয়েটিভ কাজ করার সম্পর্ক বের করেছেন। পরীক্ষার জন্য রাভি মেহতা পরীক্ষণ দলকে চার ভাগে ভাগ করেন। এরপর তাদের বিভিন্ন শব্দকম্পাঙ্কের স্থানে নিয়ে রিমোট অ্যাসোসিয়েট টেস্ট দিতে বলা হয়। এই টেস্টটি মূলত ব্যক্তির ক্রিয়েটিভিটি নির্ণয়ে ব্যবহার করা হয়। এতে বিভিন্ন এলোমেলো ভাবে দেওয়া শব্দে নতুন কি শব্দ তৈরি করা যায় তা বের করতে বলা হয়।
পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারীদের ৮৫, ৭০, ৫০ ডেসিবেল থেকে শুরু করে ০ বা নিঃশব্দ মাত্রার শব্দ লেভেলে রাখা হয়। পরিসংখ্যানিক ভাবে ফলাফলের বেশি পরিবর্তন না হলেও পার্থক্য ছিল চোখে পড়ার মতো। যারা ৭০ ডেসিবেল শব্দের (কফি শপ বা সুপার শপের শব্দের মতো) মাঝে ছিল তারা অন্যদের থেকে বেশি ভালো ফলাফল দেখিয়েছে। যদিও কাজের ফলাফলের তারতম্য অল্প হলেও একটি ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া যায় যে সঠিক মাত্রার ব্যাকগ্রাউণ্ড নয়েজ আমাদের কাজকে বেশ প্রভাবিত করে। কিন্তু কিভাবে পরিমিত ব্যাকগ্রাউণ্ড নয়েজ আমাদের সৃষ্টিশীলতাকে ত্বরান্বিত করে। একটু মনোযোগ দিলেই এর উত্তর মিলবে।
আমরা যখন ৭০ ডেসিবেল বা পরিমিত শব্দের মাঝে থাকি তখন আমাদের মস্তিষ্ক ঠিকভাবে ভাবতে বা চিন্তা করতে পারি না আর ঠিক তখনই আমাদের মস্তিষ্কের কল্পনার অংশ কাজ করতে শুরু করে ভালোভাবে। চিন্তা করে দেখবেন, আপনি যদি চিন্তিত না হন বা খালি মাথায় বসে থাকেন তাহলে আপনার মাথায় শুধু কল্পনা কাজ করতে শুরু করে, যাকে আমরা বলি দিবাস্বপ্ন দেখা। তাই এই ধরনের “ডিস্ট্রাক্টেড ফোকাস” হচ্ছে কল্পনা বা সৃষ্টিশীল কাজ করার জন্য সেরা অবস্থা। তাই লেখকের মতে, “তাই তুলনামূলক কোলাহলময় স্থানে আমাদের মস্তিষ্ক অহেতুক বা অ্যাবস্ট্রাক্ট বিষয় নিয়ে ভাবতে থাকে, আর এতেই সৃষ্টিশীলতার জন্ম হয়।”
আরেকটি পরীক্ষায় গবেষকরা সরাসরি মস্তিষ্ক নিয়ে কাজ করেছেন। তারা ইইজি মেশিন দ্বারা শব্দের মাত্রার সাথে ব্যক্তির ক্রিয়েটিভ মস্তিষ্কের যে তরঙ্গ সম্পর্ক তৈরি হয় সেটা নির্ণয় করেছেন। ইইজি মেশিন দ্বারা নির্ণীত এবং প্রাপ্ত তথ্য মতে, শব্দের মাত্রার সাথে ক্রিয়েটিভিটির সম্পর্ক বেশ গভীর। এই গবেষকদলের মতেও সৃষ্টিশীল কাজের পেছনে পরিমিত শব্দ থাক উচিত।
এখন একটি প্রশ্ন থেকেই যায়, কফিশপের মতো অফিস খোলা জায়গা হলেও আমরা কেন সেখানে কাজে মনোনিবেশ করতে পারি না! এর উত্তর আগে দিয়েছিলাম, শব্দের উৎস। আমাদের কর্মক্ষেত্রেও কফিশপের মতো গুম গুম শব্দ থাকা সত্ত্বেও আমরা যখন অফিসে কাজ করি তখন আমাদের আশেপাশের শব্দের উৎস আমাদের কাজের সাথে সংগতপূর্ণ হওয়ায় আমাদের মনোযোগ সেদিকে চলে যায়। যেমন, আপনি অফিসে বসে কাজ করছেন আপনার পাশের কেবিনেটে আপনার সহকর্মীর সাথে বসের প্রোজেক্ট নিয়ে কথা হচ্ছে, আপনি না চাইলেও আপনার কান চলে যাবে সেদিকে সাথে সাথে মনোযোগ। এছাড়া কাজ করার সময় যে কেউ আপনাকে ডাকতে পারে এতেও আপনার মনোযোগ নষ্ট হয়। অন্যদিকে কোওয়ার্কিং প্লেস বা কফি শপের গুম গুম শব্দের মাঝেও আপনার মনোযোগ নষ্ট সবার সম্ভাবনা কম। কারণ কেউ আপনাকে বিরক্ত করবে না এবং অন্যের কথায় আপনার কান ও যাবে না।
তাই পরীক্ষার ফলাফল এবং ব্যক্তিগত চিন্তা থেকে সহজেই বলা যায় যে, কর্মক্ষেত্রে কাজের মনযোগীতার জন্য কর্মস্থলের নীরবতার প্রয়োজন নেই। শুধু দরকার কাজের সময় কেউ যেন বিরক্ত না করে। তাই ঠিকভাবে কাজ করতে চান হালকা কোলাহলময় জায়গা খুঁজে বের করুন, এরপর ডুবে যান কাজে।