আক্রমণভাগ আর রক্ষণভাগ এ দু’য়ে ফুটবল। এখানে একটি ম্যাচ জিততে হলে যেমন গোল করতে হবে তেমনি গোল হওয়া থেকে দলকে বাঁচাতেও হবে। মিডফিল্ড এবং ফরোয়ার্ড লাইন মিলিয়ে আক্রমণভাগ অন্যদিকে রক্ষণভাগ এবং গোলকিপারের সমন্বয়ে গড়ে উঠে পুরো রক্ষণভাগ। আর এ রক্ষণভাগে খেলে ভুবনবিখ্যাত হয়েছেন অনেক ফুটবলার, কেউবা হয়েছেন কিংবদন্তী। আধুনিক ফুটবলের নিয়ম অনুসারে চিন্তা করলে জয়ী হওয়ার পূর্ব শর্ত রক্ষণভাগে নিঁখুত থাকা। শতাব্দীধরে প্রবাহমান ফুটবলীয় দুনিয়ায় বহু ডিফেন্ডারের আগমন ঘটেছে! যাদের কৃতিত্ব বেশি তাদের লোকে মনে রেখেছে।
তবে আধুনিক রক্ষণভাগের খেলোয়াড়রা অতীতের চেয়ে অনেক বেশি দক্ষ এবং সুকৌশলী হয়ে থাকেন। বিশ্ব ফুটবলের রক্ষণভাগে খেলা ফুটবলারদের নিয়ে পর্যালোচনা করলে ববি মোওর, কার্লোস পুয়্যল, কাফু, ফ্রাঙ্কো বারেইসি কিংবা জার্মান কিংবদন্তী ফ্রাঞ্জ বেকেনবাওয়ার এবং ইতালিয়ান পাওলো মালদিনির নাম সবার আগে উঠে আসবে। কিন্তুু সেরাদেরও সেরা থাকে, থাকে সর্বকালের সেরা বলতে একটি কথা। সে দিকটায় সবার চেয়ে এগিয়ে মিলানের সম্রাট খ্যাত ‘পাওলো মালদিনি’ যার ফুটবল জীবন শুরু হয় মেরাডোনা-রোনালদো ফেনোমেননদের সময় থেকে আর শেষ হয় এ প্রজন্মে মেসি-রোনালদোর সময়ে এসে।
২৫ বছরের ফুটবল জীবনে প্রাপ্তি, ভক্তদের ভালোবাসা এবং অভিজ্ঞতাগুলোই তাকে সর্বকালের সেরার মর্যাদা দিয়েছে এবং আলাদা করেছে অন্যদের থেকে। তিনি মোকাবেলা করেছেন ফেনোমেনন, দিনহো, জিদান, ব্যাকহাম, গিগসদের মতো ফুটবলারদেরকে। আধুনিক ফুটবলের রক্ষণভাগের নতুনত্ব এবং সৃজনশীলতা উঠে আসে তার হাত ধরেই।
মাত্র ১৬ বছর বয়সে ১৯৮৫ সালে ইতালিয়ান ক্লাব এসি মিলানের মূল দলে অভিষেক হয় ‘পাওলো মালদিনির। সিনিয়র টিমে অভিষেকের ২ বছরের মধ্যেই তার প্রতিভায় বিস্মিত হয়ে তখনকার মিলান কোচ তাকে ইউরোপীয়ান প্রতিযোগিতায় খেলানোর সিদ্ধান্ত নেন। ১৯৮৮-৮৯ মৌসুমে মালদিনি তার ক্যারিয়ারের প্রথম চ্যাম্পিয়ন্সলীগ শিরোপা জিতেন এবং ঐটি ছিলো এসি মিলানের ইতিহাসে তৃতীয় চ্যাম্পিয়ন্স লিগ শিরোপা। সেবার মালদিনি লেপ্টব্যাক হিসেবে খেলেছিলেন কিংবদন্তী ডিফেন্ডার ফ্রাঙ্কো বারেসির পাশে থেকে, মূলত বারেসি মিলান ত্যাগের পরই লেপ্টব্যাক থেকে সেন্টারব্যাক পজিশনে খেলতে থাকেন তিঁনি।
প্রথম চ্যাম্পিয়ন্সলিগ জেতার পাশাপাশি এত অল্প বয়সে অভাবনীয় সাফল্য এবং প্রতিভা দেখে ডাক পান ইতালি জাতীয় দলে। মাত্র ১৯ বছর বয়সে ইতালির হয়ে অভিষেক হয় পাওলো মালদিনির। এর পরের বছর মিলান আবারো চ্যাম্পিয়ন্সলিগ জিতে এবং মালদিনি নির্বাচিত হন মিলানের বর্ষসেরা সেরা ফুটবলার। মূলত দু’টো চ্যাম্পিয়ন্সলিগ জেতার দুটো বছরই তার ক্যারিয়ারের মোড় ঘুরিয়ে দেয়।
যা প্রমাণ করেছিলো তখন তার ক্ষমতার এবং বিশ্বকে জানান দিচ্ছিলো মিলানের প্রাচীন সোনালি প্রজন্মের শেষ থেকে আরেক শুরুর। মাত্র ২৩ বছর বয়সে নিজের নামের পাশে দুটো চ্যাম্পিয়ন্সলিগ শিরোপা থাকায় ডাক পান ইউরোপের বাঘা বাঘা দলগুলো থেকে। কিন্তুু গেলেন না মিলান ছেড়ে, কারণ মিলান তখন ইউরোপীয় ক্লাব ফুটবলের সম্রাজ্য সামাল দিচ্ছিল এক হাতে। তরুণ বয়সেই মোকাবেলা করেছেন রোনালদো ফেনোমেনন, রোনালদিনহো, জিদানদের মতো ফুটবলারদেরকে।
তখন অবশ্য ইতালিতে চলছিলো ক্লাব ফুটবলের জয়োৎসব, বেশিরভাগ তারকারা তখন ইতালিয়ান লিগে খেলছিলো বলে। তবুও মিলান এককভাবেই রাজত্ব করছিলো ইতালীয়ান লিগে বলা চলে। আর মিলানের সুসময়ে ক্যাপ্টেন আর্মব্যন্ড পরে মিলানের ডিফেন্স সামলাচ্ছিলেন মালদিনি নিজে। আজকে লা লিগা যেমন ফুটবলের দামামা বাজিয়ে ইউরোপীয় প্রতিযোগিতায় রাজত্ব করছে, সেকালে ইতালিয়ান দলগুলোও ছিলো এমন অবস্থানে।
ইতালিয়ান লিগের পাশাপাশি ইউরোপীয় প্রতিযোগিতায় তারকা প্লেয়ারদের সবচেয়ে বড় আতঙ্ক ছিলো মালদিনি নামটাই। তার ট্যাকেল, ম্যান মার্কিং, ক্লিয়ারেন্স কিংবা দলের প্রয়োজনে আক্রমণাত্বক খেলা সবকিছুই ছিলো আধুনিক ফুটবলের অনুকরণে। গোলকিপারকে বোকা বানানো সহজ কিন্তুু মালদিনিকে নয় এমন একটা বাক্য তখন ইউরোপে প্রসিদ্ধ হয়ে গিয়েছিলো। কিংবদন্তী রোনালদিনহো একবার বলেছিলেন, “আমার ফুটবল জীবনে মুখোমুখি হওয়া সবচেয়ে কঠিন ডিফেন্ডার ছিলেন মালদিনি এবং জন টেরি”।
ক্লাব ফুটবলে প্রচলিত সকল শিরোপাই জিতেছেন পাওলো মালদিনি। মিলানকে জিতিয়েছেন ৫টি চ্যাম্পিয়ন্সলিগ ট্রফি যা মিলানকে নিয়েছিলো সেকালে সবার সেরা টিমগুলোর কাতারে আর মালদিনিকে পরিণত করেছিলো কিংবদন্তীতে। মিলানের হয়ে আরো জিতেছেন ৭টি ইতালিয়ান লিগ শিরোপা, ৬টি ইতালিয়ান সুপারকাপ, ৪টি ইউরোপীয়ান সুপারকাপ, ২টি ইন্টারকন্টিনেন্টাল কাপ এবং ১টি ক্লাব বিশ্বকাপ। মিলানের হয়ে ২৫ বছরের ক্যারিয়ারে জিতেছেন সর্বমোট ২৬টি শিরোপা।
এছাড়াও ইতালির হয়ে খেলেছেন সর্বমোট ২টি মেজর টুর্নামেন্টের ফাইনাল যার একটি ৯৪’ এর বিশ্বকাপ ফাইনাল অপরটি ২০০০ সালে ইউরোর ফাইনাল, তবে কোনোটাতেই ভাগ্য তার সহায় ছিলো না। ইতালির ক্যাপ্টেন আর্মব্যন্ড হাতে কেঁদেছেন অসংখ্য রাত্রি, এখনো অগণিত রাত্রি না ঘুমিয়ে কাটান ইতালির হয়ে কিছু না জেতার কষ্ট বুকে নিয়ে।
কিংবদন্তী মালদিনি এই একটি জায়গায় হেরেছেন, জিততে পারেননি ইতালির হয়ে কোনো শিরোপা যার আক্ষেপ এখনো প্রকাশ করেন মাঝে মাঝে। তাতে কি? তার কৃতিত্ব আজও মনে রেখেছে ইতালির প্রতিটি মানুষ। সবার কাছে সেকালে ‘দ্য ক্যাপ্টেন’ হিসেবে পিরিচিত মালদিনি ইতালিয়ান ফুটবলে সবসময়ের সেরা হিসেবে বেঁচে থাকবেন পরবর্তী কালেও।
মালদিনির ব্যক্তিগত পুরষ্কার নিয়ে লিখতে গেলে দুটো পৃষ্ঠার প্রয়োজন। তবে তার এত এত অর্জনের মাঝে কিছু অর্জনের কথা উল্লেখ না করলেই নয়! একজন ডিফেন্ডার হয়েও তিনি দু’বার ব্যালনডি’অর টপ থ্রিতে ছিলেন। এছাড়াও ১৯৯৫ সালে ফিফার বর্ষসেরা ফুটবলার হিসেবে সিলভার অ্যাওয়ার্ড জিতেছিলেন।
৩ বার চ্যাম্পিয়ন্সলিগের টুর্নামেন্ট সেরা একাদশে জায়গা পেয়েছিলেন এ ভুবনবিজয়ী ডিফেন্ডার। বিশ্বকাপের অলস্টার একাদশেও জায়গা পেয়েছেন দু’বার, একবার হয়েছিলেন চ্যাম্পিয়ন্সলিগ ফাইনালের ম্যাচসেরা। ফুটবলার হিসেবে সবচেয়ে বেশি (৫বার) চ্যাম্পিয়ন্সলিগ শিরোপা জেতার রেকর্ড তার দখলে।এসব ছাড়াও উইকিপিডিয়াতে তার ব্যক্তিগত অর্জনের বিশাল একটি তালিকা বিদ্যমান।
মিলান এবং ইতালির হয়ে পাওলো মালদিনি খেলেছেন ৯০২ ম্যাচ। ইতালিয়ান লিগে খেলেছেন ৬৪৭ ম্যাচ এবং ইউরোপীয়ান প্রতিযোগিতায় খেলেছেন ১৭৪ ম্যাচ। চ্যাম্পিয়ন্সলিগের সবচেয়ে বেশি ফাইনাল খেলা ফুটবলার হচ্ছেন পাওলো মালদিনি, যিনি সর্বমোট ৮ বার ফাইনাল খেলেছেন এবং প্রতিবার এসি মিলানের হয়েই।
ইতালির হয়ে সবচেয়ে বেশি বিশ্বকাপ ম্যাচ খেলার রেকর্ড ইতালির সাবেক ক্যাপ্টেন এই মালদিনির। মিলানের হয়ে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক ম্যাচ খেলেছেন এই কিংবদন্তী। তার এতসব অর্জন, রেকর্ডই তাকে মূল্যায়ন করতে যথেষ্ট।
ফুটবলে ‘ওয়ান ক্লাব ম্যান’ হিসেবে পরিচিত পাওলো মালদিনি যেদিন থেকে এসি মিলানের হয়ে ক্যারিয়ার শুরু করেন সেদিন থেকে ২০০৯ সালে তার অবসরের আগ পর্যন্ত মোকাবিলা করেছেন বহু বাধাবিপত্তি, সফলতা-প্রতিকূলতা। তার ২৫ বছরের ফুটবল জীবন এক ক্লাবের হয়ে ফুটবল ইতিহাসে সর্বোচ্চ। মালদিনি প্রথম দিকে বিখ্যাত ছিলেন তার রক্ষণাত্মক প্রতিভার জন্য, তাকে এক প্রকার অলরাউন্ডার ও বলা হতো।
মিলানের সোনালী অতীতের পরে যখন দুর্দিন আসে তখন ফুটবলে রাজত্ব করছিলো প্রিমিয়ারলিগের দলগুলো। অন্যদিকে ইতালিয়ান লিগ তখন মরতে বসেছে প্রায়। তখন রিয়াল-বার্সা, ম্যানইউ-লিভারপুলের মতো দল টাকার বস্তা নিয়ে তাকে দলে ভেড়াতে চেয়েছিলো। কিন্তু তিনি যাননি এসি মিলান ছেড়ে, থেকে গেছেন ফুটবল জীবনের শেষ অবধি। তার এ দীর্ঘ ক্যারিয়ারে তিনি খুব অল্পসংখ্যক বার ইঞ্জুরিতে পড়েছিলেন।
তার ফিটনেস ছিলো দারুণ, যার কারণে তার প্রতিভায় এবং খেলার মান সময়ের পরিবর্তনে তেমন ঘাটতি দেখা যায়নি বরং দিনে দিনে তিনি তার অবস্থানে উন্নতি করতে পেরেছেন। মূলত আধুনিক ফুটবলের সাথে মানিয়ে নেয়ার মতো রক্ষণাত্বক স্কিল এবং বিচক্ষণতার সূচনা মালদিনির হাত ধরেই। ইউটিউবে তার তেমন কোনো ভালো মানের ভিডিও না থাকায় প্রজন্ম ৯০’ থেকে ২০০০ সালের আসল মালদিনিকে দেখার সৌভাগ্য হয়নি যে, মালদিনি ছিলেন আল্পস পর্বতের আগ্নেয়গিরির চেয়েও বেশি উত্তপ্ত এবং প্রশান্তমহাসাগরের মতো ভয়ঙ্কর। মিলানের সুসময়ে মিলানকে নেতৃত্ব দেয়া মালদিনি দীর্ঘসময় ধরে ইতালির ক্যাপ্টেনও ছিলেন।
দুঃসময়ে মিলানকে ছেড়ে না যাওয়ায় এসি মিলান কতৃপক্ষ তার গায়ে জড়ানো ৩ নম্বর জার্সিটা তুলে রেখেছেন মিলানের সান-সিরো স্টেডিয়ামের যাদুঘরে। আর কখনো কেউ মিলানের ৩ নাম্বার জার্সিটা গায়ে জড়াতে পারবেন না। কারণ এটি মালদিনির প্রতি কৃতজ্ঞতার স্বার্থে তুলে রাখা।
এমনটা হওয়া স্বাভাবিক, যে ফুটবলারটা নিজের পেশাদার জীবনর পুরোটা ব্যয় করেছেন লাল-সাদাদের জার্সির মর্যাদা রক্ষায় তার জন্য এতটুকু করা অবশ্যই জরুরি ছিলো আমি মনে করি। তিনি মিলানকে দিয়েছেন তার মাঝে সুপ্ত থাকা সমস্তটুকুন ফুটবল প্রতিভা বিনিময়ে মিলান তাকে দিয়েছে ইতিহাসের সেরা ডিফেন্ডারের তকমা।
এতশত অর্জনের মাঝে বুকে এসি মিলানের জন্য অজস্র ভালোবাসা নিয়ে সর্বকালের সেরা ডিফেন্ডারের তকমা ধারণ করা ‘পাওলো মালদিনি’ ১৯৬৮ সালের ২৬ জুন এসি মিলান কিংবদন্তী সিজার মালদিনির পুত্র হিসেবে ইতালির মিলানে জন্ম গ্রহণ করেন। পিতা সিজার ছিলেন একাধারে এসি মিলানের কিংবদন্তী লেপ্টব্যাক অন্যদিকে ইতালির কিংবদন্তী কোচ। মূলত ফুটবলীয় রক্তটা পিতার কাছ থেকেই পাওয়া। ২০০৯ সালে ফুটবলকে পুরোপুরি বিদায় দিলেও এখনো ফুটবলের সাথেই সম্পৃক্ত রয়েছেন ৫০ বছর বয়সী কিংবদন্তী ডিফেন্ডার। Miami FC ফুটবল ক্লাবের যৌথ মালিকানায় রয়েছেন তিনি।
মিলান একাডেমি থেকে গ্র্যাজুয়েশন করে মূলদলে চান্স হওয়া সেই ১৬ বছরের ছেলেটি নিজের বাবাকে ছাড়িয়ে যাবে এটা হয়তো কল্পনা করতে পেরেছিলো মিলান কতৃপক্ষ। কিন্তু শতাব্দী ধরে ইতিহাস বহন করা ফুটবলের সকল ডিফেন্ডারদের ছাড়িয়ে নিজেকে সেন্টারব্যাকদের সম্রাট হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করবেন তা হয়তো ভাবেননি স্বয়ং ফুটবল বিধাতাও। ভাবলে হয়তো তার নাম ‘পাওলো মালদিনি’ না হয়ে হতো ‘দ্য গ্রেটেস্ট পাওলো মালদিনি’।