ঐতিহাসিক প্রতিশোধ নিলেন শাকিরি-ঝাকা : Zahid Hasan Mithu
বিশ্বকাপ ফুটবল পৃথিবীর বহু জাতির মিলনস্থল, আবার বহু জাতির শত বছরের বৈরীতার লড়াইয়ের আরও এক মঞ্চ। ফুটবল কখনো কখনো খেলার উর্ধ্বে উঠে গিয়ে রাজনৈতিক রূপ লাভ করে। যেমন ১৯৮৬ বিশ্বকাপে ম্যারাডোনা প্রতিজ্ঞা করেছিলেন ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচ জিতে ফকল্যান্ড যুদ্ধে হারের প্রতিশোধ নেবেন। ম্যারাডোনা সেটা সঠিকভাবেই করতে পেরেছিলেন। তবে সুইস ফুটবলার জারদান শাকিরি এবং গ্রানিত ঝাকার বিষয়টি অন্য রকম।
তাদের দেশ সুইজারল্যান্ডের সাথে কোনো বৈরিতা নেই সার্বিয়ার। কিন্তু সার্বিয়ার সাথে বৈরিতা রয়েছে এই খেলোয়াড়দের। গ্রানিত ঝাকা এবং জারদান শাকিরির গোল উদযাপন নিয়ে তুমুল আলোচনা হচ্ছে মাঠ এবং মাঠের বাইরে। সার্বিয়ার বিপক্ষে সুইজারল্যান্ড ২-১ গোলের জয় পেয়েছে গত ২২ জুন। গোল দুইটি করেছেন জারদান শাকিরি এবং গ্রানিত ঝাকা। কিন্তু তাদের গোলের চেয়ে বেশি আলোচিত, সমালোচিত এবং বিতর্কিত হচ্ছে তাদের গোল উদযাপন। তারা দুইজনই গোল করার দুই হাত দিয়ে ঈগলের প্রতিকৃতি তৈরি করেছিলেন। গ্রানিত ঝাকা এবং জারদান শাকিরি দুইজনই আলবেনিয়ান-কসোভিয়ান বংশোদ্ভুত।
আলবেনিয়ার পতাকার ঈগলের প্রতিকৃতি প্রদর্শন করার মাধ্যমে তারা তাদের রক্তে মিশে থাকা আলবেনিয়াকে প্রদর্শন করেছেন। যে সার্বিয়া বলকান যুদ্ধের সময় আলবেনিয়ান মুসলিমদের উপর গণহত্যা চালিয়েছিলো সেই গণহত্যার প্রতিশোধ ফুটবল মাঠে নিয়েছেন তারা দুইজন। জারদান শাকিরি এবং গ্রানিত ঝাকার গোলের উদযাপনের পিছনে রয়েছে হৃদয়বিদারক একটি ইতিহাস। চলুন জেনে নেই শাকিরি ও ঝাকা মাঠে ঠিক কী করেছেন এবং কেন করেছেন।
কী ঘটেছে সুইজারল্যান্ড-সার্বিয়া ম্যাচে
রাশিয়া বিশ্বকাপে ‘ই’ গ্রুপের দুই দল সার্বিয়া এবং সুইজারল্যান্ড গত ২২ জুন কালিনিনগ্রাদ স্টেডিয়ামে মুখোমুখি হয়। সুইজারল্যান্ডের সাথে সার্বিয়ার ঐতিহাসিক কোনো বিরোধ না থাকলেও বিরোধ ছিলো দুই সুইস ফুটবলারের। তারা হলেন জারদান শাকিরি এবং গ্রানিত ঝাকা। বলকান যুদ্ধের সময় তাদের পরিবার বাধ্য হয়েছিল নিজ দেশ কসোভো ছেড়ে সুইজারল্যান্ডে পাড়ি জমাতে। সার্বিয়ার বিপক্ষে তাই শাকিরি এবং ঝাকার কাছে ম্যাচটি অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
তাদের রক্তে বইছিলো প্রতিশোধের আগুন। শাকিরি এবং ঝাকা মাঠে নামেন ঠিক সেভাবেই। শাকিরি তার বুটের একটিতে সুইস পতাকা এবং অন্যটিতে কসোভোর পতাকা লাগিয়ে মাঠে নামেন। কিন্তু ম্যাচের মাত্র ৫ মিনিটেই আলেকজান্দ্রার মিত্রোভিচের গোলে এগিয়ে যায় সার্বিয়া। প্রথমার্ধে ১-০ গোলে পিছিয়ে থাকার পর ৫২ মিনিটে গ্রানিত ঝাকা বক্সের বাইরে থেকে জোরালো শটে সার্বিয়ার জালে বল জড়ান। গোল করার পরই ঝাকা দুই হাত ঈগলের প্রতিকৃতিতে রূপ দিয়ে ছুটে যান সার্বিয়ার দর্শকের দিকে। এরপর ম্যাচটি যখন ১-১ গোলে ড্রয়ের দিকে এগোতে থাকে। কিন্তু নির্ধারিত সময়ের মাত্র ২০ সেকেন্ড আগে জারদান শাকিরি দুর্দান্ত এক গোল করে সুইসদের জয় নিশ্চিত করেন।
গ্রানিত ঝাকার মতো জারদান শাকিরিও গোলের পর দুই হাত দিয়ে ঈগলের প্রতিকৃতি করে গোল উদযাপন করেন। সেখান থেকেই বিতর্ক। ঝাকা এবং শাকিরি তাদের রক্তো মিশে থাকা আলবেনিয়াকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। সেই সাথে তারা দুইজন সার্বিয়াকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন কসোভোতে আলবেনিয়ান মুসলিমদের উপর চালানো গণহত্যার কথা। একে তো মাঠে পরাজয় সাথে, সাথে কসোভোর হয়ে সার্বিয়াকে অপমান।
যেটি মেনে নিতে পারছে না সার্বিয়া। সুইজারল্যান্ড এবং সার্বিয়ার ম্যাচটি এখন রূপ নিয়েছে রাজনৈতিক খেলায়। যেটি পৃথিবী জুড়ে সবচেয়ে বড় এক খেলা।
ঝাকা এবং শাকিরি কেন এমন উদযাপন করলেন?
১৯১৮ সালে সার্বিয়া, মন্টেনিগ্রো, স্লোভেনিয়া, মেসিডোনিয়া, বসনিয়া-হার্জেগোবিনা নিয়ে গঠিত হয় যুগোস্লাভিয়া। এই দেশটিতে আধিপত্য সার্বদের। নব্বইয়ের দশকে বলকান যুদ্ধের সময় সার্বিয়া এবং মন্টেনিগ্রো বাদে বাকি চার দেশ স্বাধীন হয়ে যায়। কিছুদিন সার্বিয়া এবং মন্টেনিগ্রো একসাথে থাকলেও ২০০৬ সালে মন্টেনিগ্রো আলাদা হয়ে যায়। সার্বিয়ার একটি প্রদেশ ছিলো কসোভো, যেখানে আলবেনিয়া, বসনিয়ার বংশোদ্ভুত মুসলিমরা বসবাস করতো।
গ্রানিত ঝাকা এবং জারদান শাকিরি কসোভোর আলবেনিয়ান বংশোদ্ভুত নাগরিক। গ্রানিত ঝাকার জন্ম সুইজারল্যান্ডের বাসেলে। কিন্তু তার বাবা ছিলেন কসোভোর স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতা। ঝাকার বাবা র্যাজিপ ঝাকা কসোভোর প্রিস্টিনা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় ২২ বছর বয়সে আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। কসোভোর আলবেনিয়ান মুসলিমদের ভোটাধিকার কেড়ে নেয় যুগোস্লাভিয়ার কমিউনিস্ট সরকার। তখন কসোভোতে স্বাধীনতা আন্দোলন ছড়িয়ে পড়লে সার্বরা মুসলিমদের উপর গণহত্যা চালায়।
আন্দোলনে জড়িত থাকার কারণে ঝাকার বাবা এবং চাচাকে আটক করে। ঝাকার চাচাকে ১৫ বছরের জেল দেয় যুগোস্লাভিয়া সরকার। অন্যদিকে ঝাকার বাবা র্যাজিপ ঝাকাকে ৬ বছরের জেল দেয় অত্যাচারি সার্বিয়া সরকার। ঝাকার বাবাকে আরও চার জনের সাথে একটি সেলে রাখা হয় এবং দিনে মাত্র একবার ১০ মিনিটের জন্য বের হওয়ার সুযোগ দেওয়া হতো। সাড়ে তিন বছর জেল খাটার পর তাকে মুক্তি দেওয়া হয়।
জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পর ১৯৯০ সালে ঝাকার পরিবার সুইজারল্যান্ডে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় গ্রহণ করে এবং ১৯৯২ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর সুইজারল্যান্ডের বাসেলে গ্রানিত ঝাকার জন্ম হয়। শরণার্থী শিবিরে সংগ্রামী জীবন-যাপন করে বেড়ে উঠেন গ্রানিত ঝাকা এবং তার ভাই-বোন। ঝাকার বাবার স্বপ্ন ছিলো তার ছেলেরা ফুটবল মাঠে সার্বিয়াকে হারিয়ে দেশান্তরিত করার প্রতিশোধ নিবেন। অবশেষে গত ২২ জুন গ্রানিত ঝাকা বাবার স্বপ্ন পূরণ করেছেন। গ্রানিত ঝাকার বড় ভাই তাওল্যান্ত ঝাকাও পেশাদার ফুটবলার। তিনি এফসি বাসেল এবং আলবেনিয়া জাতীয় দলের হয়ে খেলেছেন।
অন্যদিকে জারদান শাকিরিও ছিলেন আলবেনিয়ান বংশোদ্ভুত কসোভোর নাগরিক। তার জন্ম ১৯৯০ সালের ১০ অক্টোবর কসোভোর জিলানে। তিনি তার বাবা ইসেন শাকিরি এবং মা ফাতিমে শাকিরি। বাবা- মা এবং ভাইবোনদের সাথে তিনিও শরণার্থী হিসেবে সুইজারল্যান্ডে আসেন। তার মা ছিলেন ছিলেন পরিচ্ছন্নতা কর্মী এবং বাবা ছিলেন অ্যালপাইন ফার্মের কৃষক।
অন্য সকল শরণার্থীর মতো শাকিরির বাবাও তার তিন ছেলেকে স্থানীয় ফুটবল ক্লাব এসভি আগস্টে ভর্তি করিয়ে দেন। কারণ অনেকেই ফুটবল খেলে দারিদ্রতাকে মুক্তি পেয়েছেন। পরবর্তী শাকিরি তার ফুটবল প্রতিভা দিয়ে ক্লাবের মন জয় করেন এবং খুব দ্রুত এফসি বাসেলে খেলার সুযোগ পান। এরপর এফসি বাসেল থেকে সুইজারল্যান্ডের জাতীয় দলের হয়েও খেলার সুযোগ পান।
জারদান শাকিরি এবং গ্রানিত ঝাকার পরিবার সার্বিয়ার কারণে কসোভো থেকে বিতাড়িত হন। সার্বিয়ার সেই অত্যাচার আজও ভুলতে পারেননি শাকিরি এবং ঝাকা। তাই গত ২২ জুন সার্বিয়ার বিপক্ষে গোল করে তারা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন নিজেদের শেকড়কে।
কী হতে পারে এখন?
ইতিমধ্যে সার্বিয়ান ফুটবল ফেডারেশন শাকিরি এবং ঝাকার বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিকভাবে অভিযোগ করেছেন। অভিযোগ জানানোর পর তদন্তে নেমেছে ফিফা।
ফিফা মনে করছে শাকিরি এবং ঝাকার গোল উদযাপনের ভঙ্গিমা ফুটবলে মাঠে রাজনীতির বহিঃপ্রকাশ যা ফিফার নিয়ম বিরুদ্ধ। তবে ঝাকা ম্যাচ শেষে বলেন,
এই জয়টা আমি উৎসর্গ করছি আমার পরিবার, সুইজারল্যান্ড, আলবেনিয়া এবং কসোভোকে। আমার উদযাপনের ভঙ্গিমা ছিলো তাদের জন্য যারা আমাদের সমর্থন করেন। এটা আমাদের প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে ছিলো না। এটা সত্যি একটা আবেগী ম্যাচ ছিল।
অন্যদিকে শাকিরি বলেন,
এটার সাথে রাজনীতির কোনো সম্পর্ক নাই। এটা শুধুই ফুটবল।
তবে ফিফা তদন্তের পর যদি রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়ে গোল উদযাপনের প্রমাণ পায়, তাহলে তাদের দুইজনকে দুই ম্যাচের জন্য নিষিদ্ধ করতে পারে ফুটবলের সর্বোচ্চ সংস্থা। তবে তদন্ত শুধু শাকিরি এবং ঝাকার বিরুদ্ধে হচ্ছে না, তদন্ত সার্বিয়ার কোচের বিরুদ্ধেও হচ্ছে।
Featured Image : rt.com
SOURCE: KHELA.CO