তালুতে পুরে ফেলা যায়, এমন একটি ট্রফি নিয়েই চলছে ইতিহাসের সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী ‘মল্লযুদ্ধ’। সামান্য ছাইভস্ম নিয়েই এত হইচই! ক্রিকেট ইতিহাসের সবচেয়ে পুরোনো দ্বৈরথের কথা হচ্ছে। শুধু ব্যাট আর বলের মাঝে কখনোই আটকে ছিল না এই মরণপণ লড়াই। বডিলাইন সিরিজের পর তো কূটনৈতিক পর্যায়েও গড়িয়েছিল এই লড়াই।
‘অস্ট্রেলিয়া সফর একটি অসাধারণ ব্যাপার, যদি তুমি বধির হও’—ইংল্যান্ডের সাবেক ফাস্ট বোলার হ্যারল্ড লারউডের এই একটি উক্তিতেই বোঝা যায় অ্যাশেজের ঝাঁজ। অ্যাশেজের ১৪০ বছরের ইতিহাসে স্মরণীয় ঘটনা অসংখ্য। তবে কিছু ঘটনা অবশ্যই থাকবে চিরস্মরণীয় হয়ে।
১৯১২ সালের অ্যাশেজের ঘটনা। চতুর্থ টেস্টের আগে সিরিজে পিছিয়ে থাকা অস্ট্রেলিয়া দলের মনোবল বাড়ানোর জন্য টিম মিটিংয়ে চলে এসেছেন কর্মকর্তারাও। নির্বাচক পিটার ম্যাকএলিস্টার আর অধিনায়ক ক্লেম হিলের মধ্যে তখন সাপে-নেউলে সম্পর্ক। বৈঠকের মধ্যে পিটার হঠাৎ হিলের দিকে আঙুল তুলে বললেন, ‘তুমি আমার দেখা সবচেয়ে বাজে অধিনায়ক।’
আর যায় কোথায়! রাগে-ক্রোধে অন্ধ হয়ে হিল তেড়ে গেলেন পিটারের দিকে, ‘সারা সন্ধ্যা যে জিনিসটার জন্য ছটফট করছিলে, সেটাই বুঝিয়ে দিচ্ছি’ বলেই পিটারের নাকে দড়াম করে এক ঘুষি বসিয়ে দিলেন। মুহূর্তেই গজব নেমে এল পুরো বৈঠক কক্ষে। হিল তো পিটারকে তুলে নিয়ে তিনতলা থেকে নিচে ছুড়ে ফেলতে চাচ্ছিলেন। সবার হস্তক্ষেপে সে যাত্রা বেঁচে যান পিটার। মজার ব্যাপার, এত কিছুর পরেও অধিনায়কের পদে বহাল ছিলেন হিল।
টেস্টে মুখোমুখি ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়া
ম্যাচ | অস্ট্রেলিয়া | ইংল্যান্ড | ড্র | |
মোট | ৩৪১ | ১৪০ | ১০৮ | ৯৩ |
অ্যাশেজে | ৩২৫ | ১৩০ | ১০৬ | ৮৯ |
খেলার প্রতি নিবেদন নিয়ে অনেক গল্প আছে। তবে এর মধ্যে জিওফ মার্শের গল্প ছিল সবচেয়ে অদ্ভুত। ১৯৮৯ সালে হেডিংলি টেস্টের আগে মার্শের রুমমেট ছিলেন ডেভিড বুন। ওই টেস্টের সকালে ঘুম থেকে উঠে বুন হতবাক হয়ে যান। জিওফ মার্শ এই সাতসকালেই আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সোজা ব্যাটে খেলাটা অনুশীলন করছিলেন। মাথায় হেলমেট, হাতে গ্লাভস। ব্যস ওই টুকুই, শরীরে নাকি আর একটি সুতোও ছিল না মার্শের!
১৮৭৮ সালে অস্ট্রেলিয়ার বিলি মিডউইন্টার ডব্লু জি গ্রেসের কাউন্টি দল গ্লুস্টারশায়ারের সঙ্গে চুক্তি করেন। কিন্তু ওভালে ম্যাচের সকালে গ্রেসকে জানানো হলো, বিলি কাউন্টির ম্যাচে না এসে লর্ডসে অ্যাশেজ টেস্ট খেলছেন! রেগে মেগে গ্রেস তখনই ঘোড়ার গাড়ি ছুটিয়ে লর্ডসে চলে এলেন। ড্রেসিংরুম থেকে টেনেহিঁচড়ে বের করলেন মিড উইন্টারকে—পায়ে প্যাড পরা অবস্থাতেই। অস্ট্রেলিয়া দলের সবাই ছুটে এলেন সতীর্থকে বাঁচাতে। কিন্তু গ্রেস রীতিমতো মারামারিতে জিতেই মিডউইন্টারকে নিয়ে এলেন কেনিংটনে। মিডউইন্টারকে সেদিন দেশের নয়, খেলতে হয়েছিল গ্লুস্টারশায়ারের হয়েই।
অ্যাশেজের সংখ্যাতত্ত্ব
দলীয় সর্বোচ্চ | ||
অস্ট্রেলিয়া | ৭২৯/৬ ডি., লর্ডস, ১৯৩০ | |
ইংল্যান্ড | ৯০৩/৭ ডি., ওভাল, ১৯৩৮ | |
দলীয় সর্বনিম্ন | ||
অস্ট্রেলিয়া | ৩৬, এজবাস্টন, ১৯০২ | |
ইংল্যান্ড | ৪৫, সিডনি, ১৮৮৭ |
অ্যাডিলেড ওভালে সারা দিন অনেক খাটাখাটনির পর ইংলিশ ক্রিকেটার ডেরেক র্যান্ডালের একটু আয়েশ করে গোসলের সাধ জেগেছিল। নিজের কক্ষে স্নানঘরে ঢুকে পানির কল ছেড়ে কী মনে করে যেন তিনি চলে গেলেন ইয়ান বোথাম ও অ্যালান ল্যাম্বের কক্ষে। সেখানে চা খেয়ে নিজের কক্ষে ঢোকার মুখেই আবিষ্কার করলেন যে তিনি তোয়ালে পরেই চলে এসেছেন বাইরে আর চাবি কক্ষের ভেতরে রেখেই তা লক করে দিয়েছেন। অগত্যা তাঁকে ওই অবস্থাতেই নিচে নামতে হলো। নেমেই দেখেন রিসেপশনের সামনে ভিড়। আর সবার পোশাকই ভিজে একাকার!
‘কী সমস্যা?’ ডেরেকের প্রশ্ন। উত্তরে কেউ একজন বললেন, ‘আরে ধুর! কোন বেকুব যেন স্নানঘরের কল ছেড়ে এসেছে আর তাতে পুরো ডাইনিং ভেসে গেছে পানিতে!’
১৯৩২/৩৩ সালের সিরিজটা শুধু বডিলাইন-কাণ্ডের জন্য মানুষ মনে রেখেছে। অথচ এই সিরিজে ইংরেজ ব্যাটসম্যান এ ডি পেইন্টার সাহসিকতার যে নিদর্শন রেখে গেছেন, তা সত্যিই অতুলনীয়। সিরিজের চতুর্থ টেস্ট চলাকালে পেইন্টারকে হাসপাতালে নিতে হয়েছিল প্রচণ্ড জ্বরের জন্য। কিন্তু রেডিওতে ইংল্যান্ডের ব্যাটিং বিপর্যয়ের কথা শুনে হাসপাতাল থেকে পালিয়ে একটা ট্যাক্সি নিয়ে তিনি চলে আসেন মাঠে। জ্বর নিয়ে মাঠে নেমে ইংল্যান্ডকে লিড এনে দিয়েই তিনি আবারও ফিরে যান হাসপাতালে। পরের দিন জেতার জন্য ইংল্যান্ডের দরকার ১৬০। পেইন্টার আবারও পালিয়ে চলে এলেন মাঠে। তাঁর হাঁকানো এক ছক্কাতেই অ্যাশেজ নিশ্চিত করে ডগলাস জার্ডিনের ইংল্যান্ড।
অ্যাশেজের সেরারা
সবচেয়ে বেশি রান | ||
অস্ট্রেলিয়া | ৫০২৮, ডন ব্র্যাডম্যান | |
ইংল্যান্ড | ৩৬৩৬, জ্যাক হবস | |
সবচেয়ে বেশি উইকেট | ||
অস্ট্রেলিয়া | ১৯৫, শেন ওয়ার্ন | |
ইংল্যান্ড | ১২৮, ইয়ান বোথাম |
স্লেজিং আর অ্যাশেজ অনেকটা সমার্থক শব্দ। অ্যাশেজের খেলা চলছে আর তাতে কিছু উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় হচ্ছে না, সেটা হতেই পারে না। একবার ইংল্যান্ডের হয়ে ব্যাট করতে নেমেছেন জেমস অরমন্ড। মাত্রই গার্ড নিচ্ছেন, এ অবস্থায় স্লিপ কর্ডন থেকে ভেসে এল মার্ক ওয়াহর কণ্ঠ, ‘তুমি এখানে কী করছ? আমার তো মনে হয় ইংল্যান্ডের হয়ে খেলার যোগ্যতা তোমার নেই।’
‘হতে পারে, কিন্তু অন্তত আমার পরিবারে আমিই সেরা।’ অরমন্ডের ত্বরিত জবাব। (উল্লেখ্য, মার্কের আগে অস্ট্রেলিয়া দলে অভিষেক হয়েছিল স্টিভ ওয়াহর)।
Courtesy: Prothom-Alo