ক্রিকেটের বরপুত্র শচীন টেন্ডুলকারের অজানা তথ্য!!

0

ক্রিকেটের বরপুত্র শচীন টেন্ডুলকারের অজানা তথ্য!!

একজন প্রাক্তন ভারতীয় ক্রিকেটার, ক্রিকেট ইতিহাসের সর্বোচ্চ মানের ব্যাটসম্যান হিসাবে স্বীকৃত। শচীনের মাত্র ষোল বছর বয়সে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে টেস্ট ক্রিকেটে অভিষেক হয় এবং এরপর থেকে প্রায় চব্বিশ বছর তিনি আন্তর্জাতিক স্তরে ভারতের হয়ে ক্রিকেট খেলেন। তিনি টেস্ট ক্রিকেট ও একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলায় সর্বোচ্চ সংখ্যক শতকের অধিকারী সহ বেশ কিছু বিশ্ব রেকর্ড এর মালিক শচীন রমেশ টেন্ডুলকার। তিনি প্রথম ক্রিকেটার হিসাবে একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলা ও টেস্ট ক্রিকেট ম্যাচ মিলিয়ে শততম শতক করেন। বাংলাদেশের বিপক্ষে 2012 সালের এশিয়া কাপ চার দেশীয় ক্রিকেট ম্যাচে তিনি এই রেকর্ড গড়েন। ওয়ানডেতে খেলার ইতিহাসে প্রথম দ্বিশতকের মালিক তিনি। 2013 খ্রিস্টাব্দের 5 ই অক্টোবর, তিনি সমস্ত ধরনের স্বীকৃত ক্রিকেট খেলায় প্রথম ভারতীয় হিসাবে মোট 50000 রানের মালিক হন।

2002 সালে উইজডেন এর একটি নিবন্ধে তাকে স্যার ডন ব্ল্যাডম্যান এর পরে বিশ্বের দ্বিতীয় সেরা টেস্ট ক্রিকেটার এবং ভিভ রিচার্ডসের পরে বিশ্বের দ্বিতীয় সেরা একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটার বলে অভিহিত করা হয়েছে। তিনি 2011 ক্রিকেট বিশ্বকাপ জয়ী ভারতীয় ক্রিকেট দলের সদস্য ছিলেন। 2013 খ্রিস্টাব্দে উইজডেনের দেড়শ বছর উপলক্ষে প্রকাশিত সর্বকালের সেরা টেস্ট ক্রিকেট একাদশে একমাত্র ভারতীয় হিসাবে তার স্হান হয়।

তিনি ১৯৯৭ -৯৮ সালের জন্য ভারতের সর্বোচ্চ খেলাধূলার পুরস্কার রাজীব গান্ধী খেলারত্ন পুরস্কার এবং ১৯৯৯ সালে পদ্নশ্রী পুরস্কার অর্জন করেন। ২০০৮ খ্রিস্টাব্দে তাকে ভারতের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পুরস্কার পদ্নভূষণ প্রদান করা হয়। ২০১০ খ্রিস্টাব্দে আইসিসির পক্ষ থেকে শচীনকে বর্ষসেরা ক্রিকেটার হিসাবে স্যার গারফিল্ড সোবার্স ট্রফি প্রদান করে। ২০১২ সালে তিনি রাজ্যসভার সদস্য মনোনীত হন। শচীনকে প্রথম ভারতীয় খেলোয়াড় হিসাবে মর্যাদাসূচক ক্যাপ্টেন পদ প্রদান করে।

২০১২ খ্রিস্টাব্দে ২৩শে ডিসেম্বর শচীন একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে এবং ২০১৩ খ্রিস্টাব্দে ১৬ই ডিসেম্বর মুম্বাই শহরের ওয়াংখেড স্টেডিয়ামে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে ২০০ তম টেস্ট ম্যাচ জয়লাভ করে,  টেস্ট ক্রিকেট থেকে অবসর গ্রহণ করেন। অবসর গ্রহণের কিছুক্ষণ পরেই ভারত সরকার শচীনকে ২০১৪ খ্রিস্টাব্দের ২৬শে জানুয়ারি ভারতের সর্বোচ্চ পুরস্কার ভারতরত্ন প্রদান করা হবে বলে ঘোষণা দেন।

১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দে ২৪শে এপ্রিল নির্মল নার্সিং হোমে শচীন টেন্ডুলকার জম্ম গ্রহণ করেন। তার পিতা রমেশ টেন্ডুলকার একজন মারাঠি ঔপন্যাসিক ছিলেন। তাঁর মাতা রজনী টেন্ডুলকার বীমা কোম্পানিতে চাকরি করতেন। প্রথম জীবনে শচীন বান্দ্রা অঞ্চলে সাহিত্য সহবাস কো – ওপারেটিভ হাউজিং সোসাইটিতে বসবাস করতেন।

ছোটবেলায় শচীন জন ম্যাকেনরোকে আদর্শ মনে করে টেনিস খেলার প্রতি আকৃষ্ট হলেও তার দাদা অজিত তাকে ১৯৮৪ খ্রিস্টাব্দে তাকে দাদরের শিবাজি পার্ক অঞ্চলে বিখ্যাত ক্রিকেট কোচ রমাকান্ত আচরেকরের কাছে নিয়ে যান। আচরেকার তাকে বিদ্যালয়ে ভর্তি করান ও ক্রিকেট শিক্ষাদান শুরু করেন। এই সময় শচীন তার বিদ্যালয়কে মাতুঙ্গা গুজরাটি সেবা  মনডল শীল্ড জয়ে সহায়তা করেন। এছাড়াও তিনি বোম্বাইয়ের কঙ্গ লীগ প্রতিযোগিতায় জন ব্রাইট ক্রিকেট ক্লাবের হয়ে এবং পরে ক্রিকেট ক্লাব অফ ইন্ডিয়ার হয়ে খেলেন। ১৯৮৮ খ্রিস্টাব্দে টেন্ডুলকার তার খেলা প্রতিটি ইনিংসে শতরান করেন। ১৯৮৮ খ্রিস্টাব্দে বিনোদ কাম্বলির সঙ্গে লর্ড হ্যারিস শীল্ড অফ স্কুল প্রতিযোগিতায় সেন্ট জেভিয়ার্স হাই স্কুলের বিরুদ্ধে ৬৬৪ রানের রেকর্ড পার্টনারশিপ গড়েন। এই খেলায় শচীন ঐ ইনিংসে অপরাজিত 326* এবং পুরো প্রতিযোগিতায় ১০০০ এর বেশি রান করেন।

১৯৮৭ খ্রিস্টাব্দে ১৪ ই নভেম্বর টেন্ডুলকার রজ্ঞি ট্রফি প্রতিযোগিতায় মুম্বাই ক্রিকেট দলের হয়ে সুযোগ পেলেও কোন ম্যাচে প্রথম একাদশে খেলার সুযোগ হয় নি। নিউজিল্যান্ড ক্রিকেট দল ভারত সফর চলাকালীন ওয়াংখেডে স্টেডিয়ামে নেটে প্রশিক্ষণরত ভারতীয় দলের অধিনায়ক কপিল দেবের বলের বিরুদ্ধে ব্যাট করার সুযোগ পেয়ে শচীন সহজেই তাকে খেলতে থাকলে, মুম্বাই ক্রিকেট দলের অধিনায়ক দিলীপ বেঙ্গসরকার তাকে মুম্বাই দলে প্রথম সুযোগ দেন। তাকে মুম্বাই দলে প্রথম সুযোগ দেন। মাত্র পনেরো বছর 232 দিন বয়সে শচীন ঘরোয়া প্রথম শ্রেণীর ম্যাচে গুজরাট ক্রিকেট দলের বিরুদ্ধে ১০০ করেন ভারতের কনিষ্ঠতম ক্রিকেটার।

১৯৮৮ -৮৯ মৌসুমে শচীন মুম্বাইয়ের সর্বোচ্চ রান সংগ্রহ করেন তিনি। এছাড়াও তিনি ১৯৮৯ -৯০ মৌসুমের শুরুতে ইরানি ট্রফি প্রতিযোগিতায় অবশিষ্ট ভারতের হয়ে দিল্লি ক্রিকেট দলের বিরুদ্ধে অপারাজিত শতরান করেন। ১৯৮৮ ও ১৯৮৯ খ্রিস্টাব্দে শচীন দুইবার ইংল্যান্ড সফর করেন। ১৯৯৮ খ্রিস্টাব্দে ভারত সফরে আসা অস্টেলিয়া জাতীয় ক্রিকেট দলের বিরুদ্ধে মুম্বাই ক্রিকেট দলের হয়ে প্রথম দ্বিশতরান (২০৪*) করেন। ২০০০ খ্রিস্টাব্দে এপ্রিলে রজ্ঞি ট্রফি প্রতিযোগিতায় সেমিফাইনালে তামিল নাড়ু ক্রিকেট দলের বিরুদ্ধে অপরাজিত ২৩৩ রান করেন।

মাত্র একটি প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেট মৌসুমের পর ১৯৮৯ খ্রিস্টাব্দে রাজ সিং দুঙ্গারপুর শচীনকে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারত সফরে ভারতীয় দলের সদস্য হিসাবে নির্বাচিত হন। ১৯৮৯ খ্রিস্টাব্দে নভেম্বর মাসে করাচি টেস্টে মাত্র ১৬ বছর ২২৩ দিন বয়সে তার আন্তর্জাতিক টেস্ট ক্রিকেটে অভিষেক হয়। এই ম্যাচে তিনি মাত্র 15 রান করে ওয়াকার ইউনুসের বলে বোল্ড হন। শিয়ালকোট টেস্টে ওয়াকার ইউনুসের বলে নাকে আঘাত পেয়ে ও খেলা চালিয়ে যান। এবং অভিষেক একদিনের ম্যাচে কোন রান না করেই তিনি আউট হন।

এরপর ভারতের নিউজিল্যান্ড সফরে তিনি টেস্টে ২৯.২৫ গড়ে রান করেন। যার মধ্যে দ্বিতীয় টেস্টের একটি ইনিংসে ৮৮ রান করেন। নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে দুটি একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ম্যাচে ০ এবং ৩৬ রান করে আউট হন। ১৯৯০ খ্রিস্টাব্দে ইংল্যান্ড সফরে দ্বিতীয় টেস্টে বিশ্বের দ্বিতীয় কনিষ্ঠতম ক্রিকেটার হিসাবে তিনি তার জীবনের প্রথম আন্তর্জাতিক টেস্টে প্রথম শতরান এর (১১৯*) দেখা পান। ১৯৯২ ক্রিকেট বিশ্বকাপের পূর্বে অস্ট্রেলিয়া সফরে টেন্ডুলকার তৃতীয় সিডনি টেস্টে অপরাজিত ১৪৮* ও পার্থ টেস্টে 114 রান করে ক্রিকেট বিশ্বের সমীহ আদায় করে নেন।

১৯৯৯ খ্রিস্টাব্দে অনুষ্ঠিত ১৯৯৮-৯৯ এশিয়ান টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ প্রতিযোগিতায় কলকাতার ইডেন গার্ডেনস মাঠে অনুষ্ঠিত প্রথম ম্যাচে পাকিস্তানের শোয়েব আকতারের সঙ্গে ধাক্কা লেগে শচীন রান আউট হয়ে গেলে দর্শকদের ক্ষোভে খেলা বন্ধ করে দিতে হয়। পরে শচীনের আবেদনে খেলা আবার শুরু হয়। এই ঘঠনায় ভারত ও পাকিস্তান দুই দেশের মধ্যে রাজনৈতিক অস্হিরতা সৃষ্টি হয়। এই প্রতিযোগিতায় শচীন শ্রীলংকা ও পাকিস্তানের বিপক্ষে শত রান করেন।

২০০২ খ্রিস্টাব্দে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে টেন্ডুলকার পোর্ট অফ স্পেন টেস্টে তার ঊনত্রিশতম শত রান করে ডোনাল্ড ব্র্যাডম্যানের রেকর্ড স্পর্শ করেন। কিন্তু এরপরের ইনিংস গুলোতে যথাক্রমে ০,০,৮ ও ০ রান করে আউট হলে ভারত প্রতিযোগিতার পরাজিত হয়। ২০০২ সালে আগস্ট মাসে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে তিনি তার ত্রিশ তম টেস্ট শত রান করে ডোনাল্ড ব্রাডম্যান এর রেকর্ড ভেঙ্গে দেন।

২০০৩ ক্রিকেট বিশ্বকাপ প্রতিযোগিতায় ১১ টি ম্যাচে ৬৭৩ রান করে ভারতকে ফাইনালে নিয়ে যেতে সহায়তা করেন। ফাইনালে অস্টেলিয়ার নিকট ভারত পরাজিত হলেও শচীন প্রতিযোগিতার সেরা নির্বাচিত হন। ২০০৩ সালে টেস্ট ক্রিকেট ভালো খেলতে না পারলেও ২০০৪ সালে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে সিডনিতে ২৪১* রান করেন। এরপর কনুইয়ের যন্ত্রণায় ২০০৪ সালের বেশির ভাগ সময় শচীন ক্রিকেট খেলতে পারেন নি। ২০০৫ সালে ১০ ই ডিসেম্বর ফিরোজ শাহ কোটলায় শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে ম্যাচে একদিনের ক্রিকেটে তার ৩৫ তম টেস্ট শতরান করে বিশ্ব রেকর্ড গড়েন। এরপর প্রায় দেড় বছর পর ২০০৭ সালে মে মাসে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে তার পরের টেস্টে শতরান করেন।

২০০৮ সালে মার্চ মাসে দক্ষিণ আফ্রিকা ভারত সফরে এলে একটি মাত্র ইনিংস খেলে কুঁচকিতে চোট পান। ফলে প্রতিযোগিতার বাকি দুই টেস্টে এবং দক্ষিণ আফ্রিকা ও বাংলাদেশকে নিয়ে ত্রিদেশীয় প্রতিযোগিতা ও ২০০৮ এশিয়া কাপ খেলতে পারেন নি। ২০০৮ সালে শ্রীলঙ্কা সফরে তিন টেস্টে মাত্র ১৫.৮৩ গড়ে মোট ৯৫ রান করলে ভারত এই প্রতিযোগিতায় হেরে যায়। এই সফরে একদিনের ক্রিকেটে চোটের জন্য শচীনকে সরে যেতে হয়। কিন্তু পরের টেস্টে ১২০০০ রানের মাইলফলক স্পর্শ করে ব্রায়ান লারার রেকর্ড ভেঙ্গে টেস্টে সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহকের বিশ্ব রেকর্ড গড়েন।

২০০৯ সালের অক্টোবর মাসে অস্ট্রেলিয়ার ভারত সফরে প্রথম চারটি ম্যাচে শচীন যথাক্রমে ১৪,৪,৩২,৪০ করেন। পঞ্চম ম্যাচে অস্ট্রেলিয়া ৫০ ওভারে ৩৫০/৪ রান করলে তার জবাবে শচীন ১৪১ বলে ১৭৫ রান করলেও শেষের দিকে ব্যাটসম্যানদের ব্যর্থতায় ভারত মাত্র ৩ রানে পরাজিত হয়। এই খেলায় শচিন ওয়ানডেতে প্রথম ব্যাটসম্যান হিসাবে ১৭০০০ রানের মাইলফলক স্পর্শ করেন।

২০১০ সালের অক্টোবর মাসে টেস্টে ১৪০০০ রানের মাইলফলক স্পর্শ করেন টেন্ডুলকার। ২০১১ সালে 8 ই নভেম্বর টেন্ডুলকার ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে ফিরোজ শাহ কোটলা মাঠে খেলতে নেমে টেস্ট ক্রিকেটে প্রথম ১৫০০০ রান করার বিশ্ব রেকর্ড গড়েন। ২০১২ সালে ১৫ ই মার্চ টেন্ডুলকার ২০১২ এশিয়া কাপ প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশের বিরুদ্ধে খেলতে নেমে তার বহুল প্রতিক্কীত শততম শতরান করে বিশ্ব রেকর্ড গড়েন। এই রেকর্ডের পরেও ভারত সেই ম্যাচে বাংলাদেশের বিপক্ষে পরাজিত হয়।

২০১৩ সালে ১০ই অক্টোবর টেন্ডুলকার ঘোষণা করেন যে, তিনি তার জীবনের ২০০ তম টেস্ট খেলে ক্রিকেট থেকে অবসর নিবেন। ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড সেই অনুযারী ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে ঐ বছর নভেম্বর মাসে কলকাতা ও মুম্বাই শহরে দুটি টেস্ট ম্যাচের আয়োজন করে। মুম্বাইয়ে অনুষ্ঠিত ২০০ তম ম্যাচে তিন ৭৪ রান করেন। ফলে টেস্ট ক্রিকেটে তার ১৬০০০ রান থেকে মাত্র ৭৯ রান দূরে তিনি আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার শেষ করেন।

 

Written By :
Mohammad Ali

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *