কাজী জহিরুল ইসলামের ধারাবাহিক ভ্রমণ কাহিনী – কসোভোর পথে-প্রান্তরে। ।।দুই।।

হোটেলের গেটেই ট্যাক্সি দাঁড়ানো, সোজা বুকিত বাতক, আলম ভাইয়ের বাসায়।

বুকিত শব্দের অর্থ পাহাড়। বাতক অর্থ ঠিক জানি না, তবে বুকিত বাতক-এর পুরো ইংরেজি অর্থ একসঙ্গে হল কফিং হিল। কফিং হিল মানে কি? যে ইমেজটি আমার চোখের সামনে ভেসে উঠছে তা হলো একটি বুড়ো পাহাড় খুক খুক করে কাশছে। কারণ এই পাহাড়ের বুক চিরে গড়ে তোলা হয়েছে অসংখ্য বহুতল দালান। পাহাড়ের ঢালে, খাঁজে সুকৌশলে কেটে-কুটে কায়দা করে সিঙ্গাপুর সরকার তৈরী করছে অসংখ্য বহুতল এপার্টমেন্ট। চারতলা থেকে চৌদ্দ-পনেরো তলা পর্যন্ত উচ্চতা এসব দালানের।
বেশ অনেকক্ষণ ধরে দরোজার ঘণ্টা বাজাতে হলো। দরোজা খুললেন আলম ভাই। মাথার তিনদিকে কোঁকড়ানো চুল, মাঝখানটার চকচকে টাক, টকটকে গায়ের রঙ, মুখশ্রীতে একটা নারীসুলভ কোমল মায়া মাখানো। হিন্দু পুরাণে আছে কোনো পুরুষের মুখে যদি নারীসুলভ মায়াময় আভা বিকির্ণ তাহলে সে পুরুষ হয়ে ওঠে দেবতা আর কোনো নারীর মুখে যদি পুরুষালী ভাবের আভাস দেখা দেয় তাহলে সেই নারী হয় ব্যাভিচারিণী। আলম ভাই দেবতা কি-না জানি না, তব কিছু মানুষ আছে যাদেরকে প্রথম দর্শনেই ভালো লেগে যায়, তিনি সেই রমক একজন মানুষ।
প্রথমে কলাপসিবল গেইট, তারপর এপার্টমেন্টের মূল দরোজা এবং এটিও স্টীল প্লেটেড। এতো জোরদার নিরাপত্তা ব্যবস্থার কারণ কি? জিজ্ঞেস করতেই আলম ভাই জানালেন, ইদানিং সিঙ্গাপুরে মাফিয়া চক্রের বেশ প্রভাব বেড়েছে। কালোরাই এ-কাজগুলো করে বেশি।
চমৎকার এবং বিশাল এপার্টমেন্ট। বসার ঘরটি একটি ছোটখাটো অডিটোরিয়ামের মতো, দুটি বড় বড় শোবার ঘর, বিশাল রান্নাঘর, এক চিলতে বারান্দা এবং দুটি বাথরুম। পাঁচ লক্ষ সিঙ্গাপুরী ডলার দিয়ে আলম ভাই কিনেছেন এটি। অবশ্য এজন্য তাকে কোনো নগদ অর্থ প্রদান করতে হয়নি, মাসে মাসে ওর বেতন থেকে কেটে নেওয়া হয়। আলম ভাই জানালেন, সিঙ্গাপুরের সমস্ত আবাসন ব্যবস্থা এবং আবাসন ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করে সরকারী কোম্পানী।
ভাবছি বাংলাদেশ সরকারও কেনো অনুরূপ প্রকল্প হাতে নেয় না। স্বল্প আয়ের সরকারী চাকুরে, যারা সরকারী বাসা পায় না এবং ঢাকা শহরে চাকরী করে তাদের বেতনের সিংহভাগ চলে যায় বাড়িওয়ালার পকেটে। দেশে প্রচুর বেসরকারী হাউজিং কোম্পানী থাকলেও ওদের বাহারী ঢঙয়ের বিজ্ঞাপনের রঙিন মোড়কের আড়ালে একেকটি ফ্লাটের যে দাম ধরা থাকে তা মধ্যবিত্তের নাগালের অনেক বাইরে। ঋণ সুবিধার ফানুশটিও মধ্যবিত্তের রক্ত চুষে খাওয়ার মহাজনী ব্যবসার আধুনিকায়ন। সরকারের পক্ষেই কেবল সম্ভব ঢাকা শহরের আশে পাশের উপশহরগুলোতে প্রচুর পরিমান স্বল্প পরিসরের নির্দিষ্ট উচ্চতার দালান তুলে তা সুলভ কিস্তিতে, অন্তত সরকারী কর্মচারীদের মধ্যে, বিতরণ করা। একজন সরকারী কর্মচারী যদি চাকরীতে যোগদান সাথে সাথে একটি বাসস্থানের নিশ্চয়তা পায় তাহলে আমাদের বহুল আলোচিত সরকারী অফিসের স্থবিরতা অনেকটাই কমে যাবে বলে আমরা বিশ্বাস।
বাসায় ঢুকতেই আলম ভাইয়ের প্রথম প্রশ্ন: নাশ্‌তা করেছো? “করিনি” বোখারী জানাতেই তিনি কিচেনে ঢুকতে ঢুকতে বললেন, তোমাদের দেরী দেখে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। আমার একটি অব্যক্ত প্রশ্নের উত্তর পেলাম তার এ কথায়, পাঁচবার দরোজার ঘণ্টা বাজিয়েছিলাম আমরা। পনেরো মিনিটের মধ্যে তিনি কিচেন থেকে বেরিয়ে এলেন, হাতের ট্রেতে টোষ্ট করা অনেকগুলো মুরগীর সেন্ডুইচ। আমি বসে গেলাম কম্পিউটারে, সেন্ডুইচ খেতে খেতে দেশে একটি ই-মেইল পাঠালাম। হটমেইল-এ একটি নতুন একাউন্ট খুলতে চাইলাম, পারলাম না, কম্পিউটার বৈরী আচরণ করছে।
নাশ্‌তা সেরে পরিতৃপ্তির ঢেকুর তুলতে তুলতে চায়ের কাপে চুমুক দিলাম। আলম ভাই আমাদের শোবার ঘর দেখিয়ে বললেন, তোমরা ঘুমাও। দুপুরের খাবার খেয়ে বেড়াতে বেরুবো। “তথাস্তু” মনে মনে বলে শুয়ে পড়লাম।
ঘুম থেকে উঠে এ বাড়ির দ্বিতীয় এবং তৃতীয় মানুষের সাথে পরিচয় হলো। হেলেন ভাবী এবং তার মেয়ে শ্রাবণী, আরো দুজন সুন্দর মানুষ। ভাবী একটি স্কুলে কাজ করেন, শ্রাবণী পড়ে দশ ক্লাশে। এখানকার স্কুলে পড়াতে হলে শুধু ভাষা জানলেই হবে না, পরীক্ষা দিয়ে সরকারী সনদ অর্জন করতে হয়। অতি সম্প্রতি ভাবী তা পেয়েছেন। আমার ব্যর্থতা ঘুচিয়ে দিলো শ্রাবণী, ওর সাহায্য নিয়ে হটমেইলে একাউন্ট খুললাম।
মধ্যহ্নভোজনের বিশাল আয়োজন। চিকেন, বিফ না বলে বোধ হয় বলা উচিত গরুর রেজালা, মুরগী ভুনা এবং মাছের মাথা দিয়ে মুগ ডালের মুড়িঘণ্ট। এ ছাড়া আছে আমার অতি প্রিয় করল্লা ভাজি। আহ কি-যে ভালো লাগছে। গত চৌদ্দ-পনেরো ঘণ্টা ধরে লবণ-মরিচ ছাড়া খাবার খেয়ে হাঁপিয়ে উঠেছিলাম। শুধু পেট পুরে না, একটু যেন বেশীই খেয়ে ফেললাম, মাছের মুড়িঘণ্টটা হয়েছে অসাধারণ। বাঙালী হয়ে জন্মেছি বলে মনে মনে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিলাম। বাঙালী ছাড়া এ রকম পরিতৃপ্তির রসনা ব্যাঞ্জন এ নিখিল ধরণীতে আর কে পারে তৈরী করতে। হে ঈশ্বর, এই ব্যাঞ্জনের স্বাদ আস্বাদনের জন্য তুমি আমাকে আজীবন বাঙালী করে রেখো।
খেয়ে-দেয়ে বিকেল তিনটার বেরিয়ে পড়লাম সিঙ্গাপুর দর্শনে। স্মার্ট বালিকা শ্রাবণী পিঠে ক্যানভাসের ব্যাগ ঝুলিয়ে চলে গেছে ওর বৈকালিক স্কুলে। অতএব এখন আমরা চারজন, আলম ভাই, ভাবী, বোখারী এবং আমি। ভুল করে আলম ভাইয়ের বাসায় এই মুহূর্তের সবচেয়ে প্রয়োজনীয় বস্তু ক্যামেরাটি ফেলে এসেছি। ভাবী মনে করিয়ে দিতেই আমি এবং আলম ভাই ছুটলাম ক্যামেরা আনতে।
হাত তুলতেই ট্যাক্সি দাঁড়ালো। মাথায় লাল পাগড়ি পরা মুখ ভর্তি দাড়ি-গোঁফের এক পাঞ্জাবী ড্রাইভার। আলম ভাই সামনের সীটে, আমরা তিনজন পেছনে। ক্লাচ রিলিজ করে ড্রাইভার তাকালো আলম ভাইয়ের দিকে, ‌ওকে প্রশ্ন করার কোনো রকম সুযোগ না দিয়েই আলম ভাই বললেন, মুস্তফা চলো ভাই। আমাদের সর্দারজী কিছুটা মনক্ষুন্ন হয়ে বললেন, ম্যায় মুস্তফা নেহি সাব, ম্যায় মুজরাবা সিং, আপলোগ কাহা জায়েগি? একথা শুনে পেছনের সীট থেকে ভাবী এবং বোখারী হো হো করে হেসে উঠলেও আমি এই রসিকতার কিছুই বুঝলাম না। আমাকে নির্বিকার দেখে বোখারী ঘটনাটি বুঝিয়ে বললো। ওকে মুস্তফা বলেননি আলম ভাই, বলেছেন আমাদেরকে মুস্তফায় নিয়ে যেতে। মুস্তফা এখানকার একটি বিখ্যাত সুপারমার্কেটের নাম।
সর্দারজীদের মাথা যে কিছুটা মোটা হয়ে থাকে এ বিষয়ে প্রচুর গল্প আছে। এই মুহূর্তে সর্দারজী বিষয়ক একটি বহুল প্রচলিত গল্প মনে পড়ছে আমার। একজন উচ্চপদস্থ সরকারী কর্মকর্তা, অবশ্যই সর্দারজী, একটি আন্তর্জাতিক সভায় যোগদানের জন্য গেছেন নিউইয়র্কে। সভায় যোগ দিতে আসা অন্য সকলের মতো তিনিও অবস্থান করছেন একটি পাঁচতারা হোটেলে। সভা শুরু হওয়ার মিনিট পনেরো আগে তাকে হোটেল লবির একটি সোফায় বসে থাকতে দেখে যুক্তরাজ্যের প্রতিনিধি মি. স্মিথ জিজ্ঞেস করলেন, আর ইউ রিল্যক্সিং? জবাবে সর্দারজী জানালেন, নো, আই এম বলদেভ সিং।
আমাদের মুজরাবা সিংয়ের ট্যাক্সি ছুটছে মুস্তফার দিকে। দুপুর আর বিকেলের মাঝখানে এক চিলতে ফাক, এক ঝলক রুদ্র আলোর অনুরণন। সেই আলো হঠাৎ ঢাকা পড়েছে এক খণ্ড মেঘের আড়ালে। ট্যাক্সির কাচের ফাক গলে আমার দৃষ্টিতৃষ্ণা আলো-আধারির লুকোচুরি উপেক্ষা করে পান করেছ ছ’শ তিরাশি বর্গ কিলোমিটারের এই ক্ষুদ্র দেশটির অপূর্ব সৌন্দর্য সুধা। প্রায় ইকুয়েটরের ওপর শুয়ে থাকা ক্ষুদ্র এই দেশটিকে ঈশ্বর তেমন কোনো প্রাকৃতির সম্পদ না দিলেও কঠোর পরিশ্রম, অধ্যবসায় আর রাজনৈতিক দক্ষতা দিয়ে এর একচল্লিশ লক্ষ দেশপ্রেমিক মানুষ আজ সিঙ্গাপুরকে গড়ে তুলেছে এশিয়ার দেবীতুল্য অথনৈতিক শক্তিতে। গড়ে প্রতি বর্গ কিলোমিটারে ছয় হাজার লোক বাস পৃথিবীর সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ এই দেশটিতে। মাথাপিছু আয় প্রায় একুশ হাজার মার্কিন ডলার। বিভিন্ন ধর্ম ও বর্ণের মানুষের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান একটি অন্যতম বিশেষ বৈশিষ্ট এই ভূ-খণ্ডের।
জনসংখ্যার ছিয়াত্তুর শতাংশ চায়নীজ, পনেরো শতাংশ মালাওয়ী, ছয় শতাংশ ভারতীয় এবং বাকীরা অন্যান্য বিভিন্ন গোত্র ও সম্প্রদায়ভুক্ত। ধর্মীয় দিক থেকে সবচেয়ে বেশি লোক বুদ্ধের অনুসারী, মোট জনসংখ্যার বিয়াল্লিশ শতাংশ বৌদ্ধ। মুসলমান এবং খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বী মানুষের সংখ্যা প্রায় সমান, শতকরা পনেরো জন মুসলমান আর চৌদ্দজন খ্রীষ্টান। এছাড়া আছে হিন্দু, শিক, তাওয়ীষ্ট প্রভৃতি ধর্মের অনুসারী প্রচুর মানুষ।
সিঙ্গাপুরের প্রায় সকলেই ইংরেজীতে কথা বললেও অন্যান্য উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ভাষাভাষীদেরকে সম্মান প্রদর্শন ও গুরুত্ব প্রদানের লক্ষ্যে ইংরেজীর পাশাপাশি মালে, ম্যান্ডারিন এবং তামিল ভাষাকেও সরকারিভাবে দাপ্তকির ভাষার মর্যাদা প্রদান করা হয়েছে।
সেরাঙ্গুন নামক একটি স্থানে ঢুকতেই মনে হলো ঢাকা শহরের কোনো নাম না জানা মহল্লায় ঢুকে পড়েছি। রাস্তার রঙটা পর্যন্ত বদলে গেছে। দেয়ালে পানের পিক, চুনের দাগ, রাস্তায় পোড়া সিগারেটের টুকরা, ময়লা লুঙ্গি-পাঞ্জাবী পরা পথচারী। একটু সামনে এগুতেই দেখি ডানপাশে কালো রঙের একটি উদ্ভট দালান, তাতে লেখা মুস্তফা।
আগেই বলেছি মুস্তফা কোনো শহর, মহল্লা কিংবা স্ট্রীটের নাম না, মুস্তফা একটি দোকান, একটি সুপারমার্কেট। বর্তমানে যে দোকানটি দুটি বহুতল দালানে সম্প্রসারিত। মাছ, মাংস, তরি-তরকারি, চাল, ডাল থেকে শুরু করে ইলেক্টনিক্স, জুয়েলারী, হেয়ার ড্রেসিং, একোমোডেশন, মানি চেঞ্জ, বিমানের টিকিট হেন কিচু নেই যা মুস্তফায় পাওয়া যায় না। একজন মানুষ প্লেন থেকে নেমে একটি ট্যাক্সি নিয়ে মুস্তফায় চলে এসে একমাস থেকে আবার ট্যাক্সি নিয়ে চাঙ্গি বিমানবন্দরের প্লেন ধরে স্বাচ্ছন্দে ফিরে যেতে পারবে। এই সময়ে সে যদি মুস্তফার বাইরে যেতে না চায়, তার কোনো অসুবিধা হবে না, মুস্তফা এতোটাই সমৃদ্ধ। যিনি এর প্রতিষ্ঠাতা তাঁর নাম মুস্তফা। একজন ভারতীয় মুসলমান। আজও বেঁচে আছেন ভদ্রলোক। আজ থেকে প্রায় পঁচিশ বছর আগে এক কামরার একটি দোকান ঘর আর একটি পুরোনো গাড়ি নিয়ে মুস্তফার যাত্রা শুরু হয়েছিলো, সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে ভাগ্যের চাকা ঘুরে আজ মুস্তফা সিঙ্গাপুরের একটি জনপ্রিয় ও প্রসিদ্ধ সুপার মার্কেট। সবকিছু জানার পর গর্বে আমার বুকটা উঁচু হয়ে উঠলো, এই কঠোর পরিশ্রমী মানুষটি একজন মুসলমান এবং আমাদেরই অঞ্চলের। উপমহাদেশীয়রা সিঙ্গাপুরে এলে মুস্তফায় একবার যাবেনই, মুস্তফা যেন সিঙ্গাপুরে আজ আমাদের তীর্থে পরিণত হয়েছে।
ঘণ্টা দুয়েক মুস্তফায় ঘোরাঘুরি করে টুকটাক কিছু জিনিসপত্র কিনলাম, স্বর্ণের দাম দেখলাম, অল্প কিছু ডলার ভাঙিয়ে ডয়েসমার্ক নিলাম। কারণ কসোভোতে লিগ্যাল কারেন্সি হিসাবে একমাত্র ডয়েসমার্কই সচল মুদ্রা, অথচ কোনো ব্যাংককিং সেটআপ নেই বলে ডলার ভাঙানো যাবে না। মুস্তফার বিশাল পেটের ভেতরে গোলক ধাধার মতো চক্কর খেতে খেতে কখন যে বোখারীকে হারিয়ে ফেলেছি টেরই পাইনি। যখন টের পেলাম তখন সত্যিই অনেক দেরী হয়ে গেছে। আরো প্রায় দশ মিটিন নষ্ট করলাম মুস্তফার ভেতরে পাগলের মতো ওকে খুঁজতে খুঁজতে। আলম ভাই এবং ভাবী আমাদেরকে মুস্তফায় ঢুকিয়ে দিয়ে অন্য কোথাও চলে গেছেন। বলে গেছেন ঠিক পাঁচটায় মুস্তফার গেটে ফিরে আসবেন। বিয়ের পর আমার প্রথম জন্মদিনে মুক্তির উপহার দেওয়া সুইস্টার ঘড়িটার গোল্ডেন ডায়ালে চোখ রেখে আমি রীতিমতো ঘামতে শুরু করেছি। ছয়টা বেজে কুড়ি মিনিট। সুপারমার্কেট থেকে বেরুতে বেরুতে প্রায় সাড়ে ছয়টা। যা হবার তাই হয়ত হয়েছে, আমাকে ফেলে ওরা চলে গেছে। আশে পাশে কাউকে দেখছি না। প্রায় সাতটা পর্যন্ত স্থানুর মতো দাঁড়িয়ে আছি, কারো কোনো টিকির সন্ধানও নেই।
চীনের সর্বশেষ রাজা সিংহাসনচ্যুত পু ই, নেতা মাওয়ের কারাগার থেকে বেরিয়ে যখন সে দেশের বোটানিক্যাল গার্ডেনের উপদেষ্টা নিয়োজিত হয়েছিলেন তখন তিনি ঠিক আমার আজকের দশায় পড়েছিলেন। যেহেতু চল্লিশ বছর চীনের রাজ সিংহাসনের বসে রাজদন্ডের যাদুস্পর্শে দেশ চালিয়েছেন, একজন সাধারণ নাগরিকের প্রাত্যহিক জীবনের কোনো অভিজ্ঞতাই তাঁর ছিলো না। একদিন তিনি তাঁর এক আত্মীয়ের সাথে অন্য এক শহরে যাচ্ছিলেন। যেতে হবে বাসে চড়ে। বাসস্ট্যান্ডে অপেক্ষা করছেন দুজনই। বাস এসে থামলে তাঁর আত্মীয়টি দ্রুত বাসে উঠে পড়েন কিন্তু তিনি বাসে ওঠার আগেই বাস ছেড়ে দেয়। প্রথমত, তিনি জানেন না তিনি কোথায় যাবেন, আর দ্বিতীয়ত, টাকা পয়সার হিসাব নিকাশ বোঝেন না বলে তার কাছে কোনো টাকা পয়সাও নেই। এখান থেকে যে নিজের বাড়িতে ফিরে যাবেন সেটাও তার পক্ষে ছিলো এক দুরূহ কার্য। সুতরাং তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন এখানে দাঁড়িয়ে থাকাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে, তাঁর আত্মীয়টি নিশ্চয়ই ফিরতি বাস ধরে ফিরে আসবেন। হলোও তাই। কিছুক্ষণের মধ্যেই তাঁর আত্মীয় ফিরে এলেন। এসেই রাজা পু ইকে জিজ্ঞেস করলেন,
আপনি বাসে উঠলেন না কেনো?
জবাবে তিনি বললেন, আমি উঠতে যাবো ঠিক এমন সময় এক মহিলা আমার পাশে এসে দাঁড়ালো, আমি ওকে পথ ছেড়ে দিলাম।
পথ ছেড়ে না দিয়ে আপনি ওর আগে বাসে উঠলেন না কেনো?
তুমিই না বললে, মহিলাদের সম্মান করতে হয়, মহিলা দেখলে পথ ছেড়ে দিতে হয়।
কিন্তু ওই মহিলাটিতো ছিলো বাসের কন্ডাক্টর।
যাই হোক রাজা পু ইয়ের গল্পে তার আত্মীয় তাকে উদ্ধার করতে ফিরে এলেও আমাকে উদ্ধার করতেতো কেউই আসছেন না। আরো কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে বুঝে গেলাম আমাকে উদ্ধারের জন্য কেউ আসবে এ আশা ছেড়ে দেওয়াই ভালো। আর আসবেই বা কেনো, আমিতো আর রাজা পু ইয়ের মতো অসাধারণ কেউ নই, আমি সাধারণ মানুষ, সাধারণ জ্ঞান-বুদ্ধি অবশ্যই আমার থাকা উচিত। এখান থেকে উদ্ধার পাওয়ার জন্য যেটুকু বুদ্ধি দরকার সেটাকে সাধারণ বুদ্ধির পর্যায়ে ফেলে একটা উপায় বের করার চেষ্টায় মস্তিষ্ককে নিয়োগ করলাম। সবগুলো পকেট হাতড়ে, ওয়ালেটের সর্বত্র খুঁজেও কপথর্ণকিংয়ের কোনো বিজনেস কার্ড পেলাম না। পরিস্থিতি কি ক্রমশ জটিল হয়ে উঠেছে? প্রশ্নটা কাকে করলাম নিজেও বুঝে উঠতে পারছি না।
এগারোটায় ফ্লাইট, নয়টার রিপোর্টিং, এখন বাজে সাতটার ওপরে। হাত দুঘণ্টার কম সময়। এই সময়ের মধ্যে হোটেলে ফিরে গিয়ে লাগেজ নিয়ে এয়ারপোর্টে পৌঁছুতে হবে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকলে দুঘণ্টা যথেষ্ট সময় ছিলো। কিন্তু আমি হারিয়ে গেছি এবং এই লজ্জার কথা কাউকে বলাও যাবে না সুতরাং সময় অপ্রতুল। ঝটপট একটি সিদ্ধান্তে আসতে হবে আমাকে। হাতের হালকা পলিথিনের ব্যাগটাকেও এখন অসম্ভব ভারী মনে হচ্ছে, ভারী মনে হচ্ছে আমার পা দুটোকেও, শুধু সময়টা যেন অসহ্য রকামের হালকা হয়ে উঠেছে, উড়ে উড়ে চলে যাচ্ছে নাগালের বাইরে।
এই অচেনা শহরের সমস্ত সৌন্দর্য ক্রমশ ম্লান হয়ে আসছে। আমার কাছে কোনো ঠিকানা নেই। শুধু হোটেলের নামটা জানি, কপথর্ণকিং। নাম বললেই কি ট্যাক্সিওয়ালারা চিনবে? অবশ্য একটা সমাধান আছে, টিকিট-পাসপোর্ট যেহেতু আমার সাথেই রয়েছে, সোজা একটি ট্যাক্সি নিয়ে এয়ারপোর্টে চলে যেতে পারি। কিন্তু লাগেজ? আমার আগামী ছয়মাসের যাবতীয় প্রস্তুতি, পরম যত্নে একটি একটি জিনিস করে স্যুটকেসে গুছিয়েছে মুক্তি, আমার প্রিয়তমা স্ত্রী। সেই লাগেজ ফেলে আমি কিছুতেই যেতে পারবো না।
পীতবর্ণের কাবলী পোশাক পরা একজন মাঝবয়েসী লোক আমার দিকে এগিয়ে আসছে। ও কি বুঝতে পেরেছে আমার অসহায়ত্ব, আমি কি ওকে সব খুলে বলবো?
ডু ইউ নিড এনি হেল্প স্যার? আই স ইউ আর স্ট্যান্ডিং হেয়ার ফর হাফ এন আওয়ার, আর ইউ ওয়েটিং ফর সামওয়ান?
ইয়েস…. নো, নো….নো…
ডু ইউ নিড এ্যা ট্যাক্সি?
ইয়েস, আই ডু।
ওর পেছনে পেছনে গিয়ে একটি পুরোনো টয়োটা করল্লার পেছনের সীটে বসলাম।
কাঁহা জানা হ্যায়, এবার সে উর্দূ বলছে।
আমি বললাম,হোটেল কপথর্ণকিং।
সে আর কোনো প্রশ্ন না করে গাড়ী স্টার্ট দিলো। প্রায় আধঘণ্টা ধরে সিঙ্গাপুর শহরের নানান ছোট রাস্তা, বড় রাস্তা ঘুরে, নানান ট্রাফিক সিগন্যালে থেমে অবশেষে যে বহুতল দালাননটি সামনে এসে গাড়ী থামালো এটা মোটেও কপথর্ণকিং নয়। তবে কি আমি কোনো ফ্রডের পাল্লায় পড়লাম? লক্ষ্য করেছি ও গাড়ীর মিটার চালু করেনি। উদ্দেশ্য কি লোকটার, টাকা পয়সা চাইবে, ছুরি-টুরি মারবে না-তো? আলম ভাই বলেছিলেন ইদানিং মাফিয়া চক্রের বেশ প্রভাব বেড়েছে।
গাড়ীর পেছনের দরোজা খুলে ও আমাকে নামতে বলছে। এখন আর ওর চোখে সেই পরোপকারী ভাবটা নেই, বরং সেখানে এখন লোভের গনগনে আগুন। আমি কি প্রতিবাদ করবো? ধমকে উঠে বলবো “এ আমাকে তুমি কোথায় নিয়ে এসেছো, আমিতো কপথর্ণকিং হোটেলে যাবো বলেছি, জানো এ হয়রানীর জন্য আমি তোমাকের পুলিশে দিতে পারি?” কিন্তু যদি ওর কাছে পিস্তল থাকে, যদি গুলি মেরে দেয়? আমার মুখ থেকে কোনো কথা সরছে না, জিহ্বা আড়ষ্ঠ হয়ে আসছে।
আমি নিঃশব্দে মন্ত্রমুগ্ধের মতো ওর ইশারা অনুসরণ করে গাড়ী থেকে নেমে এলাম। একটা অন্ধকার প্যাসেজ ধরে এগিয়ে গিয়ে লিফটে চড়লাম। আশে-পাশে কোনো মানুষ নেই, জনমানবশূন্য নির্জন একটি অফিসপাড়া বলে মনে হচ্ছে এ জায়গাটিকে। একুশ নম্বর ফ্লোরের বোতামে চাপ দিলো লোকটি। লিফট থেকে নেমে আরো একটি অন্ধকার প্যাসেজে পা রাখলাম। পঁচিশ-ছাব্বিশ কদম হাঁটার পর একটি দরোজার কলিং বেলে চাপ দিলো সে। দুবার চাপ দিতেই দরোজা খুলে গেলো। বছর কুড়ি বয়সের এক ছিপছিপে তরুণী দরোজা খুললো। ওর মুখে মেদের কোন ছিটে ফোটা নেই বলে টিপিক্যাল সিঙ্গাপুরীদের চেয়ে কিছুটা শার্প লাগছে। ঘরে ঢুকতেই শ্যানেল ফাইভের ভুরভুরে গন্ধ এসে নাকে লাগলো। লোকটির উদ্দেশ্য এবার আমার কাছে কিছুটা পরিষ্কার হলো, সম্ভবত সে এই মেয়েটির দালাল এবং এই মেয়েটি একজন পতিতা।
নিজেদের মধ্যে সিঙ্গাপুরের কোনো একটি আঞ্চলিক ভাষায় কি সব বললো ওরা, তারপর লোকটি বেরিয়ে গেলো। আমি ওর পেছন পেছন ছুটে বেরিয়ে যেতে চাইলে মেয়েটি পেছন থেকে আমাকে একরকম খামচে ধরলো, ঠিক যেভাবে শিকারী চিল তার খাবার আঁকড়ে ধরে। কোনো এক অলৌকিক উপায়ে ধীরে ধীরে আমার ভয় কমতে শুরু করেছে, হয়ত আমার অবচেতন মন বলছে এক রত্তি একটি মেয়ে, এতো ভয় পাবার কি আছে? দরোজা বন্ধ করে দিয়ে সে আমাকে এণ্টারটেইন করার প্রস্তুতি নিতে শুরু করলো। একটা দুশ্চিন্তা অন্তত গেছে, আমি কোনো ডাকাতের পাল্লায় পড়িনি। এখন কায়দা করে এই মেয়েটিকে পটিয়ে এখান থেকে বের হতে হবে এবং তা করতে হবে অতি দ্রুত। ঘড়ি দেখে নিলাম, সাতটা পঁয়ত্রিশ অর্থাৎ রিপোর্টিংয়ের এখনো প্রায় দেড় ঘণ্টা বাকী। যদিও আমি জানি না কপথর্ণকিং থেকে এখন আমি কতোটা দূরে কিন্তু আমার ইনার সেন্স বলছে খুব কাছেই আছি।
মনে মনে পরবর্তী অ্যাকশনের প্রস্তুতি নিতে শুরু করলাম। ওকে শারীরিকভাবে ঘায়েল করে এখান থেকে বেরিয়ে যাওয়ার চিন্তাটা একেবারেই মুর্খতা হবে। কাজ সারতে হবে কৌশলে। মেয়েটি ইতোমধ্যেই ওর শরীরের ওপরের অংশ অনাবৃত করে ফেলেছে। আমার বোধ হয় আর নীরব দর্শক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ঠিক হবে না। এর চেয়ে বেশি কিছু দেখার কোনোরকম ইচ্ছে আমার নেই। বিছানার ওপর থেকে, এইমাত্র ওর গা থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া ঘিয়ে রঙের শার্টটি তুলে এনে ওর অনাবৃত বক্ষদেশ ঢেকে দিয়ে খুব দৃঢ় একটি ধমক কষে বললাম, “ওয়্যার ইট”। ধমকে কাজ হলো। সুবোধ বালিকার মতো সে দ্রুত জামাটি পরে নিলো।
মেয়েটির সাইকোলোজি সম্ভবত আমি বুঝে ফেলেছি। আমাকে নরোম হলে চলবে না, গরম থেকেই কাজ সারতে হবে।
হাউ মাচ ডু ইউ চার্জ?
আমার এ প্রশ্নের কোন উত্তর দিলো না ও। সম্ভবত সে-ও আমার মাইন্ড রিড করছে। এরকম আগুনবতী নারীর শরীর যে পুরুষ দেখতে চায় না তার প্রতি ওর আগ্রহও কমে গিয়ে থাকতে পারে, নপুংশক ভাবাটাও বিচিত্র কিছু নয়। তীক্ষ্ণ এবং প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে ও এখন দেখছে আমাকে। ওর দৃষ্টিতে কিছুটা তাচ্ছিল্যের ভাবও স্পষ্ট। আমি কণ্ঠ নামিয়ে আনলাম, হোয়াটস ইওর নেইম? ও কোনো কথা বলছে না। আই’ল পে ইউ, ডোন্ট ওয়ারি। ওকে আয়ের নিশ্চয়তা দিতে চাইলাম। এতেও কাজ হলো না। স্থির ভাস্কর্য হয়ে গেছে। ওর সাথে নাটক করলে আমার চলবে না, আমাকে যেতে হবে। প্রথমে কপথর্ণকিং তারপর চাঙ্গি এয়ারপোর্টে। হাতে সময় খুবই কম।
আমি যখন একুশতলা ফ্লাটের জানালা দিয়ে রাতের ঝলমলে সিঙ্গাপুরের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলছি “অভিশপ্ত নগরী”। ঠিক তখনি আমার ঘাড়ের কাছ থেকে মেয়েটি বলে উঠলো হয়ার ডু ইউ কাম ফ্রম
মেয়েটির কিন্নর কণ্ঠ আমাকে ওর প্রতি আগ্রহী করে তুললো। আমি বললাম, বাংলাদেশ।
আর সাথে সাথে আমাকে যুগপৎ অবাক করে দিয়ে সে ঢুকরে কেঁদে উঠলো। একজন বেশ্যার কান্নাকে প্রশ্রয় দেয়া মোটেও বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। আমি ক্রমশ বোকা হতে থাকলাম, এবং এক পর্যায়ে সম্ভবত চুড়ান্ত বোকামীটাই করলাম। ওর কাঁধে মমতার হাত রেখে বললাম,
ডোন্ট ক্রাই প্লিজ, হোয়াট’স ইওর প্রবলেম?
আসলে পুরুষের মনকে নরোম করার জন্য নারীর কান্নার চেয়ে সম্ভবত বড় আর কোনো অস্ত্র নেই। সে নারী বেশ্যা কিংবা মন্ত্রী যা-ই হোক না কেনো। আমার এ প্রশ্নের জবাবে ও যা বললো তা শুনে আমি এতো অবাক হয়েছি যে আমার এই বত্রিশ বছরের জীবনে আর কখনোই এতোটা অবাক হইনি। খুব ভাঙ্গা ভাঙ্গা নাসিকাধ্বনির প্রভাব মিশ্রিত হলেও বেশ স্পষ্ট উচ্চারণেই ও বললো, কোনো কাঁদবো না আমি?
এর পরের গল্পটা খুবই কষ্টের। সঙ্গত কারণেই মেয়েটির নাম আমি এখানে উল্লেখ করছি না। ওর বাড়ি রাঙামাটি। আট ভাই-বোনের মধ্যে ও ছিলো চতুর্থ। ওর বাবা ছিলেন কর্ণফুলী কাগজ কলের একজন সাধারণ শ্রমিক। বাবার অফিসের একজন উর্ধতন কর্মকর্তার বাসায় চট্টগ্রাম শহরে কাজ করতে আসে ও আট বছর বয়সে। ওর বয়স যখন তের তখন এক নারী পাচারকারী চক্রের খপ্পরে পড়ে চলে আসে থাইল্যান্ডের পাতাইয়াতে। সেই থেকেই ওর অভিশপ্ত অন্ধকার জীবনের শুরু। আটানব্বই সালের এপ্রিল মাসে একদল পাকিস্তানী দালালের সহায়তায় ও স্বেচ্ছায় পাড়ি জমায় সিঙ্গাপুরে।
এই মুহূর্তে মেয়েটিকে আমার খুব আপনজন মনে হচ্ছে। ও যে শুধু একজন বাংলাদেশী তা-ই না, আমরা দুজনই বিপদগ্রস্ত। আমাকে বিপদ থেকে উদ্ধার করলো মেয়েটি। কপথর্ণকিং হোটেলে টেলিফোন করে ওদের ঠিকানা যোগাড় করে দিলো।
ট্যাক্সি থেকে নেমে হোটেল কপথর্ণকিংয়ের সিঁড়িতে পা রাখতে রাখতে ভাবছি, আমিতো মেয়েটির জন্য কিছুই করতে পারলাম না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *