ইতিহাসের বিখ্যাত ধনী সম্রাট – মানসা মূসা।

মূসা ছিলেন তার সময়ের সবচেয়ে সম্পদশালী সম্রাট এবং সর্বকালের সবচেয়ে ধনী ব্যাক্তি। পশ্চিম আফ্রিকার মালিয়ান রাজ্যের রাজা মানসা মূসাকে ধরা হয় বিশ্বের শ্রেষ্ট ধনী যিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন আনুমানিক ১২৮০ থেকে আনুমানিক ১৩৩৭ সালে । ১৪শতকের মালি সম্রাজ্যের একজন মানসা বা সম্রাট। তার সেই সময়কার রাজ্য বর্তমানের ঘানা, তিম্বুকতু ও মালির সমন্বয়। ইতিহাসবিদদের মতে তার সম্রাজ্যের আয়তন ছিল প্রায় ১২,৯৪,৯৯৪ বর্গ কিলোমিটার। ৪০০ বিলিয়ন ডলার সমমানের সম্পত্তির অধিকারী হিসেবে তার স্থান পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ধনীদের মধ্যে শীর্ষে। তার রাজ্যে যত লবণ আর সোনা উৎপাদিত হতো তা বিশ্বের অর্ধেক দেশের চাহিদা পূরণ করত।”মানসা মুসা” মালি সম্রাজ্যের (১২৩০খ্রিঃ-১৬০০খ্রিঃ) দশম “মানসা” ছিলেন।  তিনি মালি সম্রাজ্যের গোড়পত্তন কারী “সুন্দিয়াতা কেটা ” এর নাতি ছিলেন। তার নাম মূসা হলেও তাকে প্রথম মূসা, মালির আমির, ওয়াংগারা খনির সম্রাট, কনকান মূসা/কানকো মূসা, মালির সিংহ, গঙ্গা মূসা নামে ডাকা হয়। তিনি মালি সম্রাজ্যের এবং আফ্রিকার সবচেয়ে সফল সম্রাট ও শাসনকর্তা ছিলেন। মূসা ছিলেন একাধারে দক্ষ শাসন কর্তা, ইসলাম প্রচারক, শিক্ষা ও বিজ্ঞান অনুরাগী এবং দানশীল।

মূসা অধিক পরিচিত ছিলেন তার কথিত হজ্জপালনের  জন্য ( ১৩২৪ থেকে ১৩২৫ )। “মানসা মূসা” এর এই হজ্ব ইতিহাসের অবিস্বরনীয় এক হজ্ব বলে পরিচিতি পায়। এই হজ্বে প্রায় ৬০,০০০ মানুষ তার সফর সঙ্গী হয়। যার ভেতর প্রায় ১২,০০০ ক্রীতদাস এই সফরের দলে ছিল। মূসা সফরের জন্য প্রয়োজনীয় সকল খাদ্য-শস্য ও প্রচুর ধনসম্পদ নিয়ে রওনা দিয়েছিলেন। তার সফরে খাদ্যশস্য ছাড়াও সর্বপ্রকার প্রয়োজনীয় সামগ্রী ছিল। মুসার সফরে তার প্রথম স্ত্রী সঙ্গী হন। মুসার স্ত্রীর সেবায় ৫০০ দাসী নিযুক্ত ছিল। প্রত্যেকে একটি করে সোনার দন্ড বহন করছিল এবং ৮০ থেকে ১০০টি উট ছিল, যেগুলো প্রত্যেকটি প্রায় ১৪০ কেজি সোনার গুড়ো বহন করছিলো।এই কাফেলায় বেশ কয়েকজন শিক্ষক, চিকিৎসক, সরকারী কর্মকর্তা ও সঙ্গীত শিল্পীও ছিলেন।তাছাড়া তার এই যাত্রাপথে তিনি প্রায় কয়েকশত কোটি টাকা মূল্যের সোনা বিতরণ করেছিলেন। কায়রোতে তিনি এত বেশি স্বর্ণ বিতরণ করেছিলেন যে, বেশ কয়েক বছর ধরে সেখানে স্বর্ণের দাম তুলনামুলকভাবে অনেক কম ছিল।

 

মূসা অত্যন্ত দানশীল ছিলেন। তিনি তার কাফেলার পথে যত গরিব ও দরিদ্রের দেখা পেয়েছেন, সবাইকে অর্থ-সম্পদ, খাদ্য-বস্ত্র দিয়ে সাহায্য করেছেন। কথিত আছে, প্রতি জুম্মা বারে মূসা একটি মসজিদ তৈরী করতেন। মানসা মূসা তার রাজত্বকালে রাজ্যব্যবস্থা ও রাজকার্যাবলি নতুনভাবে সাজাতে সাহায্য করেছিলেন। তার রাজত্বকালে রাজনৈতিক পরিস্থিতি অনেক স্থিতিশীল ছিলো।

মানসা মূসার হজ্জপালনের পর, ইউরোপীয় মানচিত্র-অঙ্কনকারীরা তাঁদের মানচিত্রগুলোতে মানসা মূসার ছবি আঁকা শুরু করে। তিনি আমেরিকাকে ওয়াল-মার্টের ধারণা দেন। আর চিঠিতে অর্ডারের মাধ্যমে পণ্য প্রচলনেরও উন্নতি ঘটান। এক হাজার বছর আগেকার ইংল্যান্ডের যুদ্ধ বিগ্রহ নিয়ে কিছু বইও লিখেছিলেন তিনি। রাজা মূসা শিল্পানুরাগী ছিলেন। ছিলেন ধর্মপ্রাণও। অনেক বিশালাকার মসজিদ স্থাপন করেছিলেন সে সময় যা আজো শৈল্পিক স্থাপত্যের নিদর্শন হয়ে আছে। তার তৈরী কৃত স্থাপত্য সমূহের মধ্যে শংকর মাদ্রাসা বা ইউনিভার্সিটি অফ শংকর , হল অডিয়েন্স, গ্রান্ড প্যালেস উল্লেখযোগ্য।

মানসা মূসা ছিলেন মালি সাম্রাজ্যের সবচেয়ে সফল শাসক। তার সময়েই মালি সাম্রাজ্য সবচেয়ে বেশি বিস্তার লাভ করে, এবং জ্ঞান-বিজ্ঞানে, ব্যবসা-বানিজ্যে স্বর্গভুমি হিসেবে আত্নপ্রকাশ করে। তিনি প্রায় চারশো শহর এবং ডজনখানেক রাষ্ট্রের একাধিপতি ছিলেন এবং অত্যন্ত দক্ষতার সাথে রাজ্য পরিচালনা করতেন। ১৩৩১ সালে এই পৃথিবীশ্রেষ্ট ধনী মারা যান। তার মৃত্যুর পর মাত্র দুই জেনারেশন রাজত্ব করতে পেরেছিল। তারপর নানা যুদ্ধবিগ্রহে রাজা মুসার মালিয়ান রাজত্ব বিলিন হয়ে যায়। তারপরও ৪০০ বিলিয়ন বিপুল সম্পত্তির অধিকার তাকে শীর্ষ ধনীদের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ইতিহাসের মালদহ

মালদহের আকর্ষন অবশ্য শুধু সৌধই নয়,স্থানীয় সংস্কৃতিও সমান জনপ্রিয়।মালদহের সৌন্দার্য্যের কথা জানানো হচ্ছে

হাতে দিন তিনেক থাকলে বেড়ানর জন্য মালদহ অনবদ্য।ভ্রমনপিপাসু বাজ্ঞালিদের মধ্যে যাঁরা ইতিহাস ভালবাসেন মালদহ তাঁদের জন্য আদর্শ জায়গা।তবে মালদহ যে শুধু মসজিদের তা নয় মোটেও।এখানকার আম,পাটের কাজ আর সিল্ক তিনটিই জগত বিখ্যাত।কলকাতা থেকে ট্রেনে মালদহ যেতে ৭-৮ ঘণ্টা সময় লাগে।ভোর-রাত্রে,অন্ধকার থাকতে থাকতে আমরা পৌঁছালাম মালদা টাউন স্টেশনে।গাড়িতে চেঁপে মিনিট পনেরোর মধ্যেই পৌঁছে গেলাম পশ্চিম্বজ্ঞ সরকারের সেচ দফতরের অধীনস্ত বাংলোয়।সকাল ৯ তার মধ্যেই বেরিয়ে পড়লাম আমাদের প্রথম গন্তব্য জগজীবনপুরের দিকে।পৌঁছাতে লাগল প্রায় দেড় ঘণ্টা।পথে পেরোলাম মহানন্দা আর ট্যাঙ্গন নদী।মালদহের আমবাগানের কথা না বললে মালদহের রুপবর্ননা অসুম্পূর্ণ থেকে যায়।পথের দু’ধারে চোখে পড়ল বিরাট বিরাট আমবাগান।জগজীবনপুরের খ্রিস্টিয় অষ্টম শতাব্দিতে তৈরী পাল বংশের সময়কার বৌদ্ধ বিহারের একটি ধ্বংশাবশেষ আবিষ্কৃত হয়েছে।নাম নন্দাদিঘী বিহার।এখানকার প্রত্নাতাত্ত্বিক নিদর্শ্নগুলো রাখা আছে মালদহের সংগ্রহশালায়।জগজীবনপুর থেকে ফেরার পথে দুপুরের খাওয়া দাওয়া রাস্তাতেই সেরে এলাম।আমাদের পরের দিন গন্তব্য ছিল গৌড়।গৌড়ে ঢুকবার মুখেই রয়েছে রামকেলি মন্দির।মালদহ থেকে দক্ষিনে যেতে ১৮ কিমি দূরে অবস্থিত এটি।এই মন্দির দেখবার পরে আমরা গেলাম বারোদুয়রি বা বড়সোনা মসজিদে।এর নাম বারোদুয়ারি কিন্তু দরজা আছে এগারোটি।সেখান থেকে গেলাম দাখিল দরওয়াজা।লাল ইট ও টেরাকোটা দিয়ে তৈরী এই সৌধ ছিল গৌড়ের প্রধাণ প্রবেশদ্বার।দাখিল দারওয়ার গাঁয়ে ইঁটের যে সুক্ষ কারুকার্য দেখা যায় তা এককথায় অদ্ভুত।এক কিমি দূরে রয়েছে ফিরোজ মিনার।এটি কুতুব মিনারের আদলে তৈরী।এই সমাধিটির ঢিল ছোড়া দুরুত্বেই রয়েছে লুকোচুরি দরজা।পরের দিন আমাদের গন্তব্য পান্ডূয়া।পান্ডুয়ার প্রধান নিদর্শন আদিনা মসজিদ।আদিনা যাবার পথে রয়েছে ‘ডিনার পার্ক’।এখানে হরিণ ও নীল গাই আছে অনেক।আদিনা মসজিদটি সিকান্দার শাহ তৈরী করেছিলেন।দোতলায় রয়েছে মেয়েদের নামাজ পড়বার জায়গা।মসজিদের চারিদিকে ঘিরে ছিল অতিথিদের থাকার জায়গা।আদিনা থেকে গেলাম একলাখি মসজিদ দেখতে,এর বৈশিষ্ট্য হচ্ছে,লিন্টেলের ওপর হিন্দু দেব-দেবীর মূর্তি খোদাই করা রয়েছে।

পরের দিন সকালে গোসল করে গেলাম জোহুরা কালীবাড়ি।প্রায় চারশো বছরের পুরোনো।এখানকার কালীমুর্তিটি গতানুগতিক কোনও কালীমন্দির নয়।সিঁদুর লেপে তৈরী মুখোশের মতো।মালদহে গেলে অবশ্যই আমার সাথে সাথে চেকে দেখবেন দুই ডাকসাইটে মিষ্টি-কান্সাট আর রসকদম্ব।তবে বলে রাখা ভাল যে সদ্য তৈরী কানসাটের স্বাদই আলাদা।পুরনো হলে এর আসল স্বাদটা বুঝতে পারবেন না।আর যা খাবেন সেটা হল নবাবগঞ্জের বেগুন।লাউ-এর মত দেখতে এই বেগুন খেতে ভারি মিষ্টি।শুধু ভেজে খেলেই ভাল লাগবে।গৌঁড়ের রামকেলি মেলা,কার্তিক পুজোর মেলা,চারু বাবু মেলা,চরক মেলা দেখতে অনেকেই ভীড় জমায়।আসলে ইতিহাসের বাইরে মালদহের স্থানীয় সংস্কৃতিও অনেক সমৃদ্ধ।

কীভাবে যাবেন

ট্রেনে মালদহ পৌঁছানো যায় সহজেই।হাওড়া বা শিয়ালদহ থেকে তো বটেই ভারতের নানা জায়গা থেকেই মালদহ পৌঁছানো যায় সহজেই কলকাতা থেকেন উল্লেখযোগ্য কয়েকটি ট্রেন হল-জন শতাব্দি এক্সপ্রেস,গৌড় এক্সপ্রেস,কাঞ্জনজজ্ঞা এক্সপ্রেস,দার্জিলিং মেল,তিস্তা-তোর্সা এক্সপ্রেস।কলকাতা থেকে মালদহ পর্যন্ত বাস সার্ভিসও আছে তবে ট্রেন ভ্রমণ আরামদায়ক।

কোথায় থাকবেন

থাকার জন্য মালদহে নানা মানের হোটেল আছে।পশ্চিমবজ্ঞ সরকারের ট্যুরিস্ট লজও রয়েছে থাকার জন্য।বুকিং কলকাতা ট্যুরিস্ট অফিস থেকেই করা হয়।

কখন যাবেন

গরম ও বর্ষাকাল বাদে বছরের বাকি সময় মালদহ ভ্রমন করা যেতেই পারে।